টক ঝাল মিষ্টি – পর্ব ৮

0
1003

#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ৮.২)
নুসরাত জাহান লিজা

শফিক আঙ্কেল যাবার পর থেকেই লাবণ্য রান্নায় ঝালের পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়েছে, অনিকেত যতটা খায় ততটা নয় যদিও, তবে লাবণ্যর সহনশীলতার মধ্যে যতটুকু সম্ভব ততটুকু পরিমান। কিন্তু অনিকেত এমন বুদ্ধু, বিষয়টা গত তিন সপ্তাহেও ধরতে পারেনি! লাবণ্য ঠিক করেছে বন্ধুত্ব যেহেতু হয়েই গেছে তাহলে শত্রুতা জিইয়ে রেখে আর লাভ নেই৷ সমোঝতা স্মারকে স্বাক্ষর করে একটা পারিবারিক শান্তিচুক্তি করার সময় চলে এসেছে।

বসে বসে সে এই চুক্তির আওতায় কোন বিষয়গুলো আসতে পারে সেটার একটা তালিকা করতে শুরু করল। ‘নেই কাজ তো খৈ ভাজ’ কথাটা মনে পড়ল লিখতে লিখতে৷ আসলে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও দিনের বেশিরভাগ সময় বাসায় একা একা থাকা খুব কষ্টের। রান্না, ফেসবুকিং, নেটফ্লিক্সের নতুন মুভি আর সিরিজগুলো দেখা, মাঝেমধ্যে গল্পের বই পড়া সাথে জব এক্সামের পড়াশোনা করে অনেকসময় একঘেয়েমি চলে আসে। ধরাবাঁধা জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্যই মূলত শান্তিচুক্তির তালিকা তৈরি করতে বসা।

তালিকার শুরুতেই জায়গা করে নিল, ‘ঝাল খাবার পরিমাণ একজনকে কিঞ্চিৎ কমাতে হবে, অপরজনকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ বাড়াতে হবে।’

এরপর দুই নাম্বার দিয়ে লিখল, ‘বাসের জায়গা যেহেতু ছেড়ে দিচ্ছি, তাই শোবার জায়গায় কোনো স্যাক্রিফাইস হবে না। বাস আর বিছানা মিলিয়ে কাটাকুটি। ভেব না তুমি ঠকেছ, আমার কিন্তু তোমার নাক ডাকা সহ্য করতে হচ্ছে। তাই হিসেব বরাবর।’

‘বাসায় ঢুকে যার যার জিনিসপত্র সে গুছিয়ে রাখবে। একান্ত প্রয়োজনীয় হলে বা সাহায্য লাগলে সেটা অন্য ব্যাপার।’

‘একজন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলে অন্যজন অবশ্যই বিরক্ত করবে না। উদাহরণস্বরূপ, পড়তে বসলে বা ঘুমালে টিভির ভলিউম বাড়ানো নিষেধ।’

‘এই বাসা বর্তমানে নো স্মোকিং জোন। সিগারেট ধরানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এই দণ্ডনীয় অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করবেন স্বয়ং অভিভাবকগণ।’ এটা লিখে লাল সাইনপেন দিয়ে মার্ক করে দিল৷ অর্থাৎ এটা কোনোমতেই শিথিল যোগ্য নয়।

‘অকারণে কেউ কারোর পেছনে লাগব না। এক্ষেত্রে দুই পক্ষকেই সচেষ্ট থাকতে হবে।’

‘একদিন মশারী টাঙানো হবে, আরেকদিন কয়েল ধরানো হবে। এক্ষেত্রে দু’জনকেই কিছু জিনিস ছাড় দিতে হবে।’

‘বন্ধুত্বকে পরের ধাপে উন্নীতকরণের চেষ্টা করা।সারাজীবনের জন্য যেহেতু একসাথে জুড়ে গিয়েছি, এই বিষয়টা এখন ভাবার সময় এসেছে বোধহয়৷’

লাবণ্য এই পয়েন্টটা লিখতে গিয়ে সলজ্জ হলো, রক্তিম আভা ফুটে উঠল মুখে। সে বরাবরই ডাকাবুকা স্বভাবের মেয়ে, তার জন্য এই লজ্জা লজ্জা অনুভূতি পুরোপুরি নতুন। অনায়াসে যেকোনো কথা মুখের উপরে বলে দেওয়া যতটা সহজ, নতুন এই অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো তার জন্য কঠিন, ভয়ংকর কঠিন!

শাশুড়ি ফোন করলেই বারবার বলেন, “এবার তোরা দুইটা একটু সুবোধ হ তো। তবে আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হই।”

লাবণ্য তার কথা নিয়ে কয়েকদিন ধরেই ভাবছিল, পরে মনে হলো, তিনি তো ঠিকই বলেছেন। সম্পর্ক তো এমনই তো হওয়া উচিত।

আগের পয়েন্টগুলো লিখতে লিখতে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কী সব বোকা বোকা কথাবার্তা লিখছে! অবশ্য যেই সুন্দর গাধাটাকে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে তাকে এভাবে না বললে তার মোটা মাথা ভেদ করে মগজ অবধি কথারা পৌঁছুবে না। এই লোক ‘ন’ বললে ‘নিরানব্বই’ বুঝবে, কিন্তু ‘ন’ তে তো ‘নয়’ হয়, নব্বই’ও হয়, এটা তার মাথায় ঢুকে না। ঠিকই বেশি বেশি বুঝবে, কিন্তু যা বোঝার সেটা বুঝবে না। তাই এসব বোকাবোকা কথাবার্তা লিখতে হয়েছে।

হো হো করা হাসির মুহূর্ত আর কিছু সলজ্জ অনুভূতিকে সঙ্গী করে সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম সাংসারিক চুক্তিপত্র লেখা শেষ হলো। নিচে সিগনেচার করল, আরেকপাশে অনিকেতের জন্য জায়গা রাখল। পরে মনে পড়লে যেন আরও কিছু যুক্ত করা যায়, তাই মাঝের জায়গাটা ফাঁকা রইল।

এটা সে এখন কোনোভাবেই অনিকেতকে দিতে পারবে না, শেষ পয়েন্টটা এত সহজে বলা যায় না। আরও কিছুদিন যাক, সম্পর্কটা আরেকটু সহজ হোক, তখন এটা হাতে ধরিয়ে দেবে। অদ্ভুত পাগলাটে ছেলেটা ওর এই অনুভূতির মূল্য দিতে পারবে তো! কিছুটা যেন শঙ্কা জমা হলো লাবণ্যর হৃদয়ে!

***
চুক্তিপত্র লেখার আরও সপ্তাহখানেক পরের এক সকালে বান্ধবী নিশি ফোন করে ওর বাসায় যেতে বলল। বেচারি প্রেগন্যান্ট, ওর হাজব্যান্ড অফিসে থাকে এই সময়। সে নাকি ইদানিং কী সব দুঃস্বপ্ন দেখছে, তাই উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় চেপে বসেছে। ওর মা এসে সাথে থাকছে, তবুও লাবণ্যকে বলেছে, “তোর বাসা তো খুব বেশি দূরে না। আজ একটু আয় প্লিজ। তোরও ভালো লাগবে। যদি মরে টরে যাই আর দেখা হবে না।”

মেয়েটা এমনভাবে বলল, লাবণ্য আর না করতে পারল না। তৈরি হয়ে বের হওয়ার সময় দেখল অনিকেত আজ বাসার চাবিটা নিতে ভুলে গেছে, কিংবা লাবণ্য বাসাতেই থাকে বলে ইচ্ছে করেই নেয়নি। সে অনিকেতকে কল দিল, কিন্তু ফোন বন্ধ। ভাবল এখন বের হলে অনিকেত ফেরার আগে আগেই সে ফিরতে পারবে। তাই আর কিছু না ভেবে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল।

***
অনিকেত ফিরল কাক ভেজা হয়ে। দুপুর থেকেই কেমন ফ্যাসফ্যাসে বৃষ্টি পড়ছে, খুব ঝড়ো কিছু নয়, কিন্তু পানিটা হিমশীতল। অসময়ের বৃষ্টি বলে ছাতা নেওয়া হয়নি। বাসায় এসে দেখল তালা দেওয়া, ফোনটায় চার্জ নেই, বন্ধ হয়ে গেছে। রাতে চার্জ দেয়নি, সকালেও তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে। অফিসে আজ এত ব্যস্ত ছিল যে চার্জ দেবার কথা মাথায়ই আসেনি। দশ মিনিট দরজার বাইরে অপেক্ষা করে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো। বৃষ্টির মধ্যেই পাঁচ মিনিট হেঁটে গিয়ে রহিম চাচার চায়ের দোকানে বসল। সেখানে বসে চা খেয়ে, কিছুক্ষণ এটা-সেটা গল্প করে পয়তাল্লিশ মিনিট পরে আবার বাসায় চলে এলো। ঘড়িতে তখন পৌনে ছ’টা বাজে।

একটুতেই ঠান্ডা ওকে কাবু করে ফেলতে পারে, আজ তো বেশ কয়েকবার ভিজেছে। নাক দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে এরইমধ্যে। কাশি তো আছেই।

হুট করে পুরোনো অভিমানটা তীব্র রাগ হয়ে মাথায় ভর করল। লাবণ্য ওকে ছিটেফোঁটা মূল্যও দেয় না। পাঁচটায় তার অফিস ছুটি হয়, আজ শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল বলে হাতের কাজ শেষ করে আধাঘন্টা আগে বেরিয়েছিল।

অপেক্ষা করতে করতে শাহেদের মন্ত্রণা ওর মাথায় চেপে বসল। লাবণ্য ওর কাছ থেকে সেদিন সুযোগ সন্ধানী বলার প্রতিশোধই নিচ্ছে তাহলে! একটা অন্ধ রাগ মাথায় চেপে বসল, ঠিক-ভুলের বিবেচনাবোধ ভাসিয়ে সে প্রবল আক্রোশে ভেসে গেল।

প্রতিজ্ঞা করল, লাবণ্য ফিরুক, একটা এসপার-ওসপার আজই করতে হবে! এভাবে আর সহ্য করা যায় না, কিছুতেই নয়! বন্ধুত্ব করে সে অনিকেতের মাথা কিনে নেয়নি, অনিকেতের মাথা অমূল্য, কয়টা মাত্র মিষ্টি কথাতে তা বিক্রিযোগ্য নয়!
…….
(ক্রমশ)
(শেষের পথে গল্পটা, আর তিনটা পর্ব আসবে ইনশাআল্লাহ। একদিন বিরতিতে আসবে বাকি পর্বগুলো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here