টিট ফর ট্যাট পর্ব-৬

0
3902

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_৬

জানি না এখন ক’টা বাজে। মাগরিবের নামাজ পরে শাশুড়ির সাথে খাওয়ার পাঠ চুকিয়েছি। ওরা দু’ভাই বাসায় নেই। নীরব হসপিটালে আর হৃদের অবস্থান আমার অজানা। খেয়ে অলস আমি ঢুলতে ঢুলতে বিছানায় শুয়েছিলাম একটু। হাই তুলতে তুলতে দেখি বেহাল দশা। ঘুম এসে অত্যন্ত ভালোবেসে জাপ্টে নিয়েছিল আমায়। এমন ভালোবাসা ঘুমপাগলি নিলীমা কিভাবে উপেক্ষা করবে? সুযোগ লুফে নিয়ে যেমন তেমন হয়ে বিছানায় ঠাস করে চোখ বন্ধ করলাম। রাতে ঘুমের দেখা পেলেও পুরুষ দেহের বিদ্যমানতায় ঘুম কে ঢেলে সরিয়ে দেয় অস্বস্তি। লজ্জা লাগে যে তার পাশে ঘুমোতে। কিন্তু পুরুষ জাতি কিভাবে ঘুমোয় কুম্ভকার্ণের মতো? একেবারে বেঘোরে ঘুমোয় যেন পানির উপর বরফ ঢাললেও তার ঘুম ছোটানো দুর্বোধ্য কাজ। হয়তো এই সময়ে আমিও এভাবেই ঘুমোচ্ছিলাম। কিন্তু হায় হতাশা! আমার শান্তির ঘুম সইলো না নীরবের। সে এসে আচমকা টানাটানি, ঠেলাঠেলি শুরু করে দিয়েছে। আমি ঘুমের মাঝে ভীষণ বিরক্ত হলাম। এক চোখ ঈষৎ খুলে তাকালাম। নীরবের গলায় স্টেথোস্কোপ দুলছে। কাঁধের উপর এপ্রোন। আমি উল্টে গিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নিলাম। কিন্তু এ যেন কেমন লোক! আমার আরাম, দুঃখ, কষ্ট বুঝলো না। এবার হাত ধরে টেনে তুলল। কিন্তু আমি চোখ তুলতে পারছি না ঘুমের দরুন। অলস মস্তিষ্ক বিভোর ঘুমে। মন বলছে নীরব আমায় টেনে বিছানায় বসিয়েছে। হাতটা হয়তো ধরে আছে। আমি ঝুলছি সাম্যাবস্থায়। এমন সময় তার ক্ষুব্ধ বাণী কানে বেজে উঠলো

— নিলীমা? আমি উঠতে বলেছি কিন্তু। এশার আজান দিয়েছে নামাজ পরতে হবে না?

আমি নীরবের বাণীতে একটা হা করলাম। ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে কি বললাম নিজেও তা ঠাহর করতে পারলাম না। ঠাস করে আবার গা ছেড়ে দিলাম বিছানায়। তলিয়ে গেছি মুহুর্তেই শান্তির প্রহরে। তিন মিনিট আর কোনো ডিসটার্ব এলো না অপর পক্ষ হতে। কিন্তু পাঁচ মিনিটের মাথায় এক ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হলাম। নিশ্বাস নিতে পারছি না আমি। মনে হচ্ছে নাকের ফুটো গায়ের হয়ে গেছে। মস্তিষ্ক আমার মুহূর্তেই সচকিত হয়ে উঠলো। ঝড়ের বেগে ঘুম তাড়িয়ে তড়িৎ বেগে চোখ মেললাম। দৃষ্টিতে ফুটে উঠলো এক আহতময় কান্ড। কান্না পেলো আমার। ফোস ফোস করে উঠলো মেজাজ। নীরব বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে একখানা হাসি দিলো। মাইয়া ঠোঁট ওয়ালা, জাতে মাতাল তালে ঠিক, গাছেরও নিলো তলারও কুড়ালো। একটু আগে সে আমার নাক চেপে ধরেছিল। ভাবা যায় কি ভয়ংকর লোক? আমি ছলছল নয়নে বলে উঠলাম

— আমি ঘুমাবো? কেন আমার ঘুম ভাঙালেন?

আমার মৃদু চিৎকারের কন্ঠে তার মুখে গাম্ভীর্য নেমে এলো। এপ্রোনটা বিছানায় রেখে বলে উঠলো

— অসময়ে কে ঘুমায়? এখন এশার আজান দিচ্ছে। ওঠো, নামাজ পরো।

আমি কোনো ভাবাবেগ আনলাম না মুখে। পূর্বের ন্যায় গোমড়া মুখে তাকিয়ে আছি। আমার ঘুম কেনো ভাঙানো হলো? এটা আমি মানতে পারছি না। বাসায় যখন আমি ঘুমাই তখন কেউ আমার ঘুম ভাঙানোর সাহস করে না।

— ফ্রেশ হতে যাচ্ছি। এসে যেন দেখি তুমি উঠেছো।

আমার ঘুম ভাঙানোর মহৎ কাজ পরিপূর্ণ করে হেলতে দুলতে চলে গেলো আমার দায়িত্ববান স্বামী। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পানে। আচমকা মনে জেদ চেপেছে। শয়তান যেন কানে কানে বলে গেলো ‘ ডোন্ট মুভ নিলীমা ‘। ধপ করে শয়তানের ফাদে পা ফেলে বেয়াদবের মতো শুয়ে রইলাম। ঠোঁট দুটো আক্রশে ফুলে উঠেছে আমার। চোখ দুইটা বন্ধ করে পুনশ্চ টোপলা টাপলি নিয়ে পারি জমাতে চাইলাম ঘুমের দেশে। আধা ঘুম লেগে গেছে চোখে। আর একটু সময় হলেই ঘুমে কপোকাত হয়ে যেতাম। কিন্তু আকস্মিক আমি চোখ খুলতে বাধ্য হলাম। মস্তিষ্ক দ্রুত সংবাদ প্রেরণ করে গেলো আমি শূন্যে ভাসছি। হাত, পা কোমর ভাঙার আশঙ্কা শীর্ষে। ভয়ে চটজলদি চোখ খুললাম। ঘুম গোল্লাই যাক। আমার সুস্থ থাকা অত্যয়।

.
হায় রে ঘুম! আপন গাল আপনি খুব করে লাল করার ইচ্ছে হচ্ছে। বেজায় বিরক্ত আমি নিজের উপর। এতো ঘুমের উৎপত্তি কোথায় বাপ? এই ঘুমের জন্য এখন আমার অহরহ মোশার মাঝে জগৎ-সংসারের ভয়াবহ দুঃখিনী হয়ে দাড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বাইরে। একটু আগে নীরব পাজাকোলে করে এনে অবলীলায় রেখে গেছে বারান্দায়। আমি অসহায়ের মতো পাঁচবার ডেকেছি তাকে। প্রতিবারেই বদ্ধ দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসে

— নামাজ না পরলে বাইরেই থাকতে হবে।

তার কথার প্রত্যুত্তরে হাশফাশ করে তাকাই আমি চারদিকে। মৃদু আলো থাকা সত্ত্বেও কে যেন কানে কানে বলে ‘ ওরা এলো, ডান থেকে, বামে থেকে, পেছন থেকে, সামনে থেকে’। এমন কথা মনে উঠতেই চিৎকার করতে গিয়ে আবার থমকে যাই। মশা গুলো যেন এর মধ্যে আমায় বিড়াট অফারের সাথে কামড়ে যাচ্ছে। নাহ! এবার থাকা অসহ্য আমার কাছে। আবার ডেকে উঠলাম নীরবকে।

— দরজাটা খুলুন প্লিজ। আমি নামাজ পরবো। বিশ্বাস করেন আর কখনো মাগরিবের পর ঘুমাবো না। প্লিইইজ।

আড়ষ্টভাব নিয়ে অপরাধীর মতো বলে উঠলাম। কিন্তু এবার চরম হতাশ হলাম আমি। কোনো সাড়াশব্দ এলো না ওপাশ থেকে। নামাজে দাড়িয়ে গেছে কি? ধুর! আজাইরা! এখানে আর দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই। ভাবতে ভাবতে পেছন ফিরে চলে গেলাম বারান্দার লাইটের কাছে। আলোয় নিশ্চয় ভুত প্রেত আসবে না। এমন এক বোকা বোকা ভাবনা নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। কিন্তু আমি যে ভুলেই গেছিলাম ভুত না আসলেও এক মুঠো মর্মযন্ত্রণা আমার পিছু ছাড়বে না। এ বাড়ি মানে হলো আমার ‘যন্ত্রণা কুঞ্জ’। যে খানে প্রাক্তন আছে সেখানে আনন্দ কি করে স্থায়ি হতে পারে?

আমি বরাবর ঠিক বামে নিজ রুমের সম্মুখে দাড়িয়ে আছে হৃদ। কানে তার ফোন। মৃদু মন্দ আলোয় চোখে ধরা দেয় তার প্রেমাসক্ত বদন। হাসছে কি সুন্দর করে। সুধা যেন পান করছে সে। আমার বুকটা মুচড়ে উঠলো। মুহূর্তেই অনুমতিহীন জমে গেলোো চোখে অশ্রু। সে এখন অন্য মেয়েকে জান, কলিজা ডাকে। অভীমানে সিক্ত হওয়া চোখ মুছে দেয় নিশ্চয়ই পরম যত্নে। রাতের পর রাত জেগে গল্প করে অন্যকারো সাথে। দগ্ধ হৃদয় নিয়ে ভুল ভালোবাসার মানুষটার দিকে তাকিয়ে ভাবতেই হঠাৎ এই নিঝুম রাতে চোখে পরলাম তার। হৃদ আমার দিকে তাকাতেই ঝটপট মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তার অগোচরে চোখ মুছে নিলাম। অতঃপর অদম্য ইচ্ছা দমাতে না পেরে আড় চোখে একবার তাক করলাম দৃষ্টি তার দিকে। অপ্রস্তুত ভাব বুঝি তার মুখ ছুয়ে গেছে। হাতের ফোনটা নামিয়ে নিয়েছে। সেও আড়চোখে পরখ করছে আমায়। আমি ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলাতে ব্যাস্ত হয়ে পরলাম। হাজারো স্মৃতি মনে উঁকি মারে এই মানুষটাকে দেখলে। আমার স্মৃতি চারণের মাঝে হঠাৎ ক্যাট ক্যাট শব্দ তুলে দরজা খুলল নীরব। তড়িঘড়ি করে চোখ মুছলাম শাড়ির আঁচলে। জানি না কোন উদ্দেশ্যে একবার চাইলাম হৃদের দিকে। সে এগিয়ে এসেছিল আমার নিকট। হঠাৎ ভাইয়ের আগমনে থমকে গেছে। এমন হলো তার সে সেখানে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকা বৈ অন্য কোনো উপায়ান্তর পেলো না। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। নীরবের দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমাকে দেখতে ব্যাস্ত। আমি কিছু না বুঝে ঝটপট একটা হাসি উপহার দিলাম তাকে। সে হাসির পিঠে চোখ গরম করে বলল

— এখানে দাড়িয়ে থাকতে হয় এতোক্ষণ? আম্মুর ঘরে গিয়ে তো নামাজ পরতে পারতে। হাইরে… এতো মশার মধ্যে কেউ দাড়িয়ে থাকে।

হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে বলল সে। আমি অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি না আমার অবস্থা। অজানা কারণে ঠোঁট উল্টে উঠছে বারংবার। গলা যেন কেউ চেপে ধরেছে। নীরবের দর্শনে আর আদর মাখা কথায় কান্না ঠেলে ঠুলে আসছে আমায় গ্রাস করতে। প্রাণপণে চেষ্টা করেও আটকাতে পারলাম না কান্না। হঠাৎ নীরবকে আশ্চর্য করে দিয়ে আকড়ে ধরলাম তার পিঠ কাকড়ার মতো। ঝট করে বুকের উপর হামলে পরলাম। গলা ছেড়ে আপসে কান্নাকাটি জুড়ে দিলাম। নীরব বুঝি ভীষণ অবাক হলো। আমার পেছনের হৃদের কি বুকে আগুন জ্বলে উঠলো?

চলবে…..

ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here