টক ঝাল মিষ্টি – পর্ব ৮

0
953

#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ৮.১)
নুসরাত জাহান লিজা

“এইটা তুই কী বললি, অনি? তুই পুরুষ মানুষ না? তাইলে বউয়ের কাছে মাফ চাইলি কেমনে! তোর লজ্জা করল না? মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবি তা না, কয়দিন পরে তো বউয়ের পায়ে ধরে বসে থাকবি।”

শাহেদ যারপরনাই নাখোশ হলো অনিকেতের উপরে। সে অনিকেতের বন্ধু, সাথে কলিগও। অফিসে বিয়ের পর থেকে ঘটা ঘটনাগুলো বন্ধুর সাথে মাঝেমধ্যেই শেয়ার করত। আজও সেদিনের রাগারাগি, অবশেষে ভাব হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা বলেছিল, তাতেই শাহেদ টিপ্পনী কাটল বন্ধুকে।

“ধূর! কী বলিস এসব! দুই দিন থেকে তো খুব ভালো চলছে সব। লাবণ্য একটু বদমেজাজি কিন্তু মন থেকে তো ভালোই মনে হলো। এখন আর আগের মতো তেড়েফুঁড়ে চড়াও হয় না, পিছেও লাগে না।” শাহেদের কথায় একমত হতে পারে না অনিকেত।

“সব তোর বউয়ের গুটিবাজি। বুঝলি? মেয়েদের এসব তুই বুঝবি না, দোস্ত৷ এরা এভাবে টুপ ফেলে, দেখায় যে সব ঠিক আছে৷ যখনই তুই টুপ গিলবি মানে ভাব করবি আরকি, তখনই দেখবি কেমন করে ছিপ ধরে টান দেয়। তখন বন্ধু না পারবা গিলতে না পারবা ফেলতে। সারাজীবন ওই ছিপ যেদিকে তোরে নিয়ে যাবে তোর সেদিকেই দৌড় দেয়া লাগবে!”

অনিকেতের বিভ্রান্তি বাড়িয়ে আবার বলল, “সময় থাকতে সাবধান হ। তোর সাথে কী কী করেছে, সেটা দুইটা মিষ্টি মিষ্টি কথাতেই ভুলে গেছিস! আর আমারটারে দেখ, এমন ঝাড়ির উপরে রাখি যে যেকোনো সিদ্ধান্ত আমার পারমিশন ছাড়া নেয় না। এমনকি একটা কাপড় কেনার আগেও জিজ্ঞেস করে কোনটা কিনবে। কিন্তু তুই আমাকে হতাশ করলি দোস্ত। এমন ভেড়ুয়া হোস না এই বললাম। পরে পস্তাবি।”

“না রে, তুই দেখিস এমন কিছু হবে না। আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং গ্রো করছে কেবল, দু’জন যদি একে অপরকে বুঝতে পারি, তাহলে আর সমস্যা কী? একসাথে থাকব যেহেতু, বন্ধুর মতো থাকাই তো উচিত।”

“আমার বলার কথা তাই বললাম। তুই আমার বন্ধু৷ এইটুকু দায়িত্ব থেকে বললাম। মানা না মানা তোর ব্যাপার। তবে পরে আবার বলিস না যে সাবধান করিনি।”

অনিকেত প্রথমদিকে শাহেদের কথায় তেমন গুরুত্ব দিল না। লাবণ্যর সাথে সময়টা ভালো কাটছে, নতুন তৈরি হওয়া বন্ধুত্ব কেমন ফুরফুরে একটা বিশুদ্ধ অনুভূতি মনে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েটাকে প্রথমদিকে যতটা অসহ্য লাগত, এখন সেই তিক্ততা একদম নেই। তবে মেয়েটা ভীষণ ঠোঁটকাটা, মুখের উপরে অপ্রিয় কথা বলতে দ্বিধা করে না। অনিকেতও নিজে থেকেই টুকিটাকি জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে, এখন সেটা করতে খারাপও লাগে না আগের মতো। তবুও মাঝেমধ্যে খটমট লেগে যায়, আবার মুহূর্ত কয়েক পরে ভাবও হয়ে যায়। স্কুল, কলেজের স্মরণীয় স্মৃতি, প্রিয়-অপ্রিয় জিনিসপত্র এসব শেয়ার করা হয়ে গেছে। একে অন্যের অপছন্দের কাজগুলো সচরাচর এড়িয়ে যাচ্ছে। নতুন মানুষকে ভালোভাবে জানার প্রগাঢ় আগ্রহ জন্মেছে। টোনাটুনির সংসারে অচেনাকে চিনে নেবার প্রক্রিয়া সুন্দরভাবে চলমান রইল কিছুদিন।

এরমধ্যে লাবণ্য একদিন হলে গেল ওর জিনিসপত্র আনতে। কিন্তু কিছুতেই অনিকেতকে সাথে নিতে রাজি হচ্ছিল না। শেষে যেচেপড়ে অনিকেত নিজেই জোর করে ওর সিএনজিতে চেপে বসল। লাবণ্যকে হল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সে অফিসে যাবার আগে বলল,
“তোমার গোছগাছ শেষ হলে আমাকে একটা ফোন কোরো। আমি অফিস থেকে আজ একটু আগে আগে ছুটি নিয়ে চলে আসব।”

অফিসে গিয়ে আগে আধা বেলা ছুটির বন্দোবস্ত করল, এরপর কাজে মন দিল। কিন্তু প্রায় সাড়ে ঘণ্টা পেরিয়ে যাবার পরেও লাবণ্যর কল এলো না, তখন নিজেই কল করল। লাবণ্য কল ধরে বলল,

“অনিকেত, আমি বাসার দিকে রওনা দিয়েছি। তুমি যদি আসতে চাও তাহলে বাসায় চলে এসো।”

অনিকেত ফোন রেখে বেরোবার আগে পাশের ডেস্ক থেকে শাহেদ এসে বলল,
“কী হলো তোর? মুখ তিতা করে রাখছিস কেন?”

অনিকেত সব খুলে বলতেই শাহেদ বলল, “দেখছিস তুই? আসলে ওই মেয়ে তোরে পাত্তাই দেয় না। আমার কথায় তো বিরক্তি হইলি। দেখিস আরও কী কী হয়!”

অনিকেত কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল। আসলেই কী এমন কিছু! লাবণ্য তো ওকে একবার জানাতে পারত, সে নিজে ফোন না করলে লাবণ্য হয়তো ওকে এখন বাসায়ও যেতে বলত না। অথচ অনিকেত একটু একটু করে লাবণ্যকে নিজের জীবনের একটা অংশ ভাবতে শুরু করেছিল। হুট করে নিজেকে কেমন অবাঞ্চিত মনে হলো! একটু অভিমানও হলো বুঝি!

বাসায় এসে দেখল লাবণ্যর জিনিসপত্র বহনকারী গাড়িটা এসে দাঁড়িয়ে আছে, লাবণ্য ব্যস্ত ভঙ্গিতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। ড্রাইভারকে কিছু একটা বলছিল, তখন অনিকেতকে খেয়াল করে এগিয়ে এলো।

“রূম্পা আজ হলেই ছিল, একটা ইন্টারভিউ দিতে এসে হলে উঠেছে। আজ চলে যাবে, আমাকে দেখে সেই সব ঠিকঠাক করে দিল। তাই তোমাকে আর বিরক্ত করিনি। শুধু শুধু ছুটি নিতে গেলে।”

“আমি ছুটিটা আগেই নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমার হয়তো আমাকে প্রয়োজন হবে। এখন দেখলাম তুমি নিজেই সব করতে পারো।”

অনিকেতের গলার অভিমানী সুরটা লাবণ্য বুঝতে পারেনি বলেই মনে হলো, হেসে হেসে বলল,
“এই মামা বললেন, কয়টা আর জিনিস, একটু কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলে তিনিই ভেতরে দিয়ে আসতে পারবেন।”

অনিকেত ভালো করে তাকিয়ে দেখল তোশক, কম্বল, দুটো বড় বস্তা, তাতে মনে হয় বইপত্র। আরেকটা চটের বস্তায় হাঁড়ি-পাতিল, অন্যান্য কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র মনে হয়। বড় একটা লাগেজ, এগুলোই। সেই লোকটাই সব নামিয়ে ঘরে দিয়ে গেলেন।

ভাড়াটাও লাবণ্যই দিল, এটা নিয়েও অনিকেতের মন খারাপ হলো। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারল না। আগে হলে অনায়াসে বলে ফেলত, এখন কোথা থেকে একগাদা সংকোচ এসে জমা হয়েছে। সে কী বদলে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে! লাবণ্য কী মনে করবে সেটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে? এভাবেই কী একটু একটু করে হৃদয়ে নতুন অনুভূতি তৈরি হয়! একটা চাপা অভিমানী দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে অনিকেতও সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে ভেতরে গেল।
………
(ক্রমশ)
(আজ ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম, লিখতেই পারিনি সেভাবে। তবুও আপনাদের কথা দেওয়া ছিল বলে ছোট্ট করে হলেও একটা পর্বের অর্ধেক দিলাম। এই পর্বের পরবর্তী অংশ আগামীকাল দেব ইনশাআল্লাহ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here