জীবন মানে তুমি পর্ব:৫

জীবন মানে তুমি
লেখিকা:H.B.Irini Ori
পর্ব:৫
(১৮)
কাল বিকাল থেকে আবরার ল্যাবে প্রচুর বিজি।হাসপাতাল আর ল্যাব নিয়ে ওর পাগল হয়ে যাওয়ার উপায়।সকালের ব্রেকফাস্টটাও ঠিকমত করতে পারেনি।কাজ শেষ করে লান্চ টাইমে কিছুটা ফ্রি হয়েছে।হঠাৎ করেই ওর ফোনটা বেজে ওঠে।অনেকটা বিরক্তির সাথে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাই।কিন্তু যেটা দেখে তাতে ও অবাক হয়ে যায়।কেননা ইয়ারাবী এই প্রথম ওকে ফোন করছে।ও ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে নিচু স্বরে কেউ সালাম দেয়।
-“আসসালামুআলাইকুম ”
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম,কী ব্যাপার ম্যাডাম? আজ যে নিজ থেকে কল করেছেন।খুব মিস করছিলে নাকী?”
-“না,আমি কাউকে মিস করিনা।আসলে,,”
-“বলো,”
-“আপনি কী খুব ব্যাস্ত নাকী?”
-“এইতো ল্যাব-হসপিটাল দিয়ে কিছুটা বিজি আরকী।সরি,”
-“কেন?এটাতো আমার বলা উচিত,কারন আমি আরো সময় নষ্ট করছি আপনার।”
-“তোমাকে আমি বলছি নাকী সময় নষ্ট করছো,এতো বেশি কেন বুঝো।আর সরি এই জন্য বলছি তোমার সাথে দেখা বা কথা বলতে পারিনি।”
-“ওসব কিছুনা,আসলে আপনাকে একটা দরকারে কল করেছিলাম।”
-“হামম বলো,”
-“আসলে সকাল ধরে গা না মানে মেঘের নাম্বারটা বন্ধ তাই ভাবলাম আপনাকে কল করি আর,,,,”
-“আসলে কাল ওর ফোনটা পানিতে পরে নষ্ট হয়ে গেছে।কী বলতে হবে আমাকে বলো? ”
-“ও যেন এখন অনুর বাসায় চলে আসে। কাজ আছে,আচ্ছা এখন রাখি,আল্লাহ হাফেজ।”
-“একমিনিট,কী হয়েছে তোমার?ঠিক আছো তো?”
-“একদম ঠিক আছি…”
-“তাহলে তোমার ভয়েজ এমন লাগছে কেন?আজও কী বাসায়?”
-“না না, এমন কিছু না,হালকা ঠান্ডা লাগছে?”
-“হাউ কুড্ ইউ্ সো মাচ্ এক্সকিউজ্?দেখ তোমার ভয়েজ শুনলেই বুঝতে পারি কী হয়েছে?এখন তুমি বলবে নাকী অন্য উপায়ে জানতে হবে আমার।আর সেটা কিন্তু তোমার জন্য ভালো হবেনা।”
কথাটা শান্তু কন্ঠে বললেও অনেকটা রাগ প্রকাশ পায়।ইয়ারাবী এটা শুনে বিরবির করে বলে,
-“এক পাগলের জ্বালায় বাঁচিনা আরেক পাগল এসে হাজির।”
-“কী বিরবির করছো?যা বলার সরাসরি বলো।”
-“তেমন কিছুনা,আমি রাখছি”
-“ইয়ারাবী,আমার কী আসতে হবে বাসায়?”
-“একটা কথা বলবেন?”
-“কী বলো?”
-“আচ্ছা,আপনি আমাকে বিয়ে কেন করছেন?না মানে আমি দেখতে খারাপ,এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিনি,তাছাড়া ঘরের কোনো কাজ পারিনা।”
-“এসব ব্যাপারে আমরা আগেই কথা বলেছি।”
-“আসলে,আমি কিন্তু খুব বোরিং পার্সন।দেখেন একটা মানুষ আমার সাথে দু’দিন মিশলে তৃতীয় দিন আর মিশেনা।কেন জানেন?বিকজ্,আমি এতটাই বোরিং যে মানুষ দু’দিন মিশলে তৃতীয়দিন কথা বলতে চায়না।সেখানে তো আপনি সারা জীবন থাকার কথা বলছেন।”
-“কী হয়েছে তোমার?আর শোনো আমার বোরিং পার্সনের মানুষ পছন্দ বুঝলে।”
-“আপনার সাথে কথা বলে জিতা খুব মুসকিল।”
-“আই নো…”
-“আচ্ছা রাখি,আল্লাহ হাফেজ”
-“নিজের খেয়াল রেখো,আল্লাহ হাফেজ।”
আবরার ফোনটা কেটে ইয়ারাবীর ছবির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো,কিন্তু যতদিন তুমি মুখে বলবেনা ততদিন আমিও জোর করবোনা।তবে বোরিং পার্সন নিয়ে চিন্তা করোনা,টিয়াপাখিকে যেমন কথা বলা শিখিয়ে নিতে হয় তেমন আমিও শিখিয়ে নিবো।”
-“স্যার,হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে,ইমার্জেন্সি”
-“ওহহ,আচ্ছা,যদি কোনো প্রবলেম হয় আমাকে কল দিয়ো।বাই”
আবরার গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের উদ্দ্যেশে বেড়িয়ে পরে।
(১৯)
-“কীরে কার সাথে কথা বলছিলি?”
-“আরে মেঘকে ফোনে পাচ্ছিলাম না তাই আরকী..”
-“ওহো….কথা বলবি ভালো কথা তা এত লজ্জা কেন পাচ্ছিস।বুঝছিনা হঠাৎ করে এত লজ্জা তোর কাছে কীভাবে এলো?”
-“ওই কী বলছিস তুই আমার লজ্জা নাই নাকী?”
-“আরে জানু রাগিস ক্যান এতো?বাই দ্যা রাস্তা,কবে তোর ওই কুটনি খালা বাসার থেকে যাবে বলতো?”
ইয়ারাবী অনুর বেডের উপর শুয়ে বিড়াল নিয়ে খেলতে খেলতে বলে,
-“বিয়ের আগে যাবে বলে মনে হয়না।যত প্রকারের কুট বুদ্ধি আছে আমার জন্য এপ্লাই করতে পারছেনা।আমি যে কত বড় সমস্যা ওদের সেটা মনে পড়লেই হাসি আসে।”
-“তবে দোস্ত আমার কেন জানি আবরারদা কে নিয়ে সন্দেহ হয়।”
-“মানে?”
-“না মানে দেখ ওনার বিহেবে তোর কিছু মনে হয়না নাকী?উনি এমন করেন যেন মনে হয় উনি তোকে আগে থেকেই চেনেন।”
-“হয় তোরে কইছে।সারাদিন মুভি দেখে দেখে মাথা পুরো গেছে আপনার।”
-“হ আমার কথা শুনবি কেন?আমি তোর কে হই?”
-“৩৭ নাম্বার তেতুল গাছের ৭৪ নাম্বার ভুতের ৯২ নাম্বার নাতির ২৪ নাম্বার ছেলের ৩ নাম্বার বাচ্চার মা হোস।ওরফে আমার মতো মাসুস মেয়ের বান্ধবী।”
অনু প্রথমে কথাটা শুনে রেগে গেলেও পরে ওর রাগ পরে যায় ইয়ারাবীর হাসির শব্দ শুনে।আজ অনেকদিন পরে ওকে এভাবে মজা করতে আর হাসতে দেখছে।ওভাবে তাকানো দেখে ইয়ারাবী হাসতে হাসতে বলে,
-“কী দেখছিস?”
-“তোকে,জানিস তোর হাসিটা কত সুন্দর।”
ইয়ারাবী একদম চুপ হয়ে যায়।সেটা দেখে অনু বলে,
-“কারোর জন্য নিজের জীবনের থেকে সব হাসি আনন্দ হারিয়ে ফেলবি এটা কেমন কথা।জানিস এভাবে মানুষ একটা সময় শেষ হয়ে যায়।”
-“সেটাই আমি চায়।জানিস কখনো নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার থেকে চুপ করে থাকাটা অনেক ভালো।”
-“সত্যিই তোকে বুঝা খুব দায়।নিজে ডিপ্রেশনে থেকে অন্যকে কী সুন্দর করে মোটিভেশন দিস।তবে নীরবতা,নিঃসঙ্গতা কী জিনিস সেটা মনে হয় তোর থেকে কেউ ভালো বুঝবেনা।”
-“জানিস আগে অন্ধকার জিনিসটা ভালো লাগতো না তবে,এখন অন্ধকারকে আপন করে নিয়েছি।”
-“এসব বাদ দে।এখন বল মেঘ আসছে তো।”
-“মেঘ আসছেনা চলে এসেছে”
দু’জনে পিছনে তাকিয়ে দেখে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে।যদি আবরারের চাচাতো ভাই তারপরও দেখতে কিছুটা ওর মতো।লম্বা,ফর্সা,সিল্কি চুল তবে মেঘের চোখের রং হালকা নীল।যেটাতে ওকে আরো ফুটিয়ে তোলে।অনু মেঘকে উপর নিচে স্ক্যান করে বলে,
-“তুই ভিতরে কীভাবে এলি?”
-“তুই যে গাধা সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম।ডাইনি মেইন ডোর খোলা রেখেছিলি কেন?এদিকে চোর চুরি করে নিয়ে গেলেও তো টের পাবিনা।”
-“এর মানে ইয়া আসার পর আর বন্ধ করিনি।”
-“গাধা কী আর সাধে বলি।”
-“ওই মেঘ বাদর অনুকে গাধা বলবিনা?”ওকে গাধী বলবি বুঝলি?”
এটা শুনে অনু রেগে ওদের দিকে কুশন ছুড়ে মারতে থাকে।
(২০)
বিকালের দিকে আবরার ওর পুরো ফ্যামিলি নিয়ে ইয়ারাবীদের বাসায় আসে।ওদের এভাবে আসা দেখে বাসার সবার কিছুটা খটকা লাগে।মি.ফুয়াদ ওনাদের বসতে বলে মি.রায়হানকে বলে,
-“কী হয়েছে স্যার?এভাবে এই সময়ে আপনারা?”
-“বেয়াই সাহেব হয়েছে তো অনেক কিছুই।তাই আর এভাবে এগুতে চাচ্ছিনা।”
ইয়ারাবীর খালা এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই মিসেস জামানকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেন।তার ধারনা আবরাররা বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিবে।
মি.ফুয়াদ মি.রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ইয়ারাবী কী কিছু করেছে?ও যদি কিছু করে বা বলে থাকে তার জন্য সরি।”
-“আরে দুলাভাই আপনার দুধে ধুয়া তুলসি পাতার মেয়ে কিছু না করলে তো আর এমনি এমনি বিয়েটা ভেঙে যায়না।নিঃশ্চয় ওই অপয়া মেয়েটা কিছু করছে।”
আবরারের মা এটা শুনে বলে,
-“সরি মিসেস নিকি আপনি কোথাও ভুল ভাবছেন।”
-“কী ভুল ভাবছি ?আমি ঠিকই ধরেছি, আপু আমি আগেই বলেছিলাম মেয়েকে বেশি লাই দিসনা এবার দেখলি তো তোদের সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিলো।”
-“জাস্ট স্যার্ট আপ।কখন থেকে আপনি ফালতু কথা বলে যাচ্ছেন।আপনি ইয়ারাবীর খালা বলে এতোক্ষনে ছেড়ে দিয়েছি।”
-“আহ্ আবরার তুমি বসো,দেখছো তো বাবা কথা বলছে।”
-“কিন্তু ভাবী”
-“আমি বলছি তো চুপ করো।”
মি.ফুয়াদ চুপচাপ বসে সব শুনছিলেন।ওনার ধারনা হচ্ছে ওনারা বিয়েটা ভেঙে দিবে।তাই কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না।মিসেস ইশানিও চুপ করে স্বামীর পাশে বসে আছে।ওনাদের চুপ থাকতে দেখে মি.রায়হান বলে,
-“কী ব্যাপার বেয়াই মশাই,আপনি মনে হয় আমার কথার মানে বুঝতে পারেননি।আমি এটাই বলতে চাইছি আমার ঘরের লক্ষীকে তাড়াতাড়ি ঘরে তুলতে চায়।”
-“কিন্তু স্যার?”
-“ওই মিয়া স্যার স্যার কী করছেন?বেয়াই বলেন”
-“জ্বি,কিন্তু আপনারাই তো বলেছিলেন ইয়ারাবীর এই এক্সামটা হয়ে যাক তারপর…”
-“আসলে কী বলুন তো আঙ্কেল, আমি চাইছিনা যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই সেখানে ইয়ারাবী থাক।আজ হাত কেটেছে কাল গলা কাটতে পারে।”
আবরারের মুখে এসব শুনে ওনাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়।আসলে আবরার যা বলেছে তা একদম ঠিক বলেছে।আজ ইয়ারাবী ভার্সিটি থেকে বাসায় আশার পর মিসেস জামান আসেন ইয়ারাবীর সেই ড্রেসটা নিয়ে।নিজের স্বাভাবিক নিয়মে ইয়ারাবী ড্রেসটা দেখতে গেলে ভিতরের পার্টের কিছুটা কাপড় কাটা পায়।এটা নিয়ে ওর মিসেস জামানের সাথে কথা কাটাকাটি হয়।মিসেস জামান যা নয় তাই শুনিয়ে যায়।এর মধ্যে নিকি এসে আরো আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।কথা কাটাকাটি এক পর্যায়ে মিসেস জামান ইয়ারাবীর দিকে টেবিলের পাশ থেকে একটা চাকু ছুড়ে মারে।একটুর জন্য ওইটা ওর পেটে না লেগে হাতে লেগেছে।ওখানে মিসেস ইশানিও ছিলো।উনিও ওনার বোনের রাগ নিজের মেয়ের উপর উঠান।বড় বোনকে কিছু না বলে নিজের মেয়েকে মারেন।ইয়ারাবী এক পর্যায়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।
কাল রাতে শুভ ওদের বাসায় থেকে যায়।এই কারনে এসব ঘটনা দেখে।বাসায় ব্যান্ডেজ শেষ হয়ে গেছে সেটা ও খুব ভালো জানে আর এটাও জানে ইয়ারাবী নিজের হাতে ব্যান্ডেজ করবেনা।তাই ও ফার্মেসীতে মেডিসিন নিতে যায়।আর সেখানে ভুল বসতো আবরারের সাথে দেখা হয়ে যায়।আবরার যখন জানতে চায় কী হয়েছে তখন শুভ সব সত্যিটা বলে দেয়।
মিসেস ইশানি বলে,
-“তুমি এসব কী বলছো আবরার,ওইটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র।তাছাড়া ইয়ারাবী রাজি না হলে কেউ পারবেনা ওকে মানাতে।”
-“ওটা দুর্ঘটনা নাকী অন্যকিছু দয়াকরে আমাকে শিখাতে আসবেন না আন্টি।আর ওকে মানানো আমার ব্যাপার।মম আমি ইয়ারাবীর সাথে দেখা করতে চায়।”
ও মায়ের কাছে কথাটা বলে কারোর কাছে আর কিছু শোনার প্রয়োজন বলে মনে করলোনা।সোজা উপরে গিয়ে ইয়ারাবীর রুমে নক করলো।ইয়ারাবী সচারচর রুম অন্ধকার করে বেশির ভাগ সময় বসে থাকে।সেটা ওর বাসার সবাই জানে।তাই আজও ভেবেছি মনে হয় বাসার কেউ এসে নক করছে।আসলে ওর জানেনা যে আবরাররা এসেছে।শব্দ শুনে ও ভিতরে আসতে বলে।আবরার ভিতরে ঢুকে খেয়াল করে দেখে রুমের লাইট বন্ধ করা।জানালার পর্দাগুলোও দেওয়া আছে।
আবরারয়ের পা হঠাৎ একটা টেবিলের সাথে বারি লেগে কিছু পরে যায়।ইয়ারাবী তাড়াতাড়ি লাইটটা জ্বালিয়ে দেখে আবরার দাঁড়িয়ে আছে।আবরারকে দেখে ও অনেকটা অবাক হয়ে যায়।তার থেকেও বেশি লজ্জা পায় নিজের জন্য।ও একটা প্লাজু আর গেন্জি পরে ছিলো,আর গলার স্কার্ফটা মেঝেতে ফেলে রেখেছিলো।ও জলদি করে চুলগুলো ঠিক করে মেঝে থেকে স্কার্ফটা তুলে নেয়।আবরার দু’হাত পকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে ওর পাগলামি দেখতে থাকে।তারপর ওর সামনে এসে বসে বলে,
-“তুমি এতটাও অগুছালো ভাবে নেই যে লজ্জা পেতে হবে।”
-“আপনি এখানে, এই সময় মানে ফোন …”
-“একচুয়ালি একটা সমস্যা হয়ে গেছে।আসলে পাপা আর মম চাচ্ছে যে বিয়েটা যেন এই মাসেই হয়।”
-“ক্ কী?কিন্তু কেন?আপনি তো বলেছিলেন ,আমার দু’মাস পর পরীক্ষা আছে আর এখন,,”
-“আই নো,তোমার ভালোর জন্য”
-“মানে?”
-“নাথিং,তবে তুমি আমার সাথে এগ্রি করবে এটাই আশা করি।”
ইয়ারাবী কিছু না বলে চুপ করে থাকে।জানে কিছু বলে লাভ নেই।আবরার খুব ঘাড় ত্যারা প্রকৃতির ছেলে।এই এক মাসে ও যতটুকু আবরারকে জানে তাতে ওর মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।আসলে ও সব কিছুর প্রতিবাদ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।তার আর কিছু না বলে চুপ করে আছে।আবরার ওর চুপ করে থাকা দেখে ওর হাত ধরে আর দেখে ওর খুব জ্বর এসেছে।ওর বুঝতে বাকী নেই কেন আসছে।তাই ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমি ও চাইতাম না এভাবে বিয়েটা তাড়াতাড়ি হোক।বাট্ আমি হেল্পলেস্।আমি চাই তুমিও রাজী হয়ে যায়।চলো,নিচে যেতে হবে।”
-“আপনার বাসা থেকে নিঃশ্চয় সবাই এসেছে।তাহলে আপনি যান আমি..”
-“যেমন আছো সেটাই অনেক।কিছু চেন্জ করতে হবেনা।চলো।”
ইয়ারাবী ওর কথা শুনে চুল বেধে চশমাটা পরে নিচে নেমে আসে।জারবা দেখে দৌঁড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“এ্যা লাস্ট তুমি আমাদের বাড়িতে যাচ্ছে।ইপি আমরা অনেক মজা করবো।”
মিসেস ইশানি মেয়েকে দেখে বলে,
-“এসব কী পরে এসেছো?এসব কেউ পরে।”
-“আহ্ ভাবী,রাগ কেন করছেন ও কী জানতো নাকী আমরা আসবো?তাছাড়া আম্মুকে ভালোই লাগছে।”
-“তো বেয়াই এক সপ্তাহ পর সামনের শুক্রবারে বিয়েটা ফাইনাল করি।কী বলেন আপনি?”
ইয়ারাবী আবরার দিকে তাকাই।মেঘ এটা দেখে একটা মিষ্টি মুখে পুরে বলে,
-“ও দিকে তাকিয়ে কোনো লাভ নাই।কারন এই বান্দার ইচ্ছাতেই হচ্ছে।”
-“কী হচ্ছে এখানে?”
দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে মিসেস জামান আর নিন্দু দাঁড়িয়ে আছে।ইশানি হাসি হাসি মুখে বলে,
-“আপু সামনের সপ্তাহে ইয়ারাবীর বিয়ে তাই।”
-“মানে ?কীসের বিয়ে,বলে বিয়েটা ভেঙে গেছে?”
-“কে বলেছে আপনাকে বিয়ে ভেঙে গেছে?”-মি.ফুয়াদ পাশ থেকে কথাটা বলে উঠে,
-“কেন নিকিতো আমাকে ফোনে বললো বিয়েটা ভেঙে যাচ্ছে।তাই এলাম যে…”
-“যে কী?”
-“না কিছুনা, ভালো কথাতো বিয়ে হচ্ছে।”
ইয়ারাবীর এদেরকে দেখার পর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে।কেননা এদের জন্য দুপুরে প্রায় মারা যাচ্ছিলো।আর ওকে মার পর্যন্ত খেতে হয়েছে ওনাদের জন্য।ও ওনাদের দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেই।বিয়ের পাকা কথা ঠিক করে ওনারা চলে যান।অনেক অনুরোধ করা হয়েছিলো ওনাদের ডিনার করার জন্য কিন্তু কাজের চাপে চলে যেতে হলো।যেহেতু বিয়ে তাই শপিং,গায়ে হলুদ,মেহেন্দি সব হবে।এজন্য রাতের থেকেই ওনারা তোরজোর শুরু করে দেয়।
(২১)
ওনারা চলে যাওয়ার পর ইয়ারাবী নিজের রুমে বসে আছে।ওর পাশে টিকলি আর ইয়ামিলা বসে নিজেদের মতো বকবক করেই যাচ্ছে।মিসেস ইশানির দুপুরের জন্য অপরাধ বোধ জন্মাচ্ছে।দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে পারছেনা ভিতরে যাবেন কীনা।উনি দরজার মুখ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় দেখেন নিন্দু ওর রুমের দিকে যাচ্ছে।
-“কীরে নিন্দু কোথায় যাচ্ছিস?”
-“এইতো ইয়ারাবীর রুমে যাচ্ছি।কথা বলবো,আপনিও আসেন।”
মিসেস ইশানি নিন্দুর স্বভাব খুব ভালো করে জানেন তাই উনিও যান সাথে।নিন্দু রুমে ঢুকে বলে,
-“ভাবতেই পারছিনা মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে।”
-“যখন ভাবতে পারছেন না তখন ভাবার দরকার নেই।”-পাশ থেকে ইয়ামিলা কথাটা বলে ।
-“হ্যাঁ,তাইতো।আপা সেদিন না ইয়ারাবী হলো,হাঁটা শিখলো।আপনার মনে আছে যখন গ্রামে যেতো তখন রাতে একদম থাকতো চাইতো না,কান্না করতো আর এক সপ্তাহ পর তার বিয়ে।”
-“মামী কথা না ঘুরিয়ে যা বলতে এসেছেন সেটা বললে খুব খুশি হবো।”
-“না মানে তোর তো বিয়ে হবে তাই বিয়ের পর শ্বশুড় বাড়িতে কী করতে হবে সেসব তো কিছুই জানিস না,তাই আরকী সেসব…”
-“শিখাতে আসলেন তাইতো..”
-“তোর তো বিয়ে তা নাকে নথ তো পড়তে হবে।তোর তো ফুটানো নাই।কাল সকালে পার্লারে যে ফুটিয়ে আসবি।”
-“সরি,এসব কিছুই করবোনা।”
-“কেন তুই জানিস না বিবাহিত মেয়েদের নাকে নোজ পিন পড়তে হয়।”
-“কেন?কোনো হাদিসে লিখা আছে নাকী?”
-“এটা স্বামীর চিহ্ন বুঝলি?”
-“এসব জাল হাদিস শুনাতে আসবেন না।আমার জানামতে ইসলামে চিহ্ন হিসাবে কোনো কিছু পরা নিষেধ আছে।আর হ্যাঁ,নোজ পিনের ব্যাপারটা আমি আগেই ক্লিয়ার করে নিয়েছি ওদের সাথে।তাই আপনাকে না ভাবলেও হবে।আর হ্যাঁ এখন যেতে পারেন।কেননা দুপুুরে যে কাহিনি করেছেন তারপরও আপনাদের মুখদর্শন করার নূন্যতম ইচ্ছাটুকু নেই।”
মিসেস নিন্দুর মুখটা শুকিয়ে একদম আমচুর হয়ে ছিলো।ভেবেছিলো এটা নিয়ে কিছু কথা শুনাবে তা আর হলোনা।কেননা ইয়ারাবীর কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে ওর সাথে এখন লাগা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা।মিসেস ইশানি মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে যান।এদিকে ইয়ারাবী নিজের কষ্টকে কমানোর জন্য কানে হেডফোন লাগিয়ে বেলকনিতে যেয়ে বসে থাকে।
(২২)
-“কীভাবে মা ?তুমি না বললে ওর বিয়ে ভেঙে যাবে তাহলে?”
-“ধর্মের কল বাতাসে নড়ে”-কথাটা ইতি বলে উঠে
-“ইতি তুমি কিছু না বললে খুশি হবো।আদিবা এখনো কিছু শেষ হয়ে যায়নি।চিন্তা করিস না আবরারকে তুই পাবি।”
-“কীভাবে?”
-“কাল ওরা বিয়ের শপিং এ যাবে।দেখ কাল ইয়ারাবীর সাথে কী হয়।তাছাড়া ওই কুদ্দুস নামের লোকটাও আমাদের সাহায্য করছে।তুই তোর মার উপর ভরসা রাখ।”
-“অন্যকে কাঁদালে একদিন নিজেকেও কাঁদতে হয় নন্দিনী।হয়তো আমার শ্বাশুরি আম্মা শিখাতে ভুলে গেছে।”
-“ভাবী আপনাকে কথা বলতে নিষেধ করেছিনা।”
-“কী করবো বলো?তোমাদের সু-কর্ম দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা।শুধু প্রশংসা করতে মন চায়।”
ইতি কথাটা বলেই মুচকি হেসে রুমে চলে আসে।তারপর ফোনটা বের করে কাকে যেনো কল করে।রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে,
-“পল্লবী,আমি ইতি বলছি,একটা দরকারে কল করেছি।”
-“ও ভাবী বলো কীভাবে হেল্প করবো?”
-“তোর কাছে ইয়ারাবীরর নাম্বার আছে।আসলে আমি হারিয়ে ফেলেছি তাই।”
-“তুমি না বাসাই।খালা আদিবা এদের কাছে তো আছে।”
-“জানি বিষয়টা খুব সিরিয়াস।আমি তোকে পরে বলবো।আমাকে এই নাম্বারে ম্যাসেজ করে দে।আর হ্যাঁ,কাউকে বলবিনা।”
-“ওকে ভাবী,কেউ জানবেনা।ডোন্ট ওরি।”
কিছুক্ষণের মধ্যে পল্লবী ইয়ারাবীর নাম্বার ম্যাসেজ করে দেয়।ইতি আর দেরি না করে ইয়ারাবীকে ফোন করে।ও চাইনা ওর পরিবারের বিরুদ্ধে কিছু করতে।কিন্তু অন্যায় যে করে আর সহে তারা সমান অপরাধী।কারোর ভালোর জন্য যদি ওকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে হয় তো যাবে।
ইয়ারাবী ডিনার করে এসে কেবল বিছানায় বসেছে তখনি ইতির কল আসে।ইয়ারাবী কলটা দেখে খুব অবাক হয়।কেননা ইতি প্রয়োজন ছাড়া ওকে কল দেয়না।আর এত রাতে কারো প্রয়োজন হতে পারে বলে ওর মনে হয়না।
-“আসসালামুআলাইকুম,ভাবী তুমি এই সময়ে,বাবু ঠিক আছে?”
-“বাবু ঠিক আছে কিন্তু ..”
-“কিন্তু কী ভাবী?”
-“ইয়ারাবী আমি চাইনা তোমার কোনো ক্ষতি হোক।তাই ফোনটা করেছি।”
-“ক্ষতি ..আমি তো কিছুই বুঝছিনা”
-“ইয়ারাবী আম্মা মানে তোর খালা তোকে মারার জন্য তাবিজ করছে…”
একে একে ইয়ারাবীকে সবটা খুলে বলে।ইয়ারাবীর তো মাথায় হাত, মানুষ কীভাবে পারে এটা করতে।
-“ভাবী চিন্তা করোনা,আমার কিছু হবেনা।আর হ্যাঁ,থ্যাংকস এটা জানানোর জন্য।”
-“তুই সাবধানে থাকিস ঠিক আছে।”
-“হামম,একটা কথা কী জানো রাখে আল্লাহ মারে কে?রাখি,আল্লাহ হাফেজ।”
ইয়ারাবী ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় বসে।ও জানে মিসেস জামান কারোর ছেলে মেয়েকে সহ্য করতে পারেনা।কিন্তু আদিবা ও কীভাবে পারে?নিজের বোনের উডবিকে নিজের করে নিতে।আবরারকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে।ইয়ারাবীর কাছে এসে যদি বলতো ওকে চায় তবে ও খুশি খুশি মনে দিয়ে দিতো।কেননা আদিবাকে নিজের বড় বোনের জায়গায় বসিয়েছিলো।কিন্তু সেই বোন আবরারকে পাওয়ার জন্য ওকে মারতে চাইছে।কথাগুলো ভাবতেই ওর কষ্ট হচ্ছে।আদিবা নিজেই ওকে সব সময় বলতো,”তুমি মেধাবী,সম্পুর্ন ব্যাতিক্রম,তোমাকে নিয়ে গর্ব করতে ইচ্ছা করে।”
আসলে আমাদের সমাজে কেউ কারো সুখ দেখতে পারেনা।নিজের পরিবারকে না সামলিয়ে অন্যদের পিছনে লাগতে বসে।আসলে জীবনের গল্পগুলো এক একভাবে থাকে কিন্তু চরিত্রগুলো বদলে যায়।আসলে দিন দিন সবার কাছে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।ইয়ারাবীর ধারনায় অতি শব্দটা খুব খারাপ।এটা মানুষকে কতটা নিচু পর্যায়ে নিয়ে যায় সেটা বোঝা দায়।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ইয়ারাবীর চোখ থেকে জল পরে।যদি এদের কথা বলার ক্ষমতা থাকতো তাহলে এরা বুঝিয়ে দিতো কতটা কষ্টে এরা ঝরে পরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here