টিট ফর ট্যাট পর্ব-৩

0
4131

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_৩

ঘুম! উফ, ভয়ঙ্কর শান্তির জিনিস। পৃথিবীতে মহান রব সবকিছুর প্রয়োজনীয়তা রেখেছেন। একটা কিছুও যেন খামোখা নয়। কিন্তু ঘুমের মাঝে প্রতিবন্ধক এলে আমার খামোখা রাগ হয়। হুট করে রাগ হবে। গায়ে যেন আগুনের উত্তাপ লাগে। খুব শান্তিতে ঘুমোচ্ছিলাম। ঘুমে দুঃখ ভোলা যায়, ঘুমে শান্ত থাকা যায়। কিন্তু আমার আরামকে বিরামে পরিণত করে চিল্লিয়ে উঠলো এলার্ম। বদ্ধ চোখ কুঁচকে গেলো আমাার। ফোনের এলার্ম বাজছে। আমি তো ফোনে এলার্ম দেই না? ভাবনা যখন তুলে আনলো এ প্রশ্ন তখন ঝট করে চোখ মেললাম। আমি না শশুর বাড়ি! নিশ্চয়ই নীরবের ফোন হবে। হাতটা বাড়িয়ে দিলাম মাথার কাছে। হাতড়াতে হাতড়াতে হয়রান আমি। কোথায় ফোনটা? সে জেগে উঠার আগেই এলার্মটা বন্ধ করে কি আমি আর একটু ঘুমাতে পারবো না? আমি বড্ড ঘুম পাগলি। ঘুম যে আমায় সম্মোহন করছে। ঢুলুঢুলু চোখে খুঁজছি ফোনটা। জানিনা কি কি হাতের সংস্পর্শে আসছে। কখনো উঁচু কিছু অনুভব করছি, কখনো মোলায়েম কিছু। ভালোভাবে সংকেত মস্তিষ্কের গেটে পৌছাতে না পৌছাতেই ঘুম মুখের উপর বন্ধ করে দিচ্ছে গেট। উফ! পারবো না খুঁজতে। ঘুমাবো আমি। কথাটা ভেবে যেই না নতুন উদ্দমে মনে শান্তি নিয়ে ঘুমাতে যাবো ঠিক সেই সময়ে হাঁকডাক স্বামী নীরবের। লাফিয়ে উঠলো আমার হৃদপিণ্ড। ঘুম যেন ম্যারাথান গতিতে পালিয়ে গেলো।

— চুল ধরে টানাটানি করছো কেন নীলিমা ? চুপচাপ ঘুমাও।

কথার মূলমন্ত্র যেন এমন যে আমি স্বইচ্ছায়, স্বচক্ষে, স্বদায়িত্বে তার সাথে ইয়ার্কি করছি। হয়তো ফোন হাতরাতে গিয়ে ভুলে তার মাথা হাতরিয়েছি তাই বলে এমন ভাব! কাল রাত তিনটা পর্যন্ত তার যুক্তির কবলে পরে আমার ঘুমের সাথে সাক্ষাৎ হতে দেরি হয়ে গেছে তবুও আমি কিছু বলছি না, বলিনি। আর সে নিজেই এখন একদিনে হাজার জনমের সংসার করনেওলার মতো ভাব দেখাচ্ছে। কাল রাতেই বুঝেছি বেচারা হয়তো আসলেই এবনরমাল। তবে একটা জিনিস ভালো, আলট্রা ঢংয়ে গা না ভাসিয়ে সে বেডেই ঘুমিয়েছে। দুজনে আদর্শ স্বামী স্ত্রীর মতো পাশাপাশি ঘুমিয়েছি।

.
ঘুম ছুটে পালিয়ে গেলে তার দেখা মেলা দুষ্কর হয়ে যায়। মৌনতা নিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকতে ভালো লাগেনি। মোটে ঘুমিয়েছি হয়তো একঘন্টা। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা ছেলের শিয়রে শির রেখে তাই কোনো মেয়ের ঘুম হয়? প্রথম পরিচয়ে তাও আবার খানিকটা অদৃশ্য প্রতিশোধের আগুন যা আমার মনে জলন্ত। তার ভাইকে ঘিরে আমার টিট ফর ট্যাট গেমের চমক। সংসার করার মন মানমানুষিকতা নিয়ে তো আর নিলীমা কাল পদার্পণ করেনি এ বাড়িতে। যাই হোক সব ভাবনা চিন্তা মুঠ পেকে সরিয়ে ফেললাম। এখন হয়তো ভোর সোয়া চারটা হবে।আমি দাড়িয়ে আছি নীরবের রুমের সম্মুখে। বেলকনি নেই দেখছি। তবে রুমের দরজা খুললে সম্মুখেই সানন্দে ধরা দেয় চোখে বিশাল এক জানালা। পাশ ফিরে চাইলাম। ডানে কোনো বদ্ধ দেওয়াল নেই। নীরবের রুম বরাবর আরেকটা রুম দেখা যায়। দুই রুমের সন্ধি হয়েছে এই বিশাল জানালা। না জানালা হবে না হয়তো। এটা বড় একটা বেলকনি। দুইটা রুমের একটা বিশাল বেলকনি। দারুণ! শুধু রুম দুইটার মাঝে কাবাবের হাড্ডি হয়ে দাড়িয়ে গেছে সিড়ি। কিন্তু পাশের রুমটা কার? প্রশ্নটা মনে পদার্পণ করতেই ভরকে গেলাম আমি। যদি হৃদের হয়? হওয়ার সম্ভাবনাই তো অধিক। ভাই ভাই পাশাপাশি রুমে থাকে আর শাশুড়ি ওদিকের রুমে। ভাবতেই হৃদপিন্ড ধ্বক করে উঠলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার চাইলাম সে রুমের দিকে। বারান্দার মলিন আলোয় অস্পষ্ট লাগছে। ভেতরে ড্রিম লাইটের আলো যেন হুমড়ি খেয়ে পরলো আমাকে দেখার জন্য। ছটফট ছটফট করে অস্থির হয়ে উঠলো আমার হৃদপিণ্ড। ঘরের অভ্যন্তরের সবুজ আলোয় যেন কামড়ে ধরলো কেউ আমার হৃদপিণ্ড। জানি না কেন হুট করে এ কষ্ট বুকে হানা দিল। একসময় স্বপ্ন দেখতাম তার ঘরের টুকটুকি হয়ে সংসার সাজাবো। খুব সুন্দর করে শাড়ি পরে ঘরময় দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি করে আগলে রাখবো সংসার, কাজ করবো। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখবো আমি তার বুকের উপর। সে আমায় জাপটে ধরে উষ্ণ পরশ দিচ্ছে। আমি আদ্র হেসে তার ঘুম ভাঙাবো। সে যখন শত ব্যাস্ততা পেরিয়ে ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে বাসায় ফিরবে। কাজের ফাঁকে দৌড়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে হাজির হবো। হাতে ধরিয়ে দেবো। অতিশয় ভালোবাসা দিয়ে তার ঘামে ভেজা মুখ দুঃখী দুঃখী চেহারায় মুছে দেবো। সে পহেলা দফায় বিরক্ত হবে। অতঃপর আমি তার চাহনিতে অভিমানের খেয়া ভাসাবে মন সাগরে। ভালোবাসার মানুষটা হেসে ফেলবে আমার অভিমানে। আমার চোখ টলমলে হয়ে নির্বাকতায় জানাবে ‘ নিলীমা রাগ করেছে।’ সে তখন ব্যাস্ত হবে আমার রাগ উবে দিতে।
আবেগী ভাবনাগুলো মন নাড়িয়ে দিলো। পারিনি শক্ত করে বেঁধে রাখতে আবেগটাকে। মন গলে চোখে অশ্রু হানা দিয়েছে। আর কত পারা যায় নিজেকে পাথর করে রাখতে? রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, আমার কলেজ গেইটের সম্মুখে সে আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে রঙ্গ করে অন্য মেয়েদের সাথে। বুকে পাথর চেপে কান্নার দ্বার রুদ্ধ করে আমি এক অনুভূতিহীন মানুষের মতো হেঁটে আসি। কলিজা যেন কষ্টে ফেটে যায় আমার।

— এখানে কি করো?

নীরবের কন্ঠে চমকে উঠে ঝটপট চোখের পানি মুছে নিলাম। ভাবনা সুপ্ত রেখে চাইলাম তার দিকে। প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করতে গিয়ে অনুভবে ধরা দিলো আমার কন্ঠ ভেজা, আড়ষ্ঠ। নাকে পানি জমানো। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে গেলাম। কান্নারত স্বরে কথা বললে আবার কিনা কি ভাববে। নীরব আমার স্তব্ধতা দেখে ভ্রুকুটি করলো। আধো আলোয় তাকিয়ে দেখি মুখখানা অনধিক এগিয়ে দিয়েছে আমার দিকে। প্রশ্ন বিদ্ধ করে দিলো আমায়।

— কান্না করছো?

— হ্যা, ন……আ। মানে না তো।

ধুপ করে সত্য চাপাতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেলাম। নীরব নিঃশব্দে হাসলো। গায়ে তার পাঞ্জাবি চাপানো। হাতে ছিল টুপি। খুব যত্নে ভ্রু উঁচিয়ে সে মাথায় টুপি দিতে দিতে বলল

— রুমে গিয়ে নামাজ পরো। ভালো লাগবে।

কথাটা বলে ধীর গতিতে সে প্রস্থান করলো। সে যে আমার চোখের পানি দেখে ফেলেছে আমার অজানাতে এটা ভাবতেই আমার গা অবশ হয়ে যাচ্ছে। থোকা থোকা অস্বস্তি জড়িয়ে নিচ্ছে মনকে। তবে তার শেষ কথাটায় ভালো লাগলো। নামাজ! এটাই। কখনো এতো গভীর ভাবে নামাজের কথা ভাবিনি। নামাজে যে শান্তি নিহিত এ কথা মনে নিয়ে কষ্ট প্রসমিত করার চিন্তা মাথাতেই আসেনি। জীবন সঙ্গিটা হয়তো মন্দ জোটেনি। থাকতে পারে একটু স্ক্রু ঢিলে। কিন্তু মনে হচ্ছে বেশ ব্যাক্তিত্ববান। তবে ভীষণ আফসোস! আমিও হয়তো তার মতো তাকে ভালোবাসতে পারবো না। ভাবতে ভাবতে পেছন ঘুরে তাকালাম। একটু আগে মনটা বড্ড খারাপ থাকলেও এখন মনে হচ্ছে একটু ভালোর দিকে। নামাজ পরার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে। হাই তুলতে তুলতে পা বাড়ালাম রুমের দিকে। ঠিক এই সময়েই আজব কান্ড। নীরবের কন্ঠস্বর

— নো চিটিং। কোনো ধোঁকাবাজি কিন্তু চলনে না। এখন আবার ঘুমালে কিন্তু ঘর থেকে বের করে দেবো। নামাজ না পরলে আমার ঘরে কিন্তু জায়গা হবে না।

আমি বেকুব হয়ে গেলাম নীরবের কথায়। সে না মসজিদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। এখনো এখানে কেন? আমি বিস্ময় আর অবুঝ চাহনি নিয়ে বড় বড় চোখে শুধালাম

— আপনি যাননি মসজিদে?

নীরব আমার প্রশ্নে সিঁড়ির নিকট হতে এগিয়ে এলো আমার দিকে। ঝট করে উড়ে এসে লাগলো আমার নাকে আতরের মোহময় সুবাস। সে বলল

— না। দেখছিলাম তুমি নামাজ পরো কিনা। আলসে মেয়ের মতো হা করতে করতে দেখছি এখানেই দাড়িয়ে আছো। চলো আজ মসজিদে যাবো না। ঘরেই নামাজ পরবো।

নিজেই গড়গড় করে অভিমত ব্যাক্ত করে চলে গেল রুমের দিকে। আমি হা করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হেসে উঠলাম মৃদু স্বরে। এতো সুন্দর, এতো মোহময় মানুষটাকে কোন হতচেতন মেয়ে ছেড়ে গেছে? সে মেয়ে আর যাই হোক, খাটি সোনা কি তা জানে না। হুম, হতে পারে মাথার স্ক্রু একটু ঢিলা। কিন্তু বেশ ভালো মনের। একদিনে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই নিজে বাজিকরের মতে সহজ করে নিয়েছে আমাকে। আমি আশ্চর্য! সম্পর্ক গড়া বুঝি এতোই সহজ! নাহ! মোটেও না। তিনবছর গাঢ় প্রেম, ভালোবাসা যাকে উজার করে নিঃস্বার্থভাবে দিলাম তার সাথে তো সম্পর্ক সুন্দর হয়নি! আসলে সবাই নির্মল মন নিয়ে সম্পর্ক গড়তে পারে না।

চলবে…….

( ছোট হচ্ছে পর্বগুলো। ভাবছি দিনে দুই পর্ব করে দেবো। পরীক্ষা আসছে 😒। যাই হোক ভুল ছাড়া আমি ফুলকলির মতো লিখতে পারিনা। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন 🥱
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল 🥺)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here