টিট ফর ট্যাট পর্ব-৪

0
3602

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_৪

ভ্যাপসা গরমে সিদ্ধ হওয়ার জোগাড় আমার। সূর্য বুঝি আজ বেজায় ক্ষেপা। অতিরিক্ত গরমে আমার সমস্যা হয়। গরম সহ্য করতে পারি না একদম। আমার এ যন্ত্রণা, কষ্ট বাবা না মেনে বাসায় এসির লাগিয়েছেন। কিন্তু শশুর বাড়িতে এ ব্যাবস্থা নেই। তারউপর কারেন্টাও পালিয়েছে। মাথা এই বুঝি রেগে গেলো। মাইগ্রেন যেন লাফাতে লাফাতে আসছে আমার কাছে। শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকালাম। তিনি টেবিলে থালা বাসন সাজাচ্ছেন সবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমি চেয়েছিলাম কাজে হাত লাগাতে তিনি বাঁধা দিয়ে বলেছেন

— তোমারই তো করতে হবে এসব। তাই বলে কাল বউ হয়ে এসে আজ কাজে হাত দিতে হবে না মেয়ে। নতুন বউ একটু নতুন থাকো।

উনার কথার প্রত্যুত্তরে মুচকি একটা হাসি দিয়েছি। অতঃপর টেবিলে বসে গরমে হাশফাশ করছি। বাসাটা বেশ নিরিবিলি। আমি অনেক আগেই শুনেছি হৃদের বাবা পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পারি জমিয়েছেন ওপারে। শুধু তিনজন সদস্য ওরা। গত রাতে অনেক কথা শোনা হয়েছে নীরবের থেকে। আমার লেখাপড়া, তার ক্যারিয়ার নিয়ে আলাপচারিতায় বাসর রাত গত হয়ে গেছে। নীরব বলছিল তার বাবা মারা যাবার পর বহু কষ্টে তার মা তাদের এতোবড় করেছে। আমার শাশুড়ি আগে থেকেই একজন শিক্ষিকা। তিনি হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। চাকরির আয়ু প্রায় শেষের দিকে অবশ্য। আর নাকি দুবছর। হৃদ প্রায় ভবঘুরে। সে নির্দিষ্ট কোনো কাজই করে না। শখের বসে যদিও দু একটা কম্পানিতে ইন্টারভিউ দেয়, চকরি পেয়ে যায় সেখানে দুমাসের অধিক সে স্থানী হতে পারে না। তার নাকি মনে মানে না অন্যের অধীনে কাজ করা। তার হবু শশুর মানে আমার চাচাশ্বশুর। হৃদের একমাত্র চাচার একমাত্র মেয়ে নীরবে ভাবি। মানে এখন আমারও ভাবি। তার বাবার অঢেল সম্পদ। তিনি ব্যাবসা দাঁড় করিয়ে দিবেন হৃদকে। এজন্য আমার প্রাক্তন নিশ্চিন্তে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘোরে। কিন্তু আমার স্বামী একটু অন্যরকম। সে নিজের উপর বেশি বিশ্বাসী তার চেয়েও অধিক সুন্দর জিনিসটা হলো তার স্ট্যাটাস, স্মার্টনেস। সত্যি বলতে গত রাতে শত কষ্টের মাঝেও তার মুখের একেকটা বাঁক শুনে আমি সত্যিই আশ্চর্য হয়েছিলাম। মুহূর্তের জন্য সব ভুলে যেন তার কথাতেই ডুবে রয়েছিলাম। গত রাতে বুঝেছি, স্মার্ট ঐ ছেলেটা নয় যার আউট লুক নজর কাড়া। ঐ ছেলেটার মূল্য অধিক নয় যার সুন্দর চেহারা আছে। স্মার্ট তো সে, যে রবের নির্দেশে চলে। প্রকৃত স্মার্টনেস তো সেটাই যে নিজের দায়িত্ব নিয়ে ভেবে তা যথাযথ পালন করে বোঝা ঝেড়ে ফেলে মনটা পরিষ্কার করে। অধিক মূল্য কার জানেন, যে মানুষটা শিক্ষায়, আচরণে, ভেঙে গুড়িয়ে গিয়ে উঠে দাড়িয়ে বলে ‘জীবন আমার হলেও এর উপর অধিকার আছে অনেকের। আমি হেরে গেলে চলবে না। আমার মায়ের কি হবে?’ এমন কিছুতে জয়ী।

— হৃদ, বাবা তোর পায়ে কি হয়েছে?

শাশুড়ির শঙ্কায় ঝরে পরা ডাকে ভাবনা আমার ছুটে গেল। ঘার ঘুরিয়ে পেছনে দৃষ্টি দিতেই দেখি হৃদ পা টেনে টেনে হাঁটছে। মুখের প্রতিকৃতির বর্ণনা হয় না। অত্যন্ত বিরস মুখ। শাশুড়ি মা দৌড়ে গেলেন ছেলের কাছে। হাতটা ধরে হাঁটার কষ্ট কিছুটা নিলীন করার চেষ্টা করলেন তিনি। অত্যন্ত চিন্তিত সুরে শুধালেন ছেলেকে

— পায়ের এই দশা হলো কি করে? ইশ! কেমন থেগলে গেছে মনে হয়।

মায়ের প্রশ্নে হৃদ এক ঝাক ক্রোধ নিয়ে তাকালো আমার পানে। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। অনেক ব্যাথা পেয়েছে কি? পায়ের শেষ আঙ্গুলের আগের আঙ্গুলটায় রক্ত জমে গেছে। ছিলে গেছে অনেক টুকু। মনটা হঠাৎ জানিয়ে দিলো, আমার কষ্ট হচ্ছে তার জন্য। কাল ওমন করে পায়ে চাপটা না দিলেও পারতাম হয়তো। ঠিক তখনই মনে হলো সেও তো আমাকে কষ্ট দিয়েছে। কাঁচা ফুটোয় হৃদয়হীন হয়ে প্রচন্ড ব্যাথা দিয়েছে। আমার নাক এখনও ব্যাথার জানান দিচ্ছে। ভাবনার মাঝে নীরবের কন্ঠস্বর কানে এলো। ভাইয়ের পা দেখতে ব্যাস্ত সে। তাকে দেখে আমার দরদী ভাবটা যেন মুহূর্তেই উবে গেলো। হুট করে তীব্র জেদ জেগে উঠলো মনে। বেশ করেছি। বেইমানটার পা ছেঁচে দিয়ে আমি কোনো ভুল করিনি। মনকে কঠোর সুরে বলে দিলাম, আমি তাকে ঘৃণা করি। সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আমার মন নিয়ে খেলেছে। সেই মানুষটার জন্য আমার মন যেন আর আবেগে না ভাসে। মনকে এক ঝাঁক বুঝ দিয়ে তাকালাম হৃদের দিকে। তার চোখের মণি আমাতেই নিবদ্ধ। আমি মুচকি একটা হাসি দিলাম তার চোখে চোখ রেখে। নীরব ভাইয়ের পা যত্নের সাথে শুভ্র কাপড়ে মুড়িয়ে দিচ্ছে। বলা হয়নি, আমার স্বামী এবছর এমবিবিএস শেষ করেছে। বর্তমানে সে দু চারটা ক্লিনিকে কর্মরত আছে। আগামী মাস থেকে স্থায়ী ভাবে হসপিটালের মেডিসিন বিভাগে যোগ দেবে। এজন্যই বুঝি বাবা আগে, পরে পরিস্থিতি না ভেবে এই ডাক্তারের হাতে হস্তান্তর করেছে আমায়।

— ভাইয়ার কি করে আপনার এমন দশা হলো?

ঢংগী সুরে ছুঁড়ে মারলাম প্রশ্ন। হৃদ অপ্রকাশ্য রাগে যেন ভেতরে ভেতরে দুমরে মুচড়ে যেতে লাগলো। আমি হঠাৎই অনুভব করলাম মন আমার বেজার আনন্দ চেপে রেখেছে। একটু আগে তার কষ্টে কষ্ট হলেও এখন হচ্ছে না। জেদ আর প্রতিহিংসার আগুন মনে প্রত্তুজ্জ্বল।

— হ্যা ভাইয়া তোর পা এমন হলো কিভাবে?

নীরবের প্রশ্নে হৃদ দিষ্টি ফেরালো আমার থেকে। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে সত্য লুকিয়ে বলে উঠলো

— আর বলিস না। রাতে অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে টেবিলের সাথে হোটচ খাইছি।

নীরব হেসে উঠলো। পা থেকে চোখ না ফিরিয়ে বলল

— টেবিলের সাথে হোটচ খেয়ে এমন হবে? উপরে ক্ষত হয়েছে। কোন মেয়ের পায়ের নিচে পরছিলা ভাই?

নীরবের শেষোক্ত কথায় কেঁপে উঠলাম আমি। যদিও তার কথার সুরে ছিল মজার ছল। মা হেসে উঠলেন। অতঃপর কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন

— তুইও কম না। বড় ভাইয়ের সাথে ফাজলামি সাজে?

দু মা ছেলে মেতে উঠলো হাসিতে। এদিকে শাশুড়ির বড় ছেলে শুকনো মুখে, রাগত চোখে যেন গিলে ফেলতে চাইছে আমাকে। আমি হাসলাম। তার এহেন চাহনি অনুসরণ করে সম্মুখের প্লেটটা উল্টিয়ে নিজের কাছে টেনে নিলাম। শাশুড়ি আর তার ছোট ছেলের চোখে ধুলো দিয়ে বড় ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্লেটে হাত ঘুরালাম। কালিহীন অদৃশ্য চিত্তে হাতের আঙ্গুল দিয়ে লেখার ভঙ্কি করলাম, ‘ Tit for tat’

.
তল্পিতল্পা গুটিয়ে এই দুপুরে আমি ফিটফাট। নিয়মানুযায়ী আজ নতুন বউ বাবার বাড়ি যাবে। ব্যাস্ত হয়ে তৈরি হচ্ছি আমি। খালা শাশুড়ি, মামা শাশুড়ি সবাই এসে হাজির। সারাদিনে অবশ্য এদের চোখে পরেনি আমার। বাড়িটা শুনশান নীরবতায় ঢাকা ছিল। জানি না কোত্থেকে এসে হাজির হলো। মনে কোতুহল নাড়া দিয়ে উঠলো। নীরব বিছার এক কোণে বসে ফোন ঘাটছে। দ্বিধা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। জানার ইচ্ছে হচ্ছে আত্মীয় গুলো কোথায় ছিল।

— একটা কথা বলি?

বহু চিন্তাভাবনা করে আড়ষ্টতার উর্ধ্বে গিয়ে ছুড়েই দিলাম প্রশ্নটা। নীরব তাকালো আমার দিকে। ফোন বিছানায় রেখে বলল

— বলো।

— আত্মীয়রা কোথায় ছিল সারাদিন?

— মামার বাসায়। সব আম্মুর সাইডের আত্নীয়। মামা বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। আমাদের ফ্লার্ট ছোট হওয়ায় তারা ওখানে থেকেছে।

আমি বুঝতে পেরে ছোট করে উচ্চারণ করলাম

— ওহ।

নীরব মুচকি হাসলো। বিনিময়ে আমিও হাসলাম। অতঃপর সে ভীষণ চমকপ্রদভাবে বলল

— এবার আমি ককটা কথা বলি?

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম

— বলেন।

— আমার ক্লিনিকে যেতে হবে। আর্জেন্ট অপারেশন।

নীরবের কথায় আমি ভাবশূণ্য হয়ে গেলাম হঠাৎ। কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার নিস্তব্ধতায় সে কি ভাবনা বুনলো জানি না। তবে মুখে বলল

— আমি যাবো তোমাদের বাসায় কিন্তু লেট হবে। তুমি সবার সাথে চলে যাও। আমি ওখান থেকে পৌঁছে যাবো।

আমি হালকা করে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। কিন্তু তার যেন আমার প্রতি দায়িত্ববোধটা একটু বেশিই কাজ করলো। অজানায় সে আমাকে ভয়ঙ্কর বিপদে ঠেলতে ঠেলতে বলল

— দাড়াও ভাইয়াকে বলছি। তোমার সাথে যাক।

.
শা শা করে বাতাস এসে জাপ্টে পরছে মুখে। গাড়ির গ্লাস খুলে রেখেছি আমি। ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভারের গুরু দায়িত্ব পালন করছে আমার ভাসুর। কোনো প্রকার আড়ষ্টভাব উপলব্ধি করতে পারছি না আমি আমার মাঝে। বাঁকা নয় সোজা চোখে ঝট করে তাকালাম হৃদের দিকে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলাম

— গাড়িটা কি আপনার শশুড়ের?

আমার প্রশ্নে হৃদ ক্ষণিকের জন্য নজর ফেরালো আমার দিকে। মুখটা তার চুপসানো। তিক্ত স্বরে বলল

— হ্যা।

আমি ভ্রু উঁচিয়ে ফেললাম তার কথায়। মুখে বললাম

— বাহ! খুব ভালো। কিসে পড়ে ভাবি?

— এইচএসসি দেবে।

— এতো ছোট? ছোটদের কি বউ বানানো যায়?

আমার প্রশ্নে হৃদ হুট করে গাড়ি থামিয়ে দিলো। এ গাড়ির যাত্রী শুধু আমি আর সে। আকস্মিক গাড়ির গতি রোধ হওয়ায় আমি ছিটকে সামে ঝুঁকে গেলাম। মাথাটা ঠাস করে লাগলো গাড়ির সাথে। হালকা ব্যাথা হলেও ভরকে গেছি আমি। বন্ধ হয়ে গেছে আপনা আপনি চোখ জোরা। রয়ে সয়ে মাথা তোলার জন্য প্রস্তুত হতেই হৃদের আক্রমনের শিকার হলাম। আত্না কেঁপে উঠলো আমার। নির্দয়, নিষ্ঠুর হৃদ আমার চুলের মুঠি চেপে ধরেছে। তার বলিষ্ঠ হাতের শক্ত টানে গা নড়ে উঠলো আমার। চুল বুঝি সব ছিড়ে ফেলবে দয়াহীন পাষাণটা। আমি স্থির হয়ে গেলাম। সুই পরিমাণ নড়ে ওঠাও যেন আমার সম্ভব হচ্ছে না। মাথার ব্যাথায় চোখে জল নেমে এলো। এমন সময় তার ফিসফিস কন্ঠ

— খুব বলিস টিট ফর ট্যাট। কার সাথে লাগতে এসেছিস তুই। দেমাগ বেড়ে গেছে তাই না?

চলবে…..

ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here