জীবন মানে তুমি পর্ব:২

জীবন মানে তুমি
লেখিকা:H.B.Irini Ori
পর্ব:২
(৬)
এই সমাজটা বড়ই বিচিত্র।এখানে যারা বসবাস করে তাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা নিজের চাহিদাকে বেশি মুল্য দেয়।নিজের চাহিদার জন্য অন্যকে ছোট করতেও দ্বিধাবোধ করেনা।এক প্রকার হিংস্রতা জেগে ওঠে তাদের মধ্যে।এক সময় এই হিংস্রতা এতটা বেড়ে যায় যে তারা তাদের নিজেদের সীমা পেরিয়ে যায়।তারা তাদের জন্য বিন্দুমাত্র লজ্জিত হয়না।আবার কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের সুখের কথা ভেবে নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার নূন্যতম ইচ্ছা প্রকাশ করেনা।তবে বাস্তবতা এমনি নিষ্ঠুর যে তারাই সমাজে সবচেয়ে বেশি অবহেলা আর কষ্টের শিকার হয়।বিজ্ঞানী এরিস্টটলের সেই বিখ্যাত উক্তি -“মানুষ সামাজিক জীব।”এটা নিয়ে আমাদের সমাজে নানা প্রচলিত কথা আছে।অবস্থা এমন যে,যদি সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথার বাইরে কেউ যদি কোনো কাজ করে তবে সে সমাজের বাইরে চলে যায়।শুনতে হয় তাকে নানা কথা।ঠিক সেটাই হয়েছে ইয়ারাবীরর ক্ষেত্রে।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইয়ারাবী বাসায় ফিরে।বাসায় ঢুকতেই দেখে তার ছোট খালা পুরো পরিবার নিয়ে বাসায় উপস্থিত। তবে কেন যেন ইয়ারাবীর এদের উপর থেকে মন উঠে গেছে।ইয়ারাবীককে দেখেই ওর ছোট বোন দৌড়ে ওর কাছে যেয়ে বলে,
-“আপু জানিস আজ আমাদের রেজাল্ট দিয়েছে।আমি ফাস্ট হয়েছি।”
-“আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো।”
ইয়ামিলা ওর ডান হাত ইয়ারাবীর কাছে পেতে দেয়।যদিও ইয়ামিলা সব সময় ইয়ারাবীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে তবুও বোন।এক মায়ের পেট থেকে জন্ম,এক আত্মার সম্পর্ক।ওদের মারামারি,ঝগড়া, মান অভিমান সব হলেও এটা সত্য যে ইয়ারাবীকে ছাড়া ওর চলেই না।ওর হাত পাতা দেখে ইয়ারাবী ভ্রু কুচকে বলে,
-“সরতো বাইরে থেকে এসেছি।”
-“আগে আমার চকলেট দাও।আমি জানি তোমার ব্যাগে আছে।জলদি দাওনা বিচ্ছু বাহিনী আছে টের পেলে নিয়ে নিবে।”
ইয়ারাবী ব্যাগ থেকে দু’টা চকলেট বের করে দিয়ে যেই নিজের রুমে যাওয়ার জন্য সিড়িতে পা দিয়েছে ওমনি পিছন থেকে ওর ছোট খালা বলে,
-“ছি ছি, তোর কান্ড-জ্ঞান বলতে কিছু নেই নাকী।এতক্ষণ কেউ বাইরে থাকে।তার উপর তোর সামনে বিয়ে হবে।”
ইয়ারাবী মুচকি হাসি দিয়ে ওর খালার সামনে যেয়ে বলে,
-“এ্যাট ফার্স্ট খালা এটা গ্রাম নয় শহর।তারপর আমার শুধু ইনগেজমেন্ট হয়েছে।আর রইলো আপনার সো কলড্ কান্ড-জ্ঞান।আপনার বড় বোনের মতে সেটাতো আমার কোনদিনও ছিলোনা।আমি শুধু লেখাপড়া নই বিভিন্ন সামাজিক কাজে জড়িত।তাই দেরি হওয়াটাই স্বাভাবিক,যেখানে আমার ফ্যামিলির সমস্যা হচ্ছে না সেখানে আপনার এত সমস্যা কেন?”
ওর খালা কিছুটা আমতা আমতা করে বলে,
-“না মানে যাদের বিয়ে হবে বা কথাবার্তা চলছে তাদের সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকতে নেই।ওসবের কু-নজর লাগে।”
ইয়ামিলা চকলেট খেতে খেতে বলে,
-“কিন্তু খালা, আপুর তো গায়ে হলুদ হয়নি।আর আমি তো জানতাম যাদের গায়ে হলুদ হয় তাদের বাইরে থাকতে নেই।”
-“না মানে..আচ্ছা বাদ দে।তোরা আবার শহরের মেয়েতো তোরা এসব মানিস না।”
ইয়ারাবী মনে মনে বলে,”এরা ভাঙবে তবে মচকাবেনা।”ইয়ারাবীও আর কিছুনা বলে নিজের রুমে চলে যায়।এদের বলে বা বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই।ওই যে একটা কথা আছেনা,”মুর্খের সাথে তর্ক করলে তুমিও মুর্খের মতো হবে।তার থেকে একজন জ্ঞানী ব্যাক্তির সাথে তর্ক করে হেরে গেলেও তুমি কিছু শিখতে পারবে।”
ইয়ারাবী ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসতেই ওর প্রচন্ড বুকে ব্যাথা করে।বিগত দুই বছর ধরে এমনটা হয় তবে এই একমাস ধরে একটু বেশিই হচ্ছে।ডাক্তারের কাছে যাবে যাবে করে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনা।এই ব্যাথাটা তখন থেকে যখন ওর বোন ওর বুকে পা দিয়ে অনেক জোরে আঘাত করেছিলো,ঠিক সেই এক যায়গাতে ওর মাও পা দিয়ে লাথি মেরেছিলো।কারন ইয়ারাবীর ভুলটা ছিলো ওর পায়ে লেগে ওর বোনের সাজানো খেলার ঘরটা ভেঙে গেছিলো,যেটা কিনা দু’বার সাজানো যেতে।কিন্তু ইয়ামিলা সেটা না করে ওর মায়ের কাছে যেয়ে নালিস করে।
নামায পড়ে ব্যাথার জন্য একটা প্যারাসিটামল খেয়ে কেবল শুতে যাবে ওমন সময় ওর মা আসে ওর রুমে।ওর বুকে হাত দেওয়া দেখে বলে,
-“কী হয়েছে তোর?আজকাল দেখি অনেক সময় বুকে হাত দিয়ে রাখিস।আর তোর রুমে প্যারাসিটামল মেডিসিন বেশি দেখি কেন?”
-“তোমার আবার আমাকে খেয়াল করার সময় ও আছে,জানতাম নাতো।যাই হোক কিছু কী বলবে?কারন খুব দরকার ছাড়া তো তোমার এই রুমে আসা হয়না।”
-“এভাবে বলিস কেন?আমিতো তোর মা। দেখ মায়েদের অধিকার থাকে সন্তানদের শাসন করার। ”
ইয়ারাবীর ওর মায়ের কথা শুনে খুব হাসি পেল।কিন্তা হাসলোনা।যেমন ও প্রচন্ড রকমের কান্নাকে কন্ট্রোল করতে শিখে গেছে তেমন হাসিটাকেও।আজকাল ওর বাবা-মার ভালোবাসার কথাগুলো শুনলে খুব হাসি পায়।
মিসেস.ইশানি মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করছেন।কিন্তু পারছেন না বুঝতে তার মেয়ের মধ্যে কী চলছে।আচ্ছা মায়েরা তার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারেন তার সন্তানের মনের অবস্থা কী?তাহলে উনি কেন পারেন না ইয়ারাবীকে বুঝতে?একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
-“আম্মু শোন,তোর ছোট খালার একটা কথা বলছিলো, যে তোর বিয়ের আগ পর্যন্ত এখানেই থাকবে।”
-“কিন্তু বিয়ে হতে তো তিন মাস বাকী।তাছাড়া যদি এখানে থাকে তাহলে ওনার ছেলে-মেয়েদের লেখা পড়ার কী হবে?”
-“আসলে,”
-“যা বলার খুলে বলো আসল কাহিনি কী?”
এবার ওর মা একটু নড়েচড়ে বসে বলেন,
-“আসলে হয়েছে কী, তোর ইনগেজমেন্টের সময় আবরারদের পুরো পরিবার সেখানে ছিলো।ওর ওই যে একটা চাচতো ভাই আছেনা ,কী যেন নাম?ওই যে এসে ধরে তোর সাথে সেলফি তুলছিলো ছেলেটা।”
-“মেঘের কথা বলছো নাকী?”
-“হ্যাঁ,মেঘ,আসলে তোর খালা চাইছে টিকলির সাথে ওর বিয়ের কথা বলতে?”
-“আর ইউ্ ম্যাড্ আম্মু?ওর বয়স কত? কেবল ক্লাস নাইনে পড়ে আর এখনি বিয়ে। আর তুমিও হ্যাঁ বলেছো নিঃশ্চয়। ”
ওর মা রেগে গিয়ে বলে,
-“আমি কেন হ্যাঁ বলতে যাবো?তোর কী আমাকে এতটাই মুর্খ মনে হয়?আমিও না করেছি,কিন্তু কথা শুনছে না।আচ্ছা মেঘতো তোর পরিচিত।তুই যদি তোর খালাকে বুঝিয়ে বলিস তাহলে তোর খালা বুঝবে।”
-“দেখ আম্মু,তোমার বোনকে যদি বোঝাতে যায় তাহলে সে ভাব্বে তার মেয়েকে আমি হিংসা করছি।তার থেকে ভালো তোমার বোনকে তুমি বুঝাও।আর হ্যাঁ,ওনারা এসেছে ভালো কথা আমার রুমে যেনো কেউ না আসে।”
-“কিন্তু টিকলিতো তোর কাছে শুতে চাচ্ছে।আর আমিও বলেছি যতদিন আছে তোর কাছেই থাকবে।”
-“এখন তোমরা এটাও ঠিক করবে আমার রুমে কে থাকবে আর থাকবেনা।যতসব আর ভালো লাগেনা।”
ইয়ারাবী কথাগুলো বলে বেলকনির দিয়ে যে সিড়িটা ছাদে যায় ওটাই গিয়ে বসে।অন্য সময় অবশ্য ইয়ারাবীর এই ব্যবহারে ওর মা খুব রেগে যেতো কিন্তু আজ কেন যেনো ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে ইয়ারাবীর জন্য।
কিছুক্ষণ পর উনি ইয়ারাবীর পাশে যেয়ে সিড়ির উপর বসেন।কিন্তু কোনো কথা বলেন না।ইয়ারাবী ওনার দিকে তাকিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দেয়।বুকে খুব ব্যাথা করছে তবুও ওর মায়ের সামনে একটা উচ্চারনও করেনা।ওর মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-“রাতে কী খাবি?তোর বাবা বলছিলো তোর যেটা পছন্দ সেটা করতে।”
-“চলে যাবো সেই খুশিতে নাকী সকালে বললাম ওটার জন্য।”
-“কেন?তোর কাছে কী শুনতে পারিনা?”
-“তোমার বোনের ছেলেমেয়ে যা খাবে তাই করো।নয়তো আবার বলবে ওনাদের কোনো কেয়ার করা হয়নি।সারা জীবন ধরেই তো করলে নাম তো হয়না।”
এইটুকু বলে ও ছাদে চলে যায়।মিসেস ইশানি মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
(৭)
মিসেস ইশানি একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে রুমে এসে দেখে টিকলি রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে দিকে উকি দিচ্ছে।ওনি টিকলিকে ভিতরে ডাকলেন।টিকলিও গুটিগুটি পায়ে ভিতরে আসে।মেয়েটা খুবই যেমন লক্ষী তেমন রুপবতীও বটে,তবে একটু বোকা আছে।এই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তেমন চলতে পারেনা।এমন চেহারার মেয়েকে গ্রামে রাখা খুব একটা সহজ কাজ নয়।টিকলি গ্রামের একটা স্কুলে লেখাপড়া করে।ওর পরে যে তিন ভাইবোন আছে বলতে গেলে টিকলি তাদেরকে মানুষ করছে।যখন ওর মা বাড়িতে থাকেনা তখন ওই বাড়ির সব কাজ করে।ইয়ারাবী সব কয়টা কাজিনের মধ্যে ওকেই বেশি ভালোবাসে।
আজ টিকলি হলুদ কালারের একটা থ্রি-পিচ পড়েছে।ফর্সা চেহারার সাথে ওকে খুব মানিয়েছে।টিকলি পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে মিসেস ইশানিকে প্রশ্ন করে,
-“আপু কই খালা?এসে ধরে আপুর সাথে কথা হয়নি।”
-“তোর আপু ছাদে গেছে।”
-“কই আমিতো নিচে ছিলাম যেতে তো দেখিনি”
-“পাগলি, পিছনের সিড়ি দিয়ে গেছে তাই।ডিনারের সময় তো দেখা হবেই এখন কষ্ট করে যাওয়ার দরকার নেই।”
মিসেস ইশানি টিকলিকে নিয়ে নিচে চলে যায়।ওনি এতটুকু বুঝতে পেরেছেন ইয়ারাবীর মন খারাপ।তাই আর টিকলিকে যেতে দেননি।যদিও খারাপ ব্যাবহার করতোনা টিকলির সাথে তবুও উনি ইয়ারাবীকে চেনেন।কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকতো।আর সেটা দেখতে খুব খারাপ দেখায়।
(৮)
মিসেস জামান সন্ধ্যার সময় এক হুজুরের সাথে দেখা করতে গেছেন।যার সাথে দেখা করতে গেছেন তিনি শহর ছেড়ে অনেকটা দুরের গ্রামে থাকে।একটা বেড়ার ঘেরা টিনের বাড়িতে থাকেন।মিসেস জামান অনেক্ষন ধরে বসে আছেন হুজুরের জন্য।হুজুর নিজের হাতের কাজগুলো শেষ করে মিসেস জামানের সাথে দেখা করেন।
-“হুজুর কিছু একটা করুন।আমি তো ফোনে আপনাকে সব বলেছি।”
-“দেখুন আমি এসব কাজ কিন্তু করিনা।তারপরও আপনি বললেন বলে করেছিলাম।কিন্তু ফলস্বরুপ তো শূন্য পাওয়া গেল।তারমানে মেয়ের ইমান খুব পাকাপোক্ত।কোনো খারাপ জিনিস ওর অনিষ্ট করতে পারবেনা।”
-“তাহলে আমার মেয়ের কী হবে?”
-“দেখুন এসব কাজ যারা করে তারা ইহকাল আর পরকাল দু’জায়গাতে শাস্তি ভোগ করে।”
মিসেস জামান এবার রেগে যান।তিনি বিরক্তির সুরেই বলেন,
-“আপনি যদি এগুলো যানেন তাহলে কেন সাহায্য করলেন?”
-“দেখুন একটা সময় মানুষ ভুলগলো শুধরে নেয়।আমিও ভুল করেছি তাই শুধরে নিচ্ছি।মাফ করবেন আমি আর এসব করতে পারবোনা।”
মিসেস জামান আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন।হুজুর চাইলে কাজটা করতে পারতো।কিন্তু যখন ফোনে বিস্তারিত শুনলো তখন ওনার নিজের মেয়ের কথা মনে পরলো।যদি ইয়ারাবীর জায়গায় ওনার নিজের মেয়ে থাকতো তাহলেও কী উনি এমন করতেন?বিবেক,মানুষের ঘুমিয়ে থাকা বিবেক যখন জাগ্রত হয় তখন সেটা সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
মিসেস জামান যখন নদী পার হওয়ার জন্য নৌকার উঠবেন এমন সময় পিছন থেকে কেউ ডাক দেয়।পিছনে ঘুরে দেখেন ৪০-৪৫ বছর বয়সের একজন কালো করে লোক গায়ে ময়লা একটা শার্ট আর পড়নে ময়লা সাদা ধুতি,মুখে দাঁড়ি।পড়নের জামা-কাপড়গুলো ঘামে ভিজে গেছে।পান খাওয়া দাঁতগুলোতে আরো বিশ্রী দেখতে লাগছে।মিসেস জামান লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে গেলে লোকটা আবার ডাক দেয়।এবার উনি খুব বিরক্তবোধ করে সামনে এগিয়ে বলেন,
-“কী চাই?আর আমাকে কেন ডাকছেন?”
লোকটা তার পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে বলে,
-“প্রায় দেহি আপনি এই হুজুরের কাছে যান।তাবিজ কবজের জন্য নাকী?”
-“সেটা আপনাকে কেন বলবো?”
লোকটা পানের চিপি ফেলে আবার বলে,
-“আপনি চাইলি আমি আপনারে সাহায্য করতি পারি।”
-“কেমন সাহায্য করবেন আপনি?”
লোকটা এগিয়ে এসে নদীর পাড়ের কাঠের পাটাতনের উপর বসে বসে,
-“দেহেন আমি জানি আপনি তাবিজের জন্য আহেন।জানিনা এই হুজুরের কী হইছে? এহন আর কারোরে তাবিজ দিতে চাইনা।”
-“আমার তাবিজ নয় আমার অন্য কিছু লাগবে।”
-“তয় আমি আপনারে সাহায্য করতি পারি।আমি একজনরে চিনি আপনার সব কাজ করবার পারবে।”
-“এটাতে আপনার লাভটা কী?আর আপনার নামটা কী?”
-“আমার নাম হইলো গোবিন্দ।এইহানে থাহি।আর লাভটা হলো কিছু টাহা আমারে দিবেন এই আর কী?”
-“যত টাকা লাগবে আমি দিবো কিন্তু কাজটা হওয়া চায়।আচ্ছা যে কাজ করবে সে হিন্দু না মুসলিম।”
-“হেই মুসলিম।সে মেলা জিন পালে।আপনার কাজ হয়ে যাবে।”
-“কখন যাওয়া যাবে তার কাছে?”
-“হেই তো নিজের গাঁও গেছে।তবে সামনের মাসে আসবো।আপনার নাম্বারখান দিয়া যান আমি ফোন দিমু।”
মিসেস জামান নিজের নাম্বারের সাথে কিছু টাকা বের করে দেন লোকটার হাতে।তিনি খুব ভালো করে জানেন এসব মানুষ টাকা ছাড়া একচুল পরিমান কাজও করেনা।মিসেস জামান নদী পাড়ের জন্য নৌকাতে উঠে বসেন।তার চোখে মুখে খুশির ঝলক।কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না কত বড় বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করছে।কাউকে যদি তুমি কাঁদাও তাহলে তোমাকেও একদিন কাঁদতে হবে।আর যদি ক্ষতি করো তবে তার মুল্যও তোমাকে ইহকাল পড়কাল দুই জায়গাতেই দিতে হবে।
(৯)
আজকাল ইয়ারাবী একাকীত্বকে বেশি আপন করে নিয়েছে।আগে সবার সাথে আড্ডা দিতে গল্প করতে ভাল লাগলেও এখন একা থাকতে বেশি পছন্দ করে।এখানে পছন্দ করে শব্দটা ঠিক ওর সাথে যায়না।বলা যায় উপায় না পেয়ে একাকীত্বককে সঙ্গী করে নিয়েছে।
মাঝে মাঝে ইয়ারাবীর বলতে ইচ্ছা করে,”আমি এভাবে মৃত্যু চাইনা,আমি হতাশা থেকে মুক্তি চাই,কান্না ছাড়া একটা রাত চাই,আনন্দে একটা দিন কাটাতে চায়,শান্তিতে একটু ঘুমাতে চাই।অন্য সবার মতো আমিও চাই কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিক।কেউ আদর করে খাইয়ে দিক,আমিও চাই একটু প্রান খুলে হাসতে।”
খোলা আকাশের নিচে ছাদের রেলিং এর উপর বসে কথাগুলো ভাবছিলো ইয়ারাবী। হঠাৎ ওর ফোনের রিংটোনে হুশ ফেরে।স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে আবরার কল করেছে।ইয়ারাবী বুঝতে পারেনা এমন আদর্শ সুদর্শবান ছেলে ওর জন্য পাগল কেন?ইনগেজমেন্টের দিন ছেলেটা যা পাগলামি করেছিলো তাতে ও একবার ধরেই নিয়েছিলো হতে পারে সিনেমা ,গল্পের মতো কোনো হিডেন লাভার।কিন্তু কথাটা মনে পড়ার পরবর্তীতে ও হেসে দেয়।কেননা ও এমন কোনো পার্সন নয় যে যার জন্য ওর কোনো হিডেন লাভার থাকার কথা।ছেলেটার পাগলামি দেখে ইয়ারাবীর মনে হয় এটা ওর মোহ।যখন মোহ কেটে যাবে তখন সব আবার বদলে যাবে।স্বপ্ন দেখা ওর সাজেনা,আর ও স্বপ্ন দেখতেও চাইনা।
দু’বার কল কেটে যাওয়ার পর তৃতীয়বারে ও ফোনটা রিসিব করে।বুকের ব্যাথার জন্য অনেকটা নিচু কন্ঠে বলে,
-“আসসালামুআলাইকুম ”
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম।কী ব্যাপার এত লেট হলো যে ফোন ধরতে?রাগ করেছো আমার উপর?”
-“রাগ কেন করবো আপনার উপর?”
-“এই তোমাকে সকালে সময় না দিয়ে চলে গেলাম।আসলে ল্যাবে খুব বাজে একটা ঘটনা ঘটেছিলো।কোথায় তুমি?”
-“এইতো ছাদে।আপনি কোথায়?”
-“ল্যাবে,ফ্রি হলাম বলে কল করলাম।খেয়েছো কিছু?”
-“না,আপনি খেয়েছেন?”
-“আমি আটটার মধ্যে ডিনার করে ফেলি।কী হয়েছে তোমার?গলার স্বর এমন লাগছে কেন?”
-“তেমন কিছুনা,ওই একটু মাথা ব্যাথা আরকি।”
-“এই মেয়ে মিথ্যা বলছো কেন?কী হয়েছে বলবে তুমি?”
-“আসলে সন্ধ্যা থেকে একটু বুকে ব্যাথা করছে।”
-“হুয়াট্?বুকের ব্যাথাকে কেউ সামান্য বলে?পাগল তুমি”
-“আরে এতো হাইপার হবেন নাতো।ঔষধ নিয়েছি ঠিক আছি।”
-“কী মেডিসিন নিয়েছো?”
-“আচ্ছা আপনি কী ডাক্তারি করার জন্য ফোন করেছেন নাকী কথা বলার জন্য?”
-“কথা বলতেই চেয়েছিলাম।শুধু ব্যাথাকে হেয়ালি করোনা।ডাক্তারের কাছে যাবে কাল।”
-“হু”
আবরার আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু কী ভেবে যেনো আর বলেনি।ইয়ারাবীকে নিজের খেয়াল রাতে বলে ফোনটা কেটে দিলো।ফোনটা রাখার সাথে সাথে তিথি এসে ডাকলো ডিনারের জন্য।তিথি টিকলির ছোট বোন।খুব দুষ্টু একদম পাকা বুড়ি।কথায় এত পটু যে ওর সাথে কথায় কেউ পেরে উঠেনা।
সবাই খেতে বসেছে।ইয়ারাবীর খাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিলোনা।তবে যতোই ফ্যামিলির মধ্যে ঝামেলা থাক না কেন বাইরের মানুষকে সেটা বুঝতে দেওয়া ঠিকনা।তাই না চাইতেও ওকে খেতে বসতে হলো।হঠাৎ ওর খালার নজর যায় ইয়ারাবীর হাতের ব্যাসলেটের উপর।
-“এই ইয়ারাবী তোর হাতের ব্যাসলেটটা যে অনেক সুন্দর লাগছে।তুই তো চুরি বা ব্যাসলেট এসব পছন্দ করতিনা পরতে।”
ইয়ারাবী কিছু বলার আগে ওর আব্বু বলে,
-“ব্যাসলেটটা দেখে তো ডায়মন্ডের মনে হচ্ছে।কোথায় পেলি?”
-“আবরার দিয়েছে।ইনফ্যাক্ট এটা দিয়ার জন্যই ডেকেছিলো।”
ওর শুনে ওর খালার চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠে আর বলে,
-“ওমা এটা সত্যি হিরার নাকী?আমি তো আগেই বলেছিলাম আমাদের ইয়ারাবী রাজ কপালের। দেখলিতো আপু,এবার আমার টিকলির ও এমন একটা কপাল চায়।”
-“কিন্তু খালা ওর তো এখনো বয়স হয়নি।তাহলে?”
-“ওর পড়িয়ে কোনো লাভ নেই রে।ও তোদের মতো কিছু করে খেতে পারবেনা।”
ইয়ারাবী কিছুটা তাসছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
-“কার কপালে যে কী আছে সেটা কেউ বলতে পারেনা।”
রাতে খাবার খেয়ে ইয়ারাবী নিজের রুমে একাই ঘুমিয়েছে।অবশ্য টিকলি ইয়ারাবীর কাছে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু ও নানা বাহানায় ইয়ামিলার কাছে পাঠিয়ে দেয়।কেননা ও চায়না কেউ ওর নির্ঘুম রাতের সাথী হোক।রাত যত গভীর হতে থাকে ইয়ারাবীর বুকের ব্যাথাটাও অনেক বাড়তে থাকে।ব্যাথাকে ভুলার জন্য ও উঠে ডাইরি লিখতে বসে।
স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল বলেছেন,”পৃথিবীকে যেমন পেয়েছো তার চেয়ে ভালো রেখে যেতে চেষ্টা করো।”
কিন্তু কিছু স্বার্থপর মানুষ নিজেদেরকে ভালো রাখার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।এতটাই স্বার্থপর হয়েছে যে কাছের মানুষটার খবর নেওয়ারও সময় হয়না।এটার নামই কী জীবন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here