সময় কখনো বেইমানি করে না। গত দুমাস আগে হৃদের সাথে আমার তিন বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক ইতিতে পদার্পণ করে।আর আজ! বিয়ে হলো সেই প্রাক্তনের আপন ছোট ভাইয়ের সাথে। আজ যে আমার বিয়ে হবে তা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। এইচএসসি পরীক্ষা তো শূন্যে ঝুলে আছে। এসএসসি শেষ না হলে আমাদের পরীক্ষার হদিস পাওয়া যাবে না। এ এক বিড়াট দুঃখের সাগরে নাকানিচুবানি খাচ্ছি আমরা। সকালে রুহি ফোনে ডাক দিয়ে হুকুম করলো চৌরাস্তার মোড়ে যেতে। ঘুমঘুম চোখে শরীরটা ঠেলেঠুলে নিয়ে উপস্থিত হলাম। যেহেতু শুক্রবার ছিল তাই এতটা তাড়া ছিল না বাসায় ফেরার। কিন্তু কে জানতো? এ বাসা চিরতরে পর করার জন্যই এই শুক্রবার নির্ধারিত। হৈ হুল্লোড় আর মজা আনন্দে মেতে বাসায় আসতে বিকাল চারটা বেজে গেলো। মাঝে স্যারের প্রাইভের টাকা মেরে রেস্টুরেন্টে আর রিক্সার জমজমাট তুফান তুলেছিলাম তিন বান্ধবী। এই আঠারো বছরের জীবনে এ আনন্দ ছিল অগ্রগণ্য। আর আজ বিকেলেই হয়েছে আবার অগ্রগণ্য দুঃখ।
— নেমে পরুন বাসায় এসে গেছি।
সদ্য জুড়ে যাওয়া আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য মানুষটার কন্ঠ। ভাবনায় আমার ছেদ পরলো। অবুঝের মতো চোখ ঘুরিয়ে তাকে দেখলাম। সুন্দর! দুই ভাইয়ের মাঝে রূপগত মিল নেই বললেই চলে। আমার স্বামী নীরবের ঝাকড়া এক গুচ্ছ চুল। হৃদের হলো সিল্ক চুল। গাড়ের রংয়ে বেশি সুন্দর হৃদ। দু’জনেই নজর কাড়া।
— কি হলো নামো?
সামনে বসা হৃদের কন্ঠস্বর কানে এলো। পাশ ফিরে দেখি নীরব গাড়ি থেকে নেমে গেছে। আমি ধীর গতিতে শাড়ি গুছিয়ে নামার জন্য প্রস্তুত হতেই আকস্মিক টান পরলো হাতে। হৃদ হাত টেনে ধরেছে। বুকটা নেড়ে উঠলো আমার। শঙ্কা মনে লুকিয়ে কড়া চোখে তাকিয়ে বললাম
— হাত ছাড়ুন ভাইয়া।
— তুই কিন্তু ভালো করলি না কাজটা। ইচ্ছে করেই বিয়ে করলি তাই না?
প্রাক্তন প্রেমিকের জ্বালাপোড়া দেখে ভীষণ আনন্দ হলো বুকে। ফিসফিস করে তার কানে বলে দিলাম
— ইয়েস,. ইট’স নেম টিট ফর ট্যাট।
.
সাজানো গাড়ি থেকে নেমে দাড়িয়ে আছি গাড়ির কাছেই। ছোট খাটো ভিড় জমেছে আমাকে নিয়ে। ঘরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না আমাকে। শাশুড়ী মা আসবে তারপর তিনি আমায় ঘরে নিয়ে যাবেন। সব আম্মাদের ভিড়ে আটকা পরেছে হৃদও। মুখে তীব্র বিরক্তি তার। বোঝা যাচ্ছে বুক জ্বলে হয়তো কয়লা হচ্ছে। আমার খুব শান্তি লাগছে। তুই আমার শুদ্ধ ভালোবাসার সঠিক কদর করতে পারিসনি। আমার কিশরী বয়সের আবেগ, ভালোবাসা সবটা তোকে দলিল করে দিয়েও আমি কি পেয়েছি? ধোকা! বেইমানির ছঁটা। আজ ইচ্ছে করেই আমি তোর বাড়িতে এসেছি। সন্ধ্যায় বাসায় এসে যখন দেখি আমার বিয়ের তোড়জোড়। মা বাবার সাথে অনেক চিল্লিয়েছি। আমার দুদিন পর এইচএসসি আর আমি বিয়ের কনে সেজে রং ঢং করে শশুর বাড়ি চলে যাবো? বিয়ে করার এতো তাড়া আমার ছিল না। স্বপ্ন আমার আকাশ ছোঁয়া। যে যাই বলুক, বিয়ের পর যে ভালো পড়ালেখা হয় এটা আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। কিন্তু সেই আমিই বিয়ে করলাম। কারণ একটাই! আমার মন পুড়িয়েছে যে আমি তাকে পুড়িয়েই ছাড়বো। ওর বোঝা উচিত, কতটা কষ্ট লাগে ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সঙ্গে রঙ্গ করতে দেখলে।
— এখনো সময় আছে চলে যাও নিলীমা।
ভাবনার দরুন প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত মনের অবস্থা। এমন সময় অকৃতদার মানুষটির এমন বাঁক। অধিক শোকে যেন পাথর হয়ে গেলাম। হোক না সে আমার প্রাক্তন। আমি না হয় তাকে ঘৃণাই করি। তাই বলে একসময় যে তার নামে ভালোবাসার অসীম আকাশ তৈয়ারি ছিল তা আমি লুকাই কি করে? ঘাঁ শুখোয় বটে দাঁগ কি বিলীন হয় এতো সহজে?
— না গেলে কি হবে?
মুচকি হেসে কঠোর মুখে বললাম। হৃদ অগ্নুৎপাতের মতো উত্তেজিত হয়ে চাপা কন্ঠে বলল
— শান্তি পাবে না কিন্তু।
— কেন? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না। তুমি তো এখন অন্য রমনীর দাস।
আমার কথার পিঠে সে বুঝি শক্ত চাহনি নিক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছু পারলো না। আমি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আমার শাশুড়ী এসে গেছে। সালাম দিলাম নম্র সুরে। বিশ্বাস করেন ভালোবাসা খুব অদ্ভুত। নিজ ইচ্ছায়, নিজের জেদ প্রতিয়মান করতে,৷ তাকে শাস্তি দিতে এসেছি এখানে। কিন্তু অজানা কারণে মন হু হু করছে। যেন ভেতরটা আমার খা খা শূন্য।
— একি বউয়ের তো নাক ফুটো নেই। আপা নাকফুল দিবি কেমনে?
পাশ থেকে কারো উঁচু, আশ্চর্য কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই কিছুটা কেঁপে উঠেলাম আমি। সত্যিই তো! আমার নাক ফুটো করা হয়নি। শাশুড়ির দিকে দৃষ্টি ফেলতেই দেখি তিনি উনি সরু চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। হাতে উনার নাকফুল ঝলমল করছে। এহেন দশায় আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। শুধুই অস্বস্তি দলে দলে খোঁচাচ্ছে।
— তুমি নাক ফোটাওনি?
শাশুড়ির শান্ত প্রশ্ন। জবাব দেওয়ার জন্য হা করতেই থামতে হলো আমাকে। হৃদ আমায় আটকে দিয়ে বলল
— মা এমন মেয়ে কিন্তু বউ করা ঠিক না। নাকফুল না পরলে স্বামীর অকল্যাণ হয়। তাই না ফুপি?
সামনের কোনো এক মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল হৃদ। সেই মহিলাটা। যে আমার নাক ফুটো নেই বলে একশো কেজি চিন্তার বস্তা মাথায় নিয়ে চিল্লিয়ে উঠেছিল। বুঝলাম সে ফুফু শাশুড়ি। তিনি হৃদের কথায় একশো পার্সেন্ট নিশ্চয়তা যেন কিনে এনে ধরিয়ে দিতে চাইলো আমার শাশুড়ির হাতে। বলে উঠলো
— হ্যা ভাবি। আমার দেবরের ছেলে এমন বউ বিয়ে করে এনেছিল। ছেলেটার তো শরীর ভালো যায়ই না। পরে বউ নাক ফুটো করলো।
— হ্যা মা আমার ভাইটার এমনিতেই শরীর ভালো যায় না। ওর মাথায় সমস্যা এমনিতেই তার উপর…..
হৃদের কথায় ধক করে উঠলো আমার বুক। দ্রুতগামী অশ্বর গতিতে যেন নজর ফিরালাম তার দিকে। যাকে বিয়ে করেছি তার মাথায় সমস্যা! আজব! দুঃখের মাঝে কি আমার হেসে ফেলা উচিত? কাকে বিয়ে করলাম জেদের বসে? হৃদ আমার চাহনির তোয়াক্কা করলো না। সে আরো হুটোপুটি খেয়ে পরলো মা আর ফুফুর সাথে। সে জানে আমি সুচ ভয় পাই। নাক ফুটোনোর কথা শুনলে আমার কাঁপাকাঁপি উঠে। তবুও সে উদ্দমের ঝড় তুলেছে। আজ আমায় নাক ফুটো না করে ছাড়বেই না! আমার শাশুড়ী শান্তমুখে শুনে যাচ্ছে ছেলের বোঝাপড়া। এমন করে তিন চার মিনিট অতিবাহিত হতেই তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন
— আচ্ছা ঠিক আছে। এখন না ও কয়েককটা দিন পরেই না হয় নাক ফুটাবে।
উনার কথায় আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু হৃদ দমলো না। সে পুনরায় বলে উঠলো
— মা আগের কাজ আগে সারা কি ভালো নয়?
আমার চোখে এবার স্পষ্ট হয়ে রাগ ভেসে উঠলো। বলার ইচ্ছে হলো অনেক কিছুই। কিন্তু সদ্য পা ফেলেছি এবাড়িতে। ঘন্টা অতিবাহিত না হতেই যদি চড়া কথা বলে ফেলি ভাসুরকে তাহলে ভালো দৃষ্টিসম্পন্ন হয় না কাজটা।
.
নাকে অসহ্য ব্যাথা নেই। কিন্তু মনের মধ্যে কেমন খচখচ খচখচ করছে। অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। ড্রইংরুমের সোফায় বসিয়ে রেখেছে আমাকে। ছোট ছোট বাচ্চারা দেখছে আমাকে। নতুন বউ দেখার বুঝি অনেক আনন্দ! আমি কখনো এভাবে দেখিনি। বরাবরই পানসে টাইপ ছিলাম আমি। চারদিকে পরখ করছি। বাসাটা স্বচ্ছ। আভিজাত্যের ছোয়া ততটা নেই। তবে পরিষ্কার ফিটফাট! এ কথা বলা বাহুল্য যে আমাদের বাসা থেকে এ বাসা কমজোরি। বাসায় চোখ বুলাতে বুলাতে দৃষ্টি গেলো শাশুড়ী মায়ের দিকে। ওনার হাতে একটা বক্স। আমার নিকট বক্স সহিত এসে বসলেন উনি। এখন ভালো করে নজর করতেই দেখি একটা নয় দুইটা বক্স। একটা ছোট আরেকটা বেশ বড়। শাশুড়ি প্রথম দফায় ছোট বক্স উজার করলো। তাতে প্রথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম দেখতে পেলাম। সেখান থেকে তিনি একটা টিউব জাতীয় ওষুধ নিয়ে আআমার নাকে পরম যত্নে লাগিয়ে দিলেন। ভীষণ জ্বলে উঠলো সুচ৷ চালানো জায়গাটুকু। বদ্ধ চোখে দাঁতে দাঁত চেপে সইয়ে গেলাম। মনটা বড্ড শক্ত থাকলেও এমন অনাবিল স্নেহে মন মৃদু নমনীয় হলো। শাশুড়ি মা জিজ্ঞেস করলেন
— ব্যাথা করছে? জ্বলছে?
মিষ্টি হাসার চেষ্টা নিয়ে বললাম
— কিছুটা।
উনি যেন আমার ব্যাথায় ব্যাথিত হলেন। পরম স্নেহশীল শাশুড়ির ন্যায় তিনি অদূর হতে ফু দিলেন আমার নাকে।
— নাকফুলটা ভীষণ মানিয়েছে তোমাকে।
আমি আবারও মিষ্টি হাসলাম। শাশুড়ি বড় বক্সটা উন্মুক্ত করতে করতে বললেন
— এখানে নীরবের বউয়ের জন্য গহনা জমিয়েছিলাম। আরেকটা বাক্স আছে সেটাতে হৃদের বউয়ের জন্য জমানে আছে। একই গহনা। ভেবেছিলাম আজকে শুধু মেয়ে আর ছেলের আকদ করা হবে। তা তো হুট করেই বিয়ে হয়ে গেলো। হৃদের কাবিন করা হয়ে গেছে। এখন শুধু বউ তুলে আনার অপেক্ষা। তারপর নীরবের….. যাই হোক, যা ঘটেছে তা মঙ্গল বটে।
শেষোক্ত কথাটা বলে মা মুচকি হাসলেন। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমিও মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করলাম। জানিনা কতটুকু সফল হয়েছি। কিন্তু আমার মনে যেন দাবানল শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর পাথর চেপে দিয়েছে কেউ। হৃদের কাবিন হয়ে গেছে? চোখ তুলে চাইলাম হৃদের দিকে। সে বুঝি খুব খুশি। আমায় জ্বলে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো একটা হাসি দিলো সে। কান্না যেন আমার ফিনকি নিয়ে আসতে চাইছে।
চলবে……..
#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#সূচনা_পর্ব