জেদ” পর্ব-২৮

0
629

#জেদ(A Conditional LoveStory)
#পার্ট২৮
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
.
.
.
সংসার নারীদের জীবনের একটা অমোঘ সত্য।একবার সংসারের বাধাজালে আটকা পরলে সেখান থেকে মুক্তির উপায় হয়তো খুব কম নারীই জানেন।বেশির ভাগ মেয়ের জীবন কেটে যায় সংসারের ঘানি টানতে টানতে। নিজেকে নিয়ে ভাবার,নিজেকে ভালোবাসার সময় টুকু ফুরিয়ে যায় তাদের জীবন থেকে।আমার বেলায় হয়তো সেই নিয়মটাই প্রযোজ্য হচ্ছে।
আজকে আমার আর আরাজের বিয়ের ৩ মাস প্রায়।বিয়ের সপ্তাহ খানেক পরেই আরাজের বড় বোন মুনতাহা আপু তার শ্বশুর বাড়িতে চলে যান।নিশিতা আছে ভার্সিটিতে। মাস দুয়েক থেকে আরাজের মায়ের বুক ব্যাথাটা বেশ বেড়ে গিয়েছে।তাই সংসারের সবটুকুন দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার ঘাড়ে।রান্না থেকে শুরু করে ঘর মোছা পর্যন্ত আমাকেই দেখতে হয়। সুন্দর একটা সাজানো গোছানো সংসার।দম ফেলবার সময়টুকু যেন নেই।ঠিক এইটাই চাওয়া ছিল আমার বাবা মায়ের।।তাদের স্বপ্ন পূরন হয়েছে।হয়তো তাদের চেহারায় প্রশান্তির হাসি চওড়া হয়েছে।আর বেড়েছে আমার দীর্ঘ নিশ্বাসের স্থায়িত্ব।
মাস দুয়েক পার হয়ে যাচ্ছে।আরদ্ধর কোন খোজ নেই।ছেলেটা বেচে আছে কি মরে গেছে তাও জানি না।আরদ্ধর কথা ভাবলেই কেমন যেন দম বন্ধ লাগে নিজেকে।যে মানুষ্টার সাথে জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত কাটাব বলে ভেবেছিলাম সে মানুষটা আমার কাছ থেকে অনন্ত কালের জন্যে দূরে সরে গিয়েছে।
.
.
রান্নাঘর গুছিয়ে মাত্র রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি।শরীরটা বড্ড নিস্তেজ লাগছে৷চোখ বুঝে মাত্র ঘুমের সাগড়ে পারি জমিয়েছি তখনই কানের মধ্যে আওয়াজ ভেসে এল
-ইনায়াত…!কোথায় গেলে?একটু এদিকে এসো তো।আই ইনায়াত।
ও ঘর থেকে আরাজের মা ডাকছেন। আমি আধঘুম জড়ানো গলায় জবাব দিলাম
-আসছি।
রুম গিয়ে দরজা নক করতেই আরাজের মা বলে উঠলেন
-পা দুটো বড্ড ব্যাথা করছে ইনায়াত। একটু চেপে দেওনা।
মাথার বাম পাশটা প্রচন্ড কিনকিন ব্যাথা করছে। ঠিকভাবে চোখ খুলতে পারছিনা। যেকোন মুহুর্তেই বমি করে ভাসিয়ে দিতে পারি। আমি কোন রকমে নিজেকে সামলে বললাম
-আন্টি আমি পারব না এখন।আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।
কথাটা বলেই রুমে চলে আসলাম।পেট গোলাচ্ছে প্রচন্ড ভাবে।কোনরকমে বাথরুমে পৌছে পেটে যা ছিল সব উগলে দিলাম।মাথাটা পুরাই ফাকা ফাকা লাগছে।মুখে পানি ছিটিয়ে রুমে এসে বিছানায় লুটিয়ে পরলাম।
চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে।নিজেকে ধরে রাখতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে হারিয়ে গেলাম ঘুমের অতল সমুদ্রে।
.
.
গভীর একটা জংগলের মাঝামাঝি জায়গায় বসে আছি আমি।চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।দূরে কোথাও শেয়াল কুকুরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।আমি একমগ্নে সামনের পানে তাকিয়ে আছি।ছোট একটা ঝিল।ঝিলের কালো পানিতে জোছনার আলো পরে চকচক করছে।চারদিকে পাতার খসখস শব্দ হচ্ছে।ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে সে শব্দ।কিছুক্ষনের মধ্যেই হাত দশেক দূরে জ্বলজ্বল করে উঠল বেশ কতগুলো লাল চোখ।ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বুনো নেকড়ের দল।টপ টপ করে লালা ঝরছে তাদের জ্বিহ্বা বেয়ে।দু একজন ইতিমধ্যেই এগিয়ে এসেছে আমার কাছে।আচড় বসিয়েছে আমার দু হাতে বাহুতে।আমি যেন তবুও নিস্তেজ ভাবে বসে আছি।নড়ার শক্তি টুকু নেই। একে একে সবাই এসে ঘিরে ধরল আমাকে। ছিড়ে খেতে লাগল আমাকে।বোধোদয় হতে শুরু করল আমার।এতক্ষন শান্ত থাকলেও হঠাত করে তীব্র ভয় গ্রাস করে নিল আমাকে।আমি চারদিক তাকিয়ে গগন বিদারী একটা চিতকার দিলাম।
মুহুর্তেই সবাই যেন সরে গেল দূরে।দূর থেকে ক্ষীন একটা আলো এসে চোখে লাগল।ধীরে ধীরে আলোটা এগিয়ে আসছে আমার কাছে।আরও কিছু টা আগাতেই সব কিছু যেন স্পষ্ট হয়ে এল।আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আরদ্ধর মায়াবী মুখটা। আমার কাছে এসেই একটা ভুবন ভুলানো হাসি দিল সে।আরদ্ধর হাসির পানে চেয়ে আমি সব কষ্ট ভুলে গেলাম।আরদ্ধ আলতো করে এসে আমার গাল ছুয়ে দিল। ঠোটে ঠোট ডুবিয়ে চুমু একে দিল।আমি চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে অনুভব কর‍তে লাগলাম তাকে।আরদ্ধ আমাকে দুহাতে আমাকে আগলে নিল। পরম যত্নে আমার মাথাটা গুজে নিল তার বুকের মধ্যে।আমি পরম শান্তিতে বুক ভরে দম নিলাম।ঠিক তখনি একটা হিংস্র আওয়াজ শুনে বুক কেপে উঠল।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি একটা বড় মাপের নেকড়ে দাত বের করে তাকিয়ে আছে আরদ্ধের দিকে।অন্যগুলোর তুলনায় তার চোখ যেন বেশি লাল আর বেশি উজ্জ্বল।ভয়ে কাপছি আমি। আমাকে কাপতে দেখে আরদ্ধ ফিরে তাকাল।ঠিক তখনি একটা হিংস্র থাবা বসালো নেকড়েটা। আতকে উঠলাম আমি।ঘুম ভেংগে গেল একটা চিতকার দিয়ে।
.
.
চোখ খুলে দেখি বিছানায় বসে আছি আমি। দরদর করে ঘামছে পুরো শরীর।মাথাটা এখনো ভারী হয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ১০ টা বাজে।পুরোটা সন্ধ্যা আমি মরার মত পরে ছিলাম।বিছানা থেকে নামতে যাব তখনি ওয়াশরুম থেকে আরাজ বের হল।
আরাজ আমাকে কোন কথা না বলে ল্যাপটপ নিয়ে বসল।আমি ফ্রেশ হয়ে চুলগুলো খোপায় গুজে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াব তখনি আরাজ বলে উঠল
-আমরা খেয়ে এসেছি বাইরে থেকে।রান্না করার দরকার নেই।
আমি পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলাম
– আংকেল আন্টি?
-তুমি ঘুমাচ্ছিলেন।রান্না করনি৷ বাবা মায়ের সুগার লো হয়ে গিয়েছিল তাই আমি উনাদেরকে নিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।ওহ আচ্ছা।
আরাজের কথা শুনে আমি চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসলাম।আরাজ কিছুক্ষন থেমে বলে উঠল
-মা নাকি তোমার কাছে মেডিসিন চেয়েছিল তুমি দেওনি।
আরাজের কথা শুনে চমকে উঠলাম আমি।বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-মেডিসিন? কখন?
আরাজ হালকা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল
-আজকে দুপুরে।
আমি দ্বিতীয়বার অবাক হয়ে বললাম
-দুপুরে?না তো। দুপুরে তো উনি পা টিপে চেয়েছিলেন। আমার প্রচন্ড মাথাব্যথা করছিল।তাই বলেছিলাম যে এখন পারব না পরে দিব।
-ইনা মিথ্যা কথা বলার দরকার নাই কোন।
-আজব তো আমি মিথ্যা কথা বলব কেন!
-তো তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমার মা মিথ্যা কথা বলতেছে?জাস্ট একটা মেডিসিন এ তো চেয়েছিল ইনা।কি এমন কাজে ব্যস্ত ছিলে যে আমার মাকে ওষুধ পর্যন্ত দেওয়ার সময় টুকু হয় নি তোমার!
-আজব আরাজ আমি….
-প্লিজ ইনায়াত।আমাদের মধ্যে কি আছে নেই সেটা অন্য হিসেব। বাট এসবের মধ্যে আমার প্যারেন্টস কে টানবা না নাহলে এর পরিনতি ভালো হবে না।
কথাটা বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেল আরাজ। আমাকে কথা বলার সুযোগ টুকু দিল না।আমার অস্বীকার করার পরেও আরাজ আমার একটা কথাও শুনার প্রয়োজন বোধ করল না।এটা প্রথম বার নয়।আরাজের মা আর বোন আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না।কেন করেনা কে জানে!হয়তো আমার আর আরদ্ধের সম্পর্কের জন্যে।হয়তো বা অন্যকোন কারনে।আমার সব কিছুই যেন তাদের অপছন্দের।আমার হাটা-চলা,উঠা-বসা এমনকি খাওয়াতেও সমস্যা তাদের।আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ দেয় না তারা।আমার অস্তিত্বই যেন তাদের কাছে অপছন্দের।মাকে ফোন দিয়ে বার দুয়েক জানিয়েছিলাম সব।কিন্তু বরাবরের মত তার একটাই জবাব
-সংসারে ওসব মানিয়ে নিতে হবে একটু আধটু।শ্বশুর বাড়িতে এসব হয়ই।স্বামির মন যুগিয়ে চল তাইলেই দেখবি সব ঠিক থাকবে।
মায়ের কথার কোন জবাব থাকেনা আমার কাছে।শুধু ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ফোন কেটে দেই আমি।
.
.
আরাজের বড় বোন মুনতাহা আপু প্রেগন্যান্ট।৫মাস চলছে প্রায়।আরাজের ফ্যামিলি থেকে স্বাদ খাওয়ানোর আয়োজন করা হয়েছে।রান্নাবান্নার দায়িত্ব এসে পরেছে আমার ঘাড়ে।মুরগীর রোস্ট,মাছের ভাজি,পোলাও,গরুর মাংসের কালা ভুনা,সালাদ,বোরহানি,রেজালা,ইলিশ মাছের মুড়ি ঘন্ট আরও দুই তিন রকমের আইটেম।আরাজকে বলেছিলাম যেন অর্ধেক খাবার বাইরে থেকে অর্ডার দেয়। কিন্তু আরাজের মা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন
-তার বড় মেয়ে যা খেতে চেয়েছে সব যেন বাসায় বানানো হয় ।বাইরের খাবার খেলে বাচ্চার ক্ষতি হবে ।
অগ্যতা সব কাজ আমাকে নিজে হাতেই করতে হল।মুনতাহা আপুর শ্বশুর বাড়ির লোকজন আরাজের কিছু ফ্রেন্ড আর আমার বাবা মাকে লাঞ্চে ইনভাইট করা হয়েছে।আরাজের ফ্যামিলির ইচ্ছা ছিল বড় করে পার্টি করার কিন্তু লকডাউনের জন্যে আপাতত তা সম্ভব হচ্ছে না ।সব পরিকল্পনা তাই আকিকার জন্যে বরাদ্দ করা হচ্ছে।
রান্নাবানা শেষ করে আমি ঘরে এলাম ফ্রেশ হবার জন্যে ।তখনি আরাজ এসে ডাক দিল।ইনায়াত সবাই চলে এসেছে।
-দুই মিনিট ।আমি ফ্রশ হয়ে আসছি।
আমি হাত মুখ ধুয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম।ড্রয়িং রুমে এসে দেখ বাবা আরাজের বাবার সাথে গল্প করছেন ।পাশে মা বসে আছেন।অনেক দিন বাবা মাকে দেখে বেশ খুশি লাগছে।মনটা যেন শান্ত হয়ে গেল তাদেরকে দেখে।কথা বলতে যাব তখনি আরাজের মা বলে উঠলেন
-ইনায়াত সবাই বসে আছে।যাও টেবিল রেডি কর।সবাই অপেক্ষা করছে।
আমি মায়ের দিকে তাকাতেই উনি আমাকে ইশারা করে বললেন যেতে ।আমি বাধ্য হয়ে সেখান থেকে চলে এলাম।………
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here