টিট ফর ট্যাট পর্ব-১৫

0
3471

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_১৫

— “শুনুন ডাক্তার, আপনি যখন জেরিন মেয়েটার দিকে তাকান তখন মনে হয় আমি পৃথিবী ছেড়ে ভিন্ন গ্রহে চলে যাই। যেখানে শুধু জ্বালাপোড়া। খাক হয়ে যায় আমার অন্তর।” তারপর….. “আমি নীরবময় অসুখে আবিষ্ট”

— দিস ইজ নট ফেয়ার ডক্টর।

দু’হাত কানে চেপে তীব্র লজ্জা নিয়ে বলে উঠলাম। ইশ! লজ্জায় চোখ খুলে রাখাও এক আহামরি কাজ হয়ে গেলো। রাত দশটা হবে। এমন সময় শেয়ান ডাক্তার আমার চিঠি হাতে নিয়ে পড়ে শোনাচ্ছে আমাকে। আমি রীতিমতো লজ্জার সাগরে নাকানিচুবানি খাচ্ছি।

— আহ! কি লজ্জা রে!

কথাটা বলেই নীরব হেসে উঠলো। আমি হুট করে কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলে উঠলাম

— কয়টা ভাত তুলে খায়িয়ে এখন প্রতিশোধ নিচ্ছেন?

নীরব আমার কথায় শোয়া থেকে উঠে বসলো। আমি তার মাথার পাশেই বসে আছি গোমড়া মুখে। সে চিঠিটা বিছানায় রেখে বলল

— এক প্লেটে ভাত খাবো বলে তুলে খাইয়েছি। যেন সেই ছেলের চেয়ে আমার উপর তোমার ভালোবাসা বেশি বর্ষিত হয়।

কথাটা বলেই চোখ টিপে দিলো সে। আমি যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এ বেচারা চোখ মারতে পাারে? অবিশ্বাস্য!

— আচ্ছা নীলিমা ছেলেটা কে?

আমি যখন বিশ্বাস আর অবিশ্বাস নিয়ে বিচারে মশগুল ঠিক তখনই নীরবের এমন অপ্রস্তুতকৃত প্রশ্ন। তাৎক্ষণাত আমার মুখটা গম্ভীর হয়ে এলো। ছলনায় দু’হাত কানে দিয়ে থাকলেও নামিয়ে নিলাম এখন। আহত, অপরাধী চোখে চাইলাম তার দিকে। হঠাৎ খুব আবেগ নিয়ে বলে ফেললাম

— এ কথার জবাব না দিলে হবে না ডাক্তার?

আচমকা আমার এহেন কন্ঠের বাঁকে নীরবের মুখও হলো রাশভারী। ক্ষণিকের জন্য চোখে মুখে ঠাঁই পেলো সেই গুরুতর আভা। অতঃপর সে আলতো করে আমার দু’হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল

— তুমি না বলতে চাইলে ডাক্তারের কোনো ইচ্ছে নেই শোনার। তবে আজ এখন এই মুহূর্তে তোমার কথা দিতে হবে নীরব ছাড়া তুমি অন্য কাউকে ভাবতে পারবে না। নীরবই তোমার অতীত হবে, নীরবই তোমার বর্তমান, নীরবই তোমার ভবিষ্যৎ।

আমি নিজের নাত ছাড়িয়ে পুনরায় আমি তার হাত আঁকড়ে ধরলাম। গভীর চোখে তাকিয়ে বললাম

— কথা দিলাম। এখন থেকে আপনিই আমার অতীত, আপনিই আমার বর্তমান, আপনিই আমার ভবিষ্যৎ। কিন্তু আপনিও কথা দিন। নীলিমাই আপনার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ।

আমার শেষের চঞ্চল কথায় নীরব মৃদু শব্দে হাসলো। একইরকম ভাবে সেও কথা দিলো আমায়। প্রত্যুত্তরে আমিও মুচকি হাসতেই হঠাৎ তার অবাক কান্ড। আনার হাত ছেড়ে সে নিজের হাত স্থানান্তর করলো আমার মাথায়। বিসমিল্লাহ বলে ফু দিলো একটা। মুখে বিরবির করে বলে উঠলো

— হে আল্লাহ আমার নীলিমার মন থেকে সেই ছেলেটা সম্পূর্ণ মুছে যাক, মুছে যাক, মুছে যাক।

তার এমন দোয়া ও আচরণ নিক্ষেপে আমি সশব্দে না হেসে পারলাম না। হেসে উঠলাম গলা ছেড়ে। বেচারা অল্পক্ষণ বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে পরখ করলো আমাকে। অতঃপর মাথা থেকে হাত সরিয়ে বড় করে একটা ফু দিতে দিতে ক্রমশ অগ্রসর হতে লাগলো আমার মুখের দিকে। মুহূর্তমধ্যে আমার মস্তিষ্ক সাংঘাতিক এক বার্তা নিয়ে ছুটে এলো। বেচারার নজর আউলা ঝাউলা। সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না তার ভবিষ্যৎ কাজ। আমি ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। মুখে বলে উঠলাল

— ছিহঃ লুচু ডাক্তার। ফু-র নামে ফাজলামি।

আমার কথায় নীরব হেসে উঠলো। এক হাতে আনার মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল

— আর তো আমার ঠোঁটের প্রশংসা করো না?

আনি লজ্জা এবং বিরক্ত নিয়ে চাইলাম তার দিকে। আমার মুখ থেকে তার হাতটা ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে বললাম

— ঘুমিয়ে পরেন। কাল সকালেই তো গ্রামে যেতে হবে। দুইদিন পর না ঈদ। তারপর আপনার ভাইয়ের বিয়ে। ঘুমিয়ে পরুন। অনেক কাজ আপনার।

কথাটা বলে ঝটপট শুয়ে পরলাম। স্বামী আমার টুট টুট দিল নিয়ে ঠাঁই বসে রইলো কিছুক্ষণ। বেচারা যেই হতাশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ঠিক তখনই এক বেঢপ বাণী ছুড়ে দিলাম তার উদ্দেশ্যে। দু’হাতে মুখ ঢেকে বলে উঠলাম

— ডাক্তার আমি দুইটা জমজ তুলতুলের মা হতে চাই।

কথাটা বলার ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে নীরব লাফ দিয়ে উঠে বসলো। ভালোভাবে বিছানায় পিঠ পরেছিল কিনা কে জানে? সে উঠে বসেই যক্ষা রোগীর মতো খুক খুক করে কাশি শুরু করলো। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে পরলাম। কি হলো? কেনো হলো? কিছুই না বুঝে হা হয়ে তাকিয়ে গিলতে লাগলাম তার নির্মম কাশির দৃশ্য। একই সাথে হাসি আর কাশি! এ কেমন উদ্ভট কান্ড তার!

.
মাথার উপর তেজি সূর্য নিয়ে সকাল আটটায় যাত্রা শুরু করলাম সবাই। হৃদের শশুর আব্বার গাড়িতে বসে যাচ্ছি। সবই ভালো লাগছে কিন্তু একটা মুখ আমার অন্তরের শান্তি কেড়ে নিয়েছে। জেরিন মেয়েটা আমাদের সাথেই যাচ্ছে। তার চেয়েও বড় বিতৃষ্ণার বিষয় হলো আমি তার পাশাপাশি বসে আছি। হৃদ আর নীরব বসেছে গাড়ির সম্মুখে। আমি, মা আর জেরিন আছি পেছনে। প্রচুর অশান্তি আর ক্ষোভে মন আমার ছটফটে। গাড়ি চলছে হৃদের নির্দেশময় গতিতে। সেই তখন থেকে মেয়েটা পলকহীন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অস্তিত্বে যেন মর মর দশা আমার। কি দেখে এতো?

— কে কামড়িয়েছে ঠোঁটে?

দৃষ্টি রেখেছিলাম কারের স্বচ্ছ কাঁচে। হঠাৎ জেরিনের এমন অশোভন কথায় হুট করে দৃষ্টি স্থানান্তর করলাম তার পানে। বুঝতে অসুবিধা হলো না সে কুৎসিত মন নিয়ে হৃদকেও ইঙ্গিত করেছে। আমি শঙ্কিত চোখে তাকালাম গাড়িতে অবস্থিত বাকি তিনজন মানুষের দিকে। নাহ! তার কন্ঠ একটু নিচু ছিল। হাফ ছেড়ে বেঁচে উঠে মুখের ভয়ের ছাপ টেনে সরিয়ে চকচকে চোখে চাইলাম জেরিনের দিকে। মা ঘুমিয়েছে। হৃদ গাড়ি চালাতে ব্যাস্ত। আমি ফিসফিস করে জেরিনকে বললাম

— আপনার প্রাক্তন, আমার স্বামী। আমরা আসলে ফ্যামেলি প্লানিং করছি।

কথাটা বলে তার মনে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে দেওয়ার প্রচেষ্টায় একাটা মুচকি হাসি দিলাম। আমার কথা বুঝি জেরিনের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলো। সে থমকে গেলো সেকেন্ড কয়েকের জন্য। রাগে পরিপূর্ণ দুইটা চোখ নিয়ে যেন ভস্ম করতে চাইলো আমায় তার চাহনিতে। আমি দ্বিতীয় বারের মতো একটা হাসি দিয়ে সামনে তাকাতেই ভরকে গেলাম। অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখে। হৃদ আহত নয়নে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ড্রাইভিং-এ তার মন নেই। সম্মুখে অসংখ্য গাড়ি। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম হৃদের নাম ধরে। সকল মানুষের যেন হুঁশ ফিরলো। মা জেগে উঠলেন। নীরবও হয়তো ঘুমোচ্ছিলো। সে চমকে উঠে তড়িঘড়ি করে হৃদের হাতের উপর হাত দিয়েই গাড়ি কন্ট্রোল করে থামিয়ে দিলো এক পাশে। হৃদ এলোমেলো দৃষ্টিতে চাইলো সবার দিকে। সে যেন কান্ডজ্ঞানহীন, দিশেহারা হয়ে গেলো। ক্ষণিক মাথা নিচু করে পরক্ষণেই আবার চাইলো আমার পানে। তার সরু দৃষ্টির তাক বুঝতে আমার কষ্ট হলো না। সে অপলক আমর ঠোঁটের ক্ষতে চেয়ে আছে। আমি এহেন দশা এড়াতে তড়িঘড়ি করে মুখের উপর হাত দিলাম। নীরবের দৃষ্টি রসহ্যের আঁচ বোঝায়। হৃদ হঠাৎ ডেকে উঠলো আমায়

— নীলিমা?

এ যেন ছলকে পরা আবেগের কন্ঠ। আমি চমকে উঠলাম। সর্বনাশ? ও যদি ভুল সময়ে ভুল কিছু বলে? রাগ হলো ভীষণ জেরিন মেয়েটার উপর। কড়া এক ঘৃণ্যময় দৃষ্টি এক সেকেন্ডের জন্য জেরিনের দিকে তাক করে নীরবের উদ্দেশ্যে বললাম

— আমার বমি বমি লাগে কারে। সাফোকেশন হয়। আমি নামবো।

আংশিক মিথ্যে ঝটপট বলে উঠলাম। নীরব মুহূর্তেই সব চিন্তা ফেলে ব্যাস্ত হয়ে বলল

— বমি আসছে এখন? নামবা?

পাশ থেকে শাশুড়ি মা ধমকে উঠলেন হৃদকে।

— সাবধানে গাড়ি চালাবি না? মেয়েটার বোধ হয় মাথা ঘুরে উঠেছে।

হৃদের কোনো হেলদোল নেই। তার হৃদয়ের দগদগে ক্ষত যেন চোখের দৃষ্টিতে পরিস্ফুট। আমি নেমে পরলাম গাড়ি থেকে। নীরবও নামলো। মা বলে উঠলেন

— তুই নীলিমাকে নিয়ে অন্য একটা ব্যাবস্থা করে না হয় আয়। আমরা যাই। ও বাড়িতে অনেক কাজ আছে। মা তুমি কিছু মনে করো না। তুমি নীরবের সাথে এসো। একটু রেস্ট নিয়ে আসো।

কথাটা বলে মা মুচকি হাসলেন। আমি অনেক বেশি খুশি হলাম। মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদে ভাসিয়ে দিলাম মাকে। এমন একটা পরিকল্পনা করেই আমি গাড়ি থেকে নেমেছি।

চলবে…..

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here