টিট ফর ট্যাট পর্ব-৭

0
3201

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_৭

নীরবের অবাক প্রহর কাটলো বেশ খানিকক্ষণ পরে। আমায় জরিয়ে নিলো দু’হাতে। বুকের সাথে শক্ত করে জাপ্টে ধরে টেনে নিতে চাইলো আমায় ঘরে। আমি কান্নার বেগ থামাতে পারছি না। তার বুকের উপর থাকা পাঞ্জাবির একাংশ ভিজে উঠেছে আমার নয়ন জলে। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ আমার আন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমশ। আমার বুঝতে গাফলতি হলো না যে শ্বাসকষ্ট তেড়ে আসছে আমার দিকে। ভয়ে খামচে ধরলাম নীরবকে। আমার হঠাৎ আক্রমণে থমকে গেলো নীরব। বুকে আঁচড় পরলো কি? ভাবতে গিয়ে মাথা তুলে চাইলাম নীরবের দিকে। তার চোখ জোরা বন্ধ। আমার এবার অপরাধবোধ আর কষ্টে আরো কান্না এলো। শ্বাসকষ্ট যেন সুযোগ পেয়ে জরিয়ে নিলো আমায়। চোখ দিয়ে গলগল করে পানি আসছে। আমি নীরবের দিকে তাকিয়ে হাপাতে লাগলাম। কিছু বলতে চাইছি কিন্তু মুখে আনতে পারছি না। আমার দশা অনুভব করে নীরব ঝট করে মাথা তুলল। কান্নার বেগ তুমুল বেড়ে গেলো আমার। কিন্তু কান্না করলে যে শ্বাসকষ্ট আরো বেশি হবে?

— কি হয়েছে নিলীমা? এমন করছো কেন? এই নিলীমা? নিলীমা?

নীরবের ভয়ার্ত কন্ঠ। আমি চোখের অশ্রু ছাড়া অন্য কিছু তাকে দান করতে পারছি না। নীরব আমার মুখটা উঁচু করে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। অস্থির কন্ঠে শুধালো

— ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। তোমার শ্বাসকষ্ট আছে? শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?

আমি ঝটপট মাথা ঝাঁকালাম। তার গলায় এক হাত রেখে অন্য হাতে ইশারায় বুঝালাম আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। নীরব বুঝে গেলো আমার বাকহীন কথা। বলল

— চমি এখনই ওষুধ আনছি।

কথাটা বলে সে আমায় ঘরের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলতেই হয়তো হৃদ নজরে এলো। আমায় একহাতে জরিয়ে নিয়ে পেছন ফিরে বলল

— ভাইয়া, আম্মু যদি জেগে থাকে তাহলে আম্মুকে একটু আসতে বল প্লিজ।

হৃদ কিংকর্তব্যবিমূর হয়ে তাকিয়ে রইল আমাদের পানে। আমি তাকে দেখে হঠাৎই ইচ্ছে করে আরো জরিয়ে ধরলাম নীরবকে। নীরব যত্ন করে আমায় রুমে সোফায় বসিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেলো নিচে। বলে গেলো

— কান্না স্টপ করো। এই যে হালকা করে ফ্যান করে দিয়ে গেলাম। গা টা ঘেমে গেছে। কান্না স্টপ… না হলে কষ্ট হবে আরো। আমি যাবো আর আসবো।

পাঁচ তলা বাসার নিচের তলাতেই মার্কেট। নীরব সেখানেই ওষুধ আনতে গেলো। আমি গলায় হাত রেখে হাশফাশ করছি। মনে পরে নিজের বোকামি। হৃদের সাথে যেদিন সম্পর্কের ইতি হলো সেদিন বাসায় এসে পুরো রাত ঝর্ণার পানির সাথে পাল্লা দিয়ে চোখের পানি ফেলেছি। তার পরের দিনই ভীষণ জ্বর সেই সাথে আগমন ঘটে নব ওষুধ শ্বাসকষ্টের।

— গরম পানি।

ভাবনার মাঝে আচমকা হৃদের কন্ঠ। কর্নকুহরে যেতেই আমি ঝট করে তাকালাম সম্মুখে। হৃদের হাতে একটা কাচের গ্লাস। চোখে পরছে তাতে ধোঁয়া ছাড়তে থাকা পানি। হালকা ধোঁয়া বায়ুতে দুলছে। আমি বিষ্ময় আর অবুঝ চাহনিতে ভ্রু কুঁচকাতে ভুললাম না। কষ্ট করে শ্বাস টানতে টানতে সরু চোখে তাকে দেখছি। সে সরল দৃষ্টিতে আরো এক কদম অগ্রসর হলো আমার অভিমুখে। কাশি উঠে গেছে আমার। কথা কিছু এসে আটকে রইলো গলায়। হৃদ আমার পাশে সোফায় আসন নিয়ে নরম সুরে বলল

— হালকা গরম পানি। এটা খাও।

আচ্ছা ঘাতকের মুখে এমন কথা শোনার পর আমার কি করা উচিত? আমার অবজ্ঞার হাসি হাসতে ঢের সাধ জাগলো। মনে চাইলো হো হো করে ঘর কাপিয়ে হাসি। কিন্তু পারছি না শ্বাসকষ্ট নামক ব্যাথিটার জন্য। অত্যন্ত কষ্ট করে শুধু ওষ্ঠাধর প্রসারিত করলাম। অস্থির, কাঁপতে থাকা হাত বাড়িয়ে দিলাম গ্লাসের দিকে। হৃদ নির্মল, নিষ্পাপ একটা হাসি দিয়ে এগিয়ে দিলো গ্লাসটা। তার চোখ যেন আমার জন্য ব্যাথার মিছিলে লিপ্ত। আমি হাতে গ্লাস টা ধরতেই সে আরো একটা মায়াময় বাণী বলে উঠলো।

— খুব কষ্ট হচ্ছে?

ঠিক যেভাবে আমায় নীরব আদর করে শুধায় তারই অনুরূপ হৃদের কন্ঠ। আমি প্রত্যুক্তি না করে সরল৷ চোখে চেয়ে রইলাম। হাতের গ্লাসটা মন্থর গতিতে এগিয়ে নিলাম আপন মুখের দিকে। সে শুকনো একটা হাসি দিলো। আমার রাগ শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খুঁচিয়ে উঠলো। জেদ হলো প্রচন্ড। কি ভাবে ঐ বেইমান? আমি ওর দেয়া পানি খাবো? মনের মধ্যে তুমুল রাগ নিয়ে হঠাৎ ছুড়ে দিলাম গ্লাসটা অজানায়। ঘরের মাঝখানে গ্লাসটা ঝনঝন ধ্বনিতে টুকরো হলো। আমি কড়া চোখে নজর ফেরালাম হৃদের দিকে। প্রচন্ড অবাকতা বিলীন হয়ে তার মুখে জায়গা হচ্ছে রাগের। আমি তাকে জ্বালিয়ে দিতে কষ্ট করে আরো একটা হাসি দিলাম। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। স্থির থাকতে পারছি না কিছুতেই। কাশির দরুন অবস্থা নাজেনাল। হাতটা গলায় চেপে চোখ বন্ধ করলাম। বড় একটা শ্বাস নেওয়ার প্রচেষ্টা করতেই আচমকা নির্মম আক্রমণ। প্রস্তুত ছিলাম বটে। ধরেছে হয়তো অসুখ তাকেও দেবো বিসুখ।

হৃদ দাঁড়িয়ে আছে আমার সম্মুখে। সল্প ফাঁকে তার মুখ। ডান হাতটায় রেখেছে আমার গাল। চেপে ধরে অতি আক্রশে বলল

— দয়া করে এনেছিলাম পানিটা। নিজ হাতে গরম করে আনলাম। ভেবেছিলাম….. তোর জেদ কখনো ফুরাবার নয়।

কথাটা বলে একটা ঝাড়ি দিলো আমার মুখ। পেছন ফিরে উদ্ধত হলো প্রস্থান করার। কিন্তু নিলীমার পাটকেল মারা যে বাকি আছে? তাকে প্রচন্ড অবাক করে দিয়ে তার স্বপ্নেও ভাবনাতীত ভাবনাকে ডেকে এনে তাকে ঠাস করে মেঝেতে ফেললাম। আমার পা দিয়ে তার পাটা ঘুরিয়ে স্লিপ কাটাতে বাধ্য করলাম। মুখটা এসে পরেছে আমার পাশে। সোফার উপর। পাটা শক্ত মেঝেতে শব্দ করে পরেছে। বেশ ব্যাথা পেয়েছে মনে হচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাবার হলো আমার শ্বাসকষ্টও কমতির দিকে। মুখমণ্ডল আমার নেত্রজলে সিক্ত। বিড়াল চোখের মণিতে হিংস্রতা এ আমি জানি। আরো গাঢ় করলাম চাহনি। ফিসফিসয়ে প্রাক্তনের কানে পৌছে দিলাম

— এতো কেন আদর তোমার মনে? তাও আবার আমাকে নিয়ে?
টক্সিকহার্ট, আমি তোমার সাথে টিট ফর ট্যাট গেম খেলতে এসেছি। তুমি কি খেয়াল করেছো? ইউ হ্যাভ ফিলিংস ভর নিলীমা!

.
— নিলীমা, রাগ হচ্ছে কিন্তু। তুমি ওষুধ খাবে কিনা।

কাচুমাচু মুখে বসে আছি বিছানায়। কিছুতেই আমার ওষুধ খেতে ইচ্ছে করে না। নীরব তখন থেকে সামনে ওষুধের প্যাকেট রেখে সাধাসাধি করেই যাচ্ছে। পার পেতে কতবার বলছি আমি পরে খেয়ে নেবো আপনি যান ডিনার করেন। কিন্তু শেয়ানটা সরছেই না সামনে থেকে। আমি তো বাসায় মাকে এভাবেই ফাঁকি দওতাম। জানালা দিয়ে ওষুধ টুপ করে নিচে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে আম্মুকে গিয়ে ভাব নিয়ে বললাম

— আম্মু আমি ওষুধ খেয়েছি। আমি তো আর তোমার বড় মেয়ের মতো না।

কিন্তু এমন ভুজুংভাজুং নীরবকে বোঝাতে কোনো ভাবেই সক্ষম হচ্ছি না।

— নিলীমা, এতো রাতে আমি কষ্ট করে না খেয়ে নিচে গিয়ে তোমার জন্য ওষুধ আনলাম আর তুমি খাচ্ছো না। বিরক্ত হচ্ছি কিন্তু। তুমি ব্যাপক ফাজিল। বাসায় নিশ্চয়ই নিয়ম করে ওষুধ খাওনি তাই এখনো শ্বাসকষ্ঠ সারে নি।

নীরবের এবারের কথায় ঝট করে মাথা তুলে চাইলাম তার দিকে। বেচারা তো বহুত বোঝে! কিন্তু ওষুধ খেলে যে আমার বমি পায়।

— ওষুধ খেলে আমার বমি আসে।

কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম কথাটা। আমার করুণ চাহনিতে নীরব বশ হলো কিনা বুঝলাম না। সে বোধ হয় ব্যাপক হতাশ হলো। ধপ করে বসে পরলো বিছানায়। একটু পরে দেখি ওষুধ বুটাচ্ছে। আমার আত্মা হাশফাশ করে উঠলো। মনে হচ্ছে এবার কেঁদেই দেবো আমি। নীরব আলগোছে এক মনে ওষুধ নিলো হাতে। অপর হাতে নিলো পানির গ্লাস। অতঃপর গম্ভীর মুখখানা নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল

— হা করো।

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। চোখ দিয়ে বাকহীন বুঝালাম, ‘আমার খেতে ইচ্ছে করে না ‘ কিন্তু আমাকে তোয়াক্কা না করে সে একটা ধকম দিয়ে বলল

— হা করতে বলছি।

আকস্মিক ধমকে চমকে উঠে অটোমেটিক আমার মুখ হা হয়ে গেলো। সে ওষুধ গুলো মুখের মধ্যে ছেড়ে পানি মুাকের কাছে ধরে বলল

— খাও।

আমি সেকেন্ড পাচেক ছলছল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম মুখে ওষুধ নিয়ে । আমার চাহনিতে সে বিরক্তিকর একটা দৃষ্টি উপহার দিলো আমায়। দ্বিতীয় একটা ধমক মুখ নিসৃত হতেই চোখ বন্ধ করে টুপ করে গিলে ফেললাম ওষুধ। আমার বদ্ধ চোখের ওপারে সে বিরবির করে বলে উঠলো

— বিয়ে ভালো মানুষ করে? দেনমোহর দিয়ে জীবন ত্যানা ত্যানা করার জিনিস কিনে আনছি রে ভাই।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here