টিট ফর ট্যাট পর্ব-২

0
5003

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_২

ভাবনা গাঢ় হতেই ভীষণ জেদে ছুড়ে ফেলে দিলাম। ঝটফট চোখ মিটমিট করে আটকে দিলাম অশ্রু। সন্তর্পণে দীর্ঘ দুইটা শ্বাস টানালাম। আমি কষ্ট পাবো না, পাবো না, পাবো না। হ্যা, আমি আমার বড় স্বপ্ন, বড় লড়াই পরীক্ষা ছেড়ে এ বাড়িতে পা দিয়েছি। মোটেও আমি ভেঙে গুড়িয়ে যেতে আসিনি। বরং ভাঙতে এসেছি। নাইন টেনের মেয়ে দেখলেই অনার্সের ছেলেদের পুতুল খেলার সাধ জাগে তাই না? নরম, স্বচ্ছ আবেগি হৃদয় পুড়িয়ে দিতে তারা বেশ আনন্দ উপভোগ করে! ক্লাস টেনে থাকতে আমার মন বশ করেছিল আরিয়ানা হৃদ। তিন বছর ব্যবহার করে ডেট এক্সপায়ারের ন্যায় ছুড়ে দিল। আমি নিলীমা তো ওকে ছাড়বো না! কাঁঠালের আঠার প্রগাঢ়তা হয়তো অজ্ঞটার জানা নেই।

— মা একটু পানি…

ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে শাশুড়িকে বলতেই উনি কাউকে হুকুম দিলেন পানির জন্য। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কাকুতি ভাবনায় পাল্লা দিয়ে হাশফাশ ভাবটা বেড়ে গেছে। মনে বেশি চিন্তা হানা দিলেই বুক ধড়ফড়িয়ে উঠা নামা করতে থাকে। বুঝতে পারছি আমার অবস্থা ক্রমশ শ্বাসকষ্টের দিকে গড়ছে। তাই মমে ইতোস্ত না রেখে শাশুড়িকে আবার বলে উঠলাম

— মা আমি কি একটু ভারি সাজগোজ এখন ছাড়তে পারি? গা জ্বালা করছে গরমে।

মিনমিনিয়ে বললাম। ভয় একটাই আমার। নতুন বউ আমি। পাছে না শ্বাসকষ্ট উঠে আমার এলাহি কান্ড বাঁধে। নতুন বউ বাড়িতে পা দিতে না দিতেই যদি অসুখ হামলে পারে তার উপর তাহলে বিষয়টা ভীষণ বিব্রতকর হবে।

আমার শাশুড়িমা আমার অস্থিরতা উপলব্ধি করে চলে গেছেন হালকা শাড়ির ব্যাবস্থা করতে। ধীরে ধীরে কমলো আমাকে ঘিরে রাখা মানুষের ভীড়। স্বস্তির দেখা যেন মাত্র মিলল আমার। বড় করে একটা শ্বাস টেনে কষ্ট প্রশমিত করতে চাইছি। তরতর করে ঘেমে উঠছে আমার গা। এমন সমস্যা জরিয়ে ধরেছে আমায় সেদিন রাতে। হৃদ যেদিন বলেছিল,

” তোমাদের মতো ছোট মেয়েগুলোর সাথে শুধু টাইম পাসই করা যায়। ভালোবাসা যায় না। ঘরের বউ তো হওয়ার যোগ্যই না ”

কথাটা যেন সেদিন মনে তীর হয়ে ছুটে এসে ছেদ করে। একমুহূর্তের জন্য মন বলেছিল ‘একি তোর স্বপ্ন নিলীমা? আমি সহ্য করতে পারছি না।’ সেদিন রাতে অনেক কান্না করি। ভালোবাসার পথ থমকে যায় আমার। এক বুক নয়, এক পৃথিবী নয়, এক অসীম আকাশ সম দুঃখ ছুয়ে যায় আমায়। বিচ্ছেদের গল্পটা না, অতি উচ্চ ভাষায় গুছিয়ে লিখলেও অনুভূতির প্রতিরূপ হতে পারে না। সেই মেয়েটাকে বলে দেখবেন, যে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সইছে। তার ঘরের দরজায় গভীর রাতে একবার কান পেতে দেখবেন, তার রাত যায় কি করে। দিনে সে কি করে কষ্ট বুকে চেপে সমস্ত কাজটা করে যায়। রাতে এসে সে কেমন নিষঙ্গের মুখোমুখি হয়।

ভাবছিলাম এসবই একমনে। হঠাৎ মনে হলো আমার গা-টা জুরিয়ে যাচ্ছে। হালকা হাওয়ার আগমন আমাকে ঘিরে। হওয়ার উৎস বুঝে ঝটপট ফিরে চাইলাম সেদিকে। দৃষ্টিতে যা ধরা দিলো তাতে আমি অবাকের চূড়ায় পৌঁছাতে বাধ্য হলাম। আমার সাইডে টেবিল ফ্যান চলিয়ে রাখা হয়েছে। রেখেছে কে? আমার প্রাক্তন আরিয়ান হৃদ। চোখ সরু হতে গিয়েও হলো না আমার। হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক ধুকপুক সুর তুলেছে। কোথাও একটা আশা, আবেগ পবনে মেলে দিয়ে আমার কানে পৌছে দিল, ‘Nelima, he has feelings for you’

আমি নুইয়ে পরলাম ভেতরে ভেতরে।কিন্তু হায়য়! বোকা মন বোকাই রয়ে গেছে। বিশ্বাস সে আজও পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি ভালোবাসা আর ঘৃণা মিশ্রিত মানুষটার উপর থেকে। হৃদ হেলে দুলে এগিয়ে এলো আমার দিকে। ধপ করে সোফায় আমার পাজরে বসে ফিসফিসিয়ে বলল

— বেঁচে থাকো ছোট ভাইয়ের বউ। হালকা গরমেই এমন হলে ভাসুরের, স্বামীর, শাশুড়ির, জায়ের কাজ করবে কিভাবে তুমি?

আমার ভাবনার ভ্রান্ত আর হৃদের কথার ধরনে আড়ষ্ট হলো যেন মস্তিষ্ক। কড়া নয় এক শান্ত ব্যাথাতুর দৃষ্টি তাক করলাম তার দিকে। সে আবারও বলে উঠলো

— নিজের পায়ে নিজে কুড়াল দিয়েছো তুমি বোকা মেয়ে। ভাবছো আমায় জ্বালাবে তুমি। দেখো নিজেই জ্বলে পুড়ে যেন ছাই না হও।

চাপা কন্ঠস্বর তার। চিবিয়ে চিবিয়ে যেন বলল কথাটা। আমি চোখ ঘুরিয়ে রুমটা পরিদর্শন করলাম। আত্নীয়রা নেই বললেই চলে। জন দুই ছোট বাচ্চারা অপর পাশেয় সোফায় ঘুমাতে বা মোবাইলে ব্যাস্ত। আমি হৃদের দিকে এবার তাকালাম। মুচকি একটা হাসি দিলাম। অতঃপর ওড়না দিয়ে তার হাতটা খপ করে ধরে আমার মাথায় রেখে বললাম

— দোয়া করবেন ভাই জান। আমি যেন আমার কার্যে সফল হই। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে দিন কাটাতে পারি।

আমার কথা শেষ হতেই হৃদ এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে নিলো। স্থির নয়নে সেকেন্ড পাঁচেক তাকিয়ে দেখলো আমার হাত। ওড়না দিয়ে ছুয়েছি। আমার হাত দিয়ে নয়। হৃদ বেজায় অপমান বোধে তেড়ে মুখ এগিয়ে দিলো আমার দিকে। বলে উঠলো

— তোর স্বামী একটা এবনরমাল। প্রেম করে ছ্যাকা খেয়ে টালমাটাল সে এখন। ভালো করে সংসার করিস আর….. হ্যা এই নাকফুলটাও সামলে রাখিস। স্বামী সোহাগি!

কথাটা বলেই নির্দয় পাষান আমার নাকফুলটা ঘুরিয়ে দিলো মোচড় দিয়ে। ব্যাথায় না চাইতেও আর্তনাদ করে উঠলাম। কাচা ফুটো ব্যাথায় টনটন করে উঠলো সেই সাথে আমার রাগও। দমাতে পারলাম না রাগ। এমনিতেও কুসংস্কার নিয়ে আল্লাদ করে সে আমায় নাক ফুটোতে বাধ্য করেছে তার উপর এমন ব্যাথা। রেগে নিজের শক্ত উঁচু গোড়ালির জুতো দিয়ে চাপ দিলাম তার পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে সে ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে নিল। মুখ ছেয়ে গেলো ব্যাথায়। আমি জেদে আরো শক্ত করে চাপ দিয়ে বললাম

— বলেছিলাম না সেদিন, তুমি আমার না হলে, আমি তোমার ঘরেই বিয়ে করবো। তা না পারলে তোমার আত্মীয়দের মধ্যে। তাতেও বিফল হলে তোমার জেলাতে অন্তত করবোই। সব শেষে ভাগ্যে না থাকলে যেখানেই বিয়ে করি জামাই নিয়ে তোমার বাড়ি ভাড়াটিয়া হবো। তবুও তোমায় পোড়াবো।

.
বিয়ে ধুপধাপ করে জেদ নিয়ে করলেও এখন ভাবাচ্ছে এই পরিস্থিতি। বাসর! মাথাতেই আসেনি বিষয়টা। মেয়েদের অন্যরকম এক স্বপ্ন থাকে এই নব রাতকে ঘিরে। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল, সাধ ছিল এই রাত নিয়ে। ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন বুনেছিলাম তা বলা বাহুল্য। কিন্তু( শখা আমার করলো একা, ছাড়িলো আমায় বুঝিলো না মোর মনের ব্যাথা)
গানের কলির মতো উক্তি আপনা আপনি ছুটে এলো মনে। হেসে ফেললাম। কি ছিলাম আর কি হয়ে গেলাম। এখন গান রচনাও করতে পারি বাহ! দুঃখ মনে রেখে মুখে হাসি নিয়ে চাইলাম সামনের বেলকণির দিকে। হালকা পাতলা একটা শাড়ি জরিয়ে বসে আছি বাসর ঘরে। তাজা, সতেজ ফুলের রূপে মন একটু হালকা। নীরব তথা আমার স্বামী বেলকনিতে বসে আছে। সে আমার থেকে দশ মিনিট সময় চেয়ে নিয়েছে। জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হয়নি কি করবে সে। হৃদ বলেছিল তার ভাই এবনরমাল। মানে প্রেমে ছ্যাকা খেয়েছে তাই। সত্যি না মিথ্যা আমি জানি না। তবে জানা দরকার আমার। যতো যাই করি। স্বামীকে উপেক্ষা, অবজ্ঞা করার সাহস আমার নেই। স্বামী সবসময় সম্মানের। সে আমার মনের মানুষ না হলেও।

— শুনছেন?

স্পষ্ট কন্ঠস্বর। ঘোর কাটলো আমার। তাকিয়ে দেখি নীরব দাড়িয়ে আছে। নাকে আমার ঝট করে যেন সিগারেটের গন্ধ ধরা দিলো। কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলাম। নিচু স্বরে বললাম

— জ্বি বলুন।

— তুমি করে ডাকি? আপনি বললে মনে হয় নানি দাদির সাথে আলাপ করছি।

নীরবের কথার ধরনে হেসে উঠলাম। সত্যি বলতে আমারও অস্বস্তি লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমি সিনিয়র।

— হ্যা অবশ্যই। ডাকতে পারেন।

সে মুচকি হাসলো পাশে বসলো আমার। ভালোই মনে হচ্ছে। হৃদ তো আমায় জ্বালানোর জন্য বলেছিল নীরব এবনরমাল। সত্যি বলতে সে যদি প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে এবনরমাল হয় তাহলে আমিও তো এবনরমাল। ভাবতে ভাবতে কানে এলো এক অযাচিত প্রশ্ন। চমকে চলাকাল পাশে।

— আপনি কি বাসর করবেন?

ভীষণ বিদঘুটে, অদ্ভুত না প্রশ্নটা? মানে আমি যেন তার কাছে ডিল করতে এসেছি কোনো বিষয়ে। থতমত খেয়ে বললাম

— সরি আপনার কথা আমি বুঝিনি।

নীরব যেন কিছুটা বিরক্ত হলো। সে ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে সুন্দর দুখানা ঠোঁটের ভাঁজে আওড়ালো

— মানে বলতে চাইছি…. হাহ, মানে আমি একজন দায়িত্বশীল, সৎ হাসবেন্ড হতে পারবো না। তোমার সাথে আমার সব স্বাভাবিক থাকবে কিন্তু ভালোবাসা না।

চলবে…….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আর কেউ কিন্তু ভাববেন না লেখিকা চ্যাকা প্রাপ্ত 🙂)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here