টিট ফর ট্যাট পর্ব-১৪

0
2961

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_১৪

— নীলিমা? এই নীলিমা……. এই উঠ। পানি ঢালবো মুখে? আম্মুকে ডাকবো?

উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়েছিলাম। শান্তির ঘুমে বিড়াট বাগড়া দিতে আপু হাজির। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে বললাম

— সর তো আপু। আমি ঘুমাচ্ছি ডিসটার্ব করবি। আমি তোর বাচ্চাকাচ্চা রাখতে পারবো না। হিসু করে দেয় খালি।

কথাটা বলে কোলবালিশ আঁকড়ে নতুন করে আয়োজন করলাম ঘুমানোর। সকালে আপুর দু’মাসের ছেলেকে কোলে নিয়েছিলাম। এক প্রকার জোর করেই দেয়া হয়েছিল আমাকে। আমি বাচ্চাদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখি। কারো সাথে ওদের ঝামেলা না হলেও নীলিমার চুল, কান, জাপড় ওরা টেনেটুনে এলাহি কান্ড করে দেয়। অফার হিসেবে মেশিনটাও চালিয়ে ভিজিয়ে দিতে ভোলে না।

— তোর ডাক্তার ফোন করেছে।

— তুই যাবি আপু? আমার এখন অন্য ডাক্তারের পরামর্শ লাগে না। আমি এখন নীরবের ওষুধ খাই।

চরম বিরক্ত নিয়ে বললাম। আমার ঘুমের সাথে সবার এতো শত্রুতা কেন বুঝিনা। ভয়ানক দুঃখ নিয়ে, দ্বিতীয় বারের মতো ঘুমানোর মুড নিয়ে যেই না চোখ বন্ধ করবো ওমনি মস্তিষ্ক যেন চকিত হলো। মুখের উপর ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছে কোনো এক দয়দ মায়দ হীন আল্লাহর মানব। আমি লাফ দিয়ে উঠে পরলাম। আপু হো হো করে হেঁসে যাচ্ছে। আম্মু শক্ত মুখে হাতে কাঁচের গ্লাস নিয়ে দাড়িয়ে আছে আমার সম্মুখে। মা হয়েও এমন নিষ্ঠুরতা সাজলো তার?

— মা হয়ে এমন অবিচার করতে পারলা মেয়ের সাথে?

আমি অবুঝ শিশুর মতো মায়াময় কন্ঠে বললাম। কিন্তু কাজে এলো না। বরং আরো শক্ত হলো আম্মুর মুখের অভিব্যাক্তি। ভয়ঙ্কর কোনো ভুল কি করেছি আমি? ভাবতে লাগলাম আকাশ পাতাল এক করে। কিন্তু এমন কিছু তো মনে পরছে না? তাহলে আম্মুর হঠাৎ এমন রেগে যাওয়ার কারণ? ভাবছিলাম আড়চোখে চেয়ে। তখনই আম্মু তীব্র রাগ নিয়ে বলে উঠলো

— কি সমস্যা তোর? শশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে আসছিস কেন? মাথার চিকিৎসা করাতে হবে তোর? সকাল আটটার সময় তুই একা একা বাপের বাড়ি ঢ্যাংঢ্যাং করে চলে আসলি। তোকে বললাম কাউকে বলে এসেছিস? তুই কি বললি? আম্মু
আমি শাশুড়ি মাকে বলেছি। এই বেয়াদব যার সাথে বিয়ে দিয়েছি তাকে বলিসনি কেন?

আম্মু শেষ কথাটা ছুড়ে দেওয়ার সাথে একটা থাপ্পড়ও ছুঁড়ে দিলো পায়ে। আমি চমকে উঠলাম। জেরিন বাড়ি থেকে বিদায় হওয়ার সাথে সাথেই আমি মা কে বলে চলে এসেছি। নীরব কি ফোন করেছিল? আম্মুকে কি বলেছে? স্ক্রু ঢিলা ডাক্তার আম্মুকে কিছু না বলে আমার ফোনেও তো ফোন দিতে পারতো। জাতে মাতাল তালে ঠিক এইভাবে ফেঁসে দিলো।

— এতো বড় একটা মেয়ে তার কিনা কান্ড জ্ঞান নেই। আশ্চর্য! আজ দু দিন হলো বিয়ে হতে না হতেই মেয়ের জামাই ফোন করে বিচার দেয় আমার কাছে। আমি তো বুঝতেছিই না এই মেয়ে কেমনে সংসার করবে। এই তুই এখনো বেআক্কেলের মতো বসে আছিস? উঠ… উঠে রেডি হ। তাড়াতাড়ি এখনই তুই তোর শশুর বাড়ি যা। শান্তি দিলো না পোলাপান।

একনাগাড়ে বকবক শুরু করেই যাবে আম্মু। এমনই! আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম আপুর দিকে। মুখ ভার করে ধমকে উঠে বললাম

— তোর জন্য হইলো। এত্তো গুলা বকা দিলো আম্মু। নীরব ফোন করেছে এই কথাটা বললে কি হতো? উমমম… আবার ঢং করে বলে তোর ডাক্তার ফোন দিয়েছে।

ভেংচি কেটে বললাম। আপু রক্ত চক্ষু নিয়ে চাইলো আমার দিকে। এটাও এখন কথার ফোয়ারা চালাবে। আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে ভাবনায় ডুব দিলাম। হৃদপিণ্ড তুমুল ছোটাছুটি করছে। নীরব কি চিঠিটা পড়েছে? দেখেছে? মুহূর্তেই আমার মনে হলো আজ তো তার অবসর। ইশ! নিজেকে পৃথিবীর ভয়াবহ গাধী মনে হচ্ছে। আমি জেনে বুঝেও কেন এপ্রোনের পকেটে চিঠি রাখলাম। সে কি সত্যিই পড়েনি চিঠি? নাকি পড়েছে বলেই আম্মুর কাছে ফোন করেছিল? আম্মুকে কি কি বলেছে ফোনে?

.

— আম্মু উনি তোমাকে কি কি বলেছে?

প্রচন্ড ব্যাস্ততা নিয়ে আম্মু আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিলো। হঠাৎ আমি তাকে প্রশ্ন করে যেন আগুনে ঘি ঢাললাম। আম্মু গোছাতে গোছাতে প্রচন্ড মেজাজ নিয়ে বলল

— তোমার উনি বলেছে তুমি তাকে না জানিয়েই বাড়ি থেকে বের হয়েছো। সে ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বউ উধাও। তার বাসাতেও কেউ নেই। তার মা ফোনটাও ফেলে গেছে। তোমার ফোনে ফোন দিয়ে দিয়ে সে হয়রান। তোমাকে তো কাজের সময় পাওয়া যায় না।

কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ আম্মু নুইয়ে পরলো। চোখে মুখের রাগ উবে গিয়ে জন্ম নিলো প্রীতি। সে মুচকি হেঁসে তাকালো আমার পানে। বলল

— ছেলেটা অনেক টেনশনে ছিল বোধহয়। গলার স্বরটা কেমন অদ্ভুত ছিল। এমন পাগলামি আর করিস না মা। কিছু হলে দুজনে মুখোমুখি বসে সব ঠিক করে নিবি। মনে চেপে রাখবি না কিছু। চেপে রাখলে বিষয়টা আরো খারাপের দিকে যায়। আর একটা কথা সবসময় মানবি। স্বামীকে না বলে কিছু করবি না, কোথাও যাবি না। তার হাতে তোকে তুলে দিয়েছি। এখন সেই তোকে শাসন করবে, আদর করবে, ভালোবাসবে।

আম্মুর কন্ঠ ভেজা ভেজা। আচমকা কোত্থেকে যেন কান্নারা এসে ভীর জমালো মনে। চোখে আমার নেমে এলো অশ্রু। আমি হুট করে জরিয়ে ধরলাম আম্মুকে।

— আমি কি তোমাদের এখানে আসবো না?

আমার কথায় আম্মু সিক্ত চোখে হেঁসে উঠলেন উচ্চস্বরে। মাথায় হাত রেখে বললেন

— কেন আসবি না পাগলি? আমার কি ছেলে আছে? তোদের দু’বোনেরই তো বাড়ি এটা। তোরা আসবি কিন্তু জামাইদের থেকে অনুমতি নিয়ে আসবি। ঠিক আছে?

আমি হালকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম আম্মুর কথায়। দুমিনিট ওভাবেই জরিয়ে রাখলাম আম্মুকে। একটু পর আম্মু তাড়া দিয়ে বলে উঠলো

— নে তাড়াতাড়ি। তোর ডাক্তার রাগ করেছে। আমায় কি বলল জানিস? ” মা নীলিমা কে বলে দিয়েন ও যেন আমার যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে না। সে নিজ ইচ্ছায় নিজের পায়ে গেছে। আবার যেন সেভাবেই দশ মিনিটের মধ্যে বাসায় আসে।” হা হা। নীলিমা আমি অবাক হয়েছিলাম। ছেলে তো বেশ কড়া। অবশ্য তোর মতো বোকার জন্য ঠিক আছে।

আম্মুর কথায় আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। ছিহঃ! ডাক্তারটাও না? স্ক্রু ঢিলা। আমি এহেন লজ্জা মুহূর্তের সমাপ্তি টানতে বলে উঠলাম

— আম্মুউউউ! আজ বাবা বাসায় নেই বলে তুমি এভাবে পচাচ্ছ আমাকে।

আমার কথার ধরনে আম্মু ও আপু বুঝি বেশ মজা পেলো। দু’জনেই যগপৎ হেসে উঠলো। আমি শুধু অসহায়ের মতো গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ভীষণ রাগ হচ্ছে ডাক্তারের উপর।

.
শশুড় বাড়ির দরজাটা মৃদু ধাক্কা দিতেই খুলে গেছে। আমি ভেতরে প্রবেশ করে হাতের ব্যাগটা প্রথমেই রাখলাম ড্রইংরুমের এক কোণায়। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। কিভাবে যাবো নীরবের সামনে? লজ্জা আর সংকোচে যেন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছি। পুরো ফ্লাট জুড়ে শুনশান নীরবতা। আমি হিজাবের পিনগুলো খুলতে খুলতে এগিয়ে গেলাম সোফার কাছে। ভীষণ গরম। ফ্যান বন্ধুর সান্নিধ্য জরুরৎ। আধ বোজা চোখে পিন খুলতে খুলতে যেই না বসতে যাবো সোফায় ঠিক তখনই এক প্রকট ধমক। আমি তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে শঙ্কা নিয়ে চাইলাম সম্মুখে। মুহূর্তেই নজরে এলো নীরবের থমথমে মুখ। আমি অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। হাতে তার সচল ফোন। আমি যেন এক অবুঝ অবলা নারী হয়ে গেলাম। বেখাপ্পা এক বেকুবের পরিচয় দিয়ে হ্যাবলার মতো হাসলাম তার পানে তাকিয়ে। কিন্তু তার তমসাচ্ছন্ন বদনের কোনোরূপ পরিবর্তন হলো না। উপরন্তুর সে আমার কাছে কৈফিয়ত চেয়ে বসলো

— চিঠি লিখেছো খুব ভালো কথা। কিন্তু দৌড়ে বাবার বাড়ি যাওয়ার কারণ? কার অনুমতিতে গিয়েছিলে?

নীরবের কথার প্রত্যুত্তরে আমি অসহায়ের মতো চাইলাম তার দিকে। সত্যিই কি বোকামি করেছি? আচ্ছা, আসলেই আমি কেন গিয়েছিলাম বাসায়?

— কি হলো চুপ কেন? আমি তোমাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি? একবারও জানিয়েছো আমায়? আর এখন যে বাসায় ঢুকলা কার অনুমতিতে ঢুকলা?

— আপনাদের বাসায় ঢুকতে অনুমতি নিতে হয়? সরি আমি জানতাম না।

অত্যন্ত অপরাধী মনে কথাগুলো বলে বোকা বোকা চোখে লাফ দিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। যেই না এক পা ফেলল ওমনি নীরব হেঁচকা টান দিলো হাতে। আমি এক ঝটকায় আবার তার মুখোমুখি হয়ে গেলাম। এমন কেন করলো? আমি তো অনুমতি নিয়ে ভেতরে আসতে চাইছিলাম।

— কোথায় যাচ্ছো?

অতি রেগে কথা যেন চিবিয়ে ছুড়ে দিলো আমার স্বামী। আমি অবলা চোখে তাকিয়ে বললাম

— আপনি না বললেন ভেতরে আসতে অনুমতি লাগবে তাই…

— তাহলে এই মুহূর্তে যে তুমি আবার বাসার বাইরে যাচ্ছো তার জন্য অনুমতি নিলে না কেন?

নীরবের এবারের কথায় আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। কি অনুমতি অনুমতি খেলছে এই স্ক্রু ঢিলা ডাক্তার? আমার নিয়মানুযায়ী আমি হা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। সে দ্বিতীয় বারের মতো ধমকে উঠে বলল

— মুখ বন্ধ করো! হা করে তাকিয়ে থাকে। বোকা মেয়ে। মাথায় কি কখনো তেল দেও না? বুদ্ধি সুদ্ধি মনে হয় কিচ্ছু নেই। আমি কেন তোমাকে বিয়ে করেছিলাম বলো তো?

নীরবের বিরক্ত মুখের বাণী। এতোক্ষণ আমার কাজগুলো কাণ্ডজ্ঞানহীন হলেও এখন যেন আমার বুদ্ধি খুলে গেলো। হুট করে যেন থোকা থোকা বুদ্ধি উদয় হলো মস্তিষ্কে। ফট করে নীরবের প্রশ্নের জবাবে বললাম

— আপনার জীবন তেজপাতা করতে।

আমার অতি উৎফুল্ল মুখের সুন্দর বাণীটা নীরবের ভীষণ অপছন্দ হলো। সে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো আমার দিকে। আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম

— আপুর সাথে ঝগড়া বাজলে ভাইয়া এটাই বলে। ‘নিশি তোমাকে বিয়ে করে আমার জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেলো’

চলবে……

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আজকের পর্বটা বেশ অগোছালো হয়েছে। সরি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here