#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_৫
হৃদের হিস হিস ধ্বনির বিপরীতে প্রচন্ড রাগ জেগে উঠলো মনে সেই সাথে পাল্লা দিয়ে আগমন ঘটলো ঘৃণার। সে একই ভাবে আমার চুল শক্ত করে ধরে আছে। আমি যেন দিশেহারা হয়ে পরছি। মন তুমুল অশান্ত হলো তাকেও আঘাত ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। বেপরোয়া মন চাইলো পা কাজে লাগাতে, হাত দিয়ে তার হাতে প্রগাঢ় ক্ষত তৈরি করতে। কিন্তু থেমে আছি শুধুমাত্র বুদ্ধির জন্য। এ মুহূর্তে আমি তারসাথে প্রতিদ্বন্দ্বে পেরে উঠবো না। খামোখা বোকার পরিচয়ে নিজেকে না জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। সময় আমারও আসবে।
— খবরদার বলে দিচ্ছি আমাকে জ্বালাতন করবি না। ভাইয়ের বউ হয়ে এসেছিস, থাক। কিন্তু আমার সাথে লাগতে আসিস না।
কথাটা বলেই সে আমার মাথা তুলে মুখোমুখি করলো তার। দৃষ্টি তার আগ্নি ঝড়া। আমি নিচুস্তরের মানুষটার এবারের বাণীতে মুখের দ্বার রুদ্ধ রাখায় সক্ষম হতে পারলাম না। চোখ থেকে তীব্র ঘৃণা নিক্ষেপ করে বলে উঠলাম
— আমি তো রোমান্সটাই করিনি এখনো তোমার ভাইয়ের সাথে।তবুও এতো জ্বলে কেনো? ভুল করে ভালোবাসা হয়ে গেছে নাকি।
কথাটা যেই না মুখ থেকে ছুড়ে দিয়েছি ওমনি সে হাতের নিবর্তন অধিক শক্ত করলো। মুখে কিছু বলতে গিয়েও অতি আক্রশে তার বাঁক এলো না মুখে। আমি হাসলাম। গলা ছেড়ে বেশ উঁচু স্বরে পাগলের মতো হেসে বললাম
— ইউ রিয়েলি সিলি ম্যান। নিলীমাকে কি মনে করেছিলে? তোমার শোকে কান্না করে জীবন থমকে দেবে? আমি কি ন্যাকা সুরে বলবো, ‘ আআআআআআ আমার হৃদ আমায় ঠকিয়েছে, তবুও তুমি ভালো থাকো প্রিয়, খুব ভালোবাসি, অবহেলা শেষে ডাক দিও আবার তোমায় আপন করবো।’ কিন্তু না প্রিয়, আয়াম নট চিপ গার্ল….. আই হ্যাভ সেল্ফ রেসপেক্ট।
অন্ত কথাগুলো আত্মজাহির করে বলতেই তার হাতের বাঁধন ক্রমশ ঢিমা হলো। আমি পলকহীন তাকিয়ে আছি তার চোখের দিকে। তার চোখে হার মানার শঙ্কা। মুখে চিন্তার ছাপ। হয়তো ভাবছে সে কি হেরে গেলো? আমি মুচকি হাসছি। আমার বিড়াল চোখের রূপ এতোক্ষণে নিশ্চয়ই হিংস্র হয়ে উঠেছে। আপন ভাবনার মাঝেই কানে বেজে উঠলো হৃদের শান্ত কন্ঠ
— তোর চোখ দেখে সত্যিই আমি আজও ভয় পাই।
আমার চুল থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে সামনের মানুষটা। তার বাঁকা ছিল মোহময়। কেঁপে উঠেছি আমি। কে যেন মনে হলো আমার মনের দাবানলে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছে। মুখাবয়বের কঠোরতা,মনের জেদের পাটাটা নিলীন হতে আরম্ভ করলো। চোখের দৃষ্টিতে শান্ত ভাব নেমে এসেছে। বুকটা হু হু করে উঠলো। হৃদের দিকে হঠাৎই আবেগ তাড়িত হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম
— সত্যিই কি আমায় কখনো ভালোবাসোনি?
আমার আকস্মিক প্রশ্নে সে আমায় দর্শন না করে পারলো না। সেকেন্ড দুই তাকিয়ে দেখলো আমাকে। কিন্তু মুখ ফুটে একটা বাঁকও ঝড়লো না তার। সামনের কাচের পানে অনিমেষ অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো সে। নিচু করে নিলাম আমি মুখ। কেন এসেছে এই মুহূর্ত? কেন রঙিন দিন, লক্ষণগুলো বিবর্ণ হলো? কেন বিচ্ছেদ হলো? দু মাসের জমিয়ে রাখা কষ্ট উতলে উঠলো মনে। চোখের কোণে অশ্রু নেমে গেলো আমার। সে কি তিন বছরে একটুও ভালোবাসেনি আমায়? দগ্ধ হওয়া হৃদয় যখন এমন প্রশ্ন তুলল তখন আমার আঁখি বাধ ভাঙলো। উথাল-পাতাল দুঃখের রেশ ধরে হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠলাম। থামাতে পারলাম না হৃদয়ের আবেগ, আত্মসম্মান ভাঙার মুহূর্ত। দুহাতে মুখ চেপে অঝোরে চিৎকার করে কাঁদছি। মন ভীষণ জেরা করতে চাইছে মানুষটাকে। কেন সে ভালোবাসলো না আমায়? কার জন্য এই ছোট নিলীমার আবেগ, ভালোবাসা, পাগলামো হেয় করলো সে? প্রতিদিন কেন এই নিলীমা আরশিতে তার চোখ দেখতে ভয় পায়? কেন তার বারংবার মনে হয় এই বিড়াল চোখের জন্য একসময় কেউ পাগল ছিল তার জন্য? সবই কি তার নাটক ছিল তবে? তিন বছর এমন নিখুঁত নাটকও করা যায়?
.
চোখ ফুলে গেছে, কপাল ফুলে গেছে, মাথার ব্যাথায় ছটফট লাগছে। কিন্তু কেউ খবর নিতে আসেনি। আম্মু ভীষণ ব্যাস্ত নীরবকে নিয়ে। আপু ব্যাস্ত তার শশুর বাড়ির লোকজন নিয়ে। বাবা এদিক ওদিকে সামলাতে ব্যাস্ত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নতুন করে অশ্রুপাতের প্রহর গড়েছি। কিছুতেই মন মানছে না। কান্না যেন আপনা আপনি চোখ ভেসে দিচ্ছে। সবার উপরের অভিমান জট পেকে গলায় এসে দলা পেকে আছে যেন। আমি উপর হয়ে শুয়ে এবার হাউমাউ করেই কেঁদে দিলাম। মা বাবাও পর করে দিলো? আমার কপালের ফুলো, চোখের ফুলো কারো নজরে ধরা দিলো না? আছরের সময় হয়ে এলো তবুও কেউ খেতেও ডাকছে না। আমি আসলেই হয়তো অবহেলিত। ভাবতে ভাবতে কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেছে। বালিশে মুখ গুঁজে অশান্ত মন নিয়ে অঝোরে কাঁদছি। ‘থাক তোরা তোদের মতো। কেউ ভালো না। আমি একাই থাকবো। ‘ কথাগুলো শব্দ করে বলে উঠলাম। অত্যন্ত রেগে গেলে, অভিমান হলে এমন করেই বলে উঠি আমি। কিন্তু আজ বলে যেন দুঃখের মাঝে ভয়াবহ বিপদে পরলাম। আমার পেছনে যে নীরব থাকবে এ কথা কে ভাবনায় আনতে পারে? সে এসে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে শ্রবণ করেছে আমার কথা। অতঃপর আমায় অপ্রস্তুত করে দিয়ে বলে উঠেছে
— একাই থাকবা? ভুতে ভয় পাও না?
নীরবের কন্ঠে আমি চমকে এক লাফে উঠে বসেছি। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। এতো জাতে মাতাল তালে ঠিক! কোত্থেকে এলো এই সেয়ান? আমি সাড়াশব্দ হীন অবলা চোখে তাকিয়ে আছি তার দিকে। সে এগিয়ে এলো, বসলো বিছানায় আমার পাশ ঘেঁষে। দেখলাম ভ্রুটা কুঁচকে ফেলেছে। কেউ কি বিশ্বাস করবেন? তাকে দেখে আমার এই মুহূর্তে হিংসা হলো! বেচারার ঠোঁট দুইটা ভয়ঙ্কর সুন্দর। মেয়েদেরও হার মানাবে।
— কান্না করছো কেন?
হঠাৎ প্রশ্নে চোখ ফিরালাম স্বামীর থেকে। ঘোর কেটে আবারও প্রবেশ করলাম তিক্ত স্মৃতিতে। মনটা নিমেষেই পুনরায় ভার হলো। ঝটপট চোখের পানি মুছে নিয়ে বললাম
— কিছু না।
— তাহলে এভাবে বিছানায় শুয়ে কাকে গালি দিচ্ছেন?
আমি লজ্জা পেলাম এবার। নীরব পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি নত মুখে বললাম
— মন খারাপ।
— কেন?
— এমনি।
— আজব? এমনি কারো মন খারাপ হয়? এভাবে গোমড়া মুখে বসে থাকলে তোমার বাবা মা ভাববে আমি তোমায় মেরেছি। ভালোবাসবোনা হয়তো তাই বলে এই মিথ্যা অপরাধ আমি….
কথার মাঝে হুট করে থেমে গেলো নীরব। আমি ঝট করে মাথা তুলে চাইলাম তার দিকে। তার চাহনিতে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। সে দেখছে আমার ব্যাথায় বিবশ কপাল। অবুঝের মতো হাত রাখলাম আচমকা কপালে। নীরব থামলো না, বুঝলো না আমার অপ্রস্তুত ভাব। সে বেজায় চিন্তিত সুরে জানতে চাইলো
— কি হয়েছে ওখানে? কিভাবে ব্যাথা পেয়েছো?
তার চঞ্চল কন্ঠে বুকটা আমার ধ্বক করে উঠলো। কি জবাব দেবো? তার ভাইয়ের জন্য ব্যাথা পেয়েছি? আমার ঘোলা চোখের মণি দুইটা ছোটাছুটি করতে লাগলো দ্বিধায়। আমতা আমতা করে বললাম
— ঐ দরজার সাথে আসলে কিভাবে যেন ধাক্কা খেয়েছি।
কথাটা বলেই আবারও কপালে হাত রাখলাম। সে হয়তো সরু চোখে দেখছে আমায়। আমি মুখ উঁচিয়ে তার চোখে চোখ রাখার দুঃসাহসিকতা দেখালাম না।
— রান্না ঘরে যাবে। তারপর ঝট করে বরফ নিয়ে আসবে। যাও।
— কেন?
অবুঝ চোখে তাকিয়ে তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম। সে বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে ফেলল। আমার দিকে কড়া দৃষ্টি তাক করে আদর্শ স্বামীর ন্যায় বলল
— ব্যাথা পেয়ছো বরফ দিবা না তুমি?
আমি বুঝতে পেরে নিষ্পাপ মেয়ের মতো বললাম
— ওহ। তাই তো।
সে আমার কথার পৃষ্ঠে টেনে টেনে বলল
— হুম
হঠাৎ আমি কেমন এলোমেলো হয়ে গেলাম। তার দিকে তাকিয়ে বেকুবের মতো একটা হাসি দিয়ে বসলাম। তার উপর হঠাৎ করে বেখাপ্পা এক প্রশ্ন করলাম
— আচ্ছা আপনার দিকে হসপিটালের নার্সরা কেমন করে তাকায়? আপনার ঠোঁটের দিকে কি বেশি তাকায়?
প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে সে যেন পাথর হয়ে গেলো। নিশ্বাস নিতে যেন বেমালুম ভুলে গেলো সে। আমি এখনো বেকুবের মতো অবুঝ দৃষ্টি তাকে দান করছি। তার চোখ হঠাৎ বেরিয়ে আসার মতো হলো। মৃদু চিল্লানিতে সে আমার ঘর কাপিয়ে দিয়ে বলল
— মানেহহহ?
তার চিৎকারে আমি নড়ে উঠলাম। হুটোপুটি খেয়ে বিছানা থেকে নেমে পরলাম। ছিহঃ নির্বুদ্ধিতার কান্ডটা এখন যেন বুঝতে পারলাম। হুঁশ ফিরতেই বলে উঠলাম
— কিছু না।
বলেই দৌড়। কি অসভ্যময় কৌতুহল। ছুহঃ লাজে যেন মর মর দশা হলো আমার। দৌড়াতে দৌড়াতে পণ করে বসলাম। আগামী তিন ঘন্টার মধ্যে নিলীমা নীরবের সম্মুখে যাবে না। মন থেকে রায় নামা নিয়ে ছুটে রান্না ঘরে প্রবেশ করলাম। দরজার সম্মুখে এসেই আরেক ভয়াবহ কান্ড বেঁধে দিলাম। আম্মুর সাথে ধাক্কা লেগেছে। ফলস্বরূপ তার হাতের কাচের বাটি মেঝেতে পরে আত্নহত্যা করলো। আমি আর এখানেও ঠাঁই পেলাম না। আম্মুর রেকর্ড ভাঙা গালিগালাজ শুরু হওয়ার আগেই দৌড় দিলাম ছাদে। চিলেকোঠার ঘরটাই একমাত্র সুরক্ষার ঘর আমার জন্য।
চলবে…..
( বাবার কাজ শাসন করা। সন্তানের কাজ শোষণ হওয়া। তাই বলে গল্প লেখার নেশা দমাতে পারিনি। এই মুহূর্তে চলে গেলে আপনারা আর মনে রাখবেন না আমাকে 🙂। গল্প দিতে যদি দেরি হয় বা একদিন মিস হয় একটু মানিয়ে নিয়েন প্লিজ 🥺)