টিট ফর ট্যাট পর্ব-৯

0
3375

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_৯

গতরাতে ঝুম বৃষ্টি হয়ে আজ ভ্যাপসা গরমে থোকা থোকা রাগ তুলে দিচ্ছে এই গ্রীষ্ম খালা। সোনার দেশের সেই ছয় ঋতু বুঝি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সকালে গরম তো দুপুরে ভাসিয়ে ফেলার মতো বর্ষা আবার দেখা যায় রাতে কাথা ছাড়া ঘুমোনো মুশকিল। আবার যদি আপনি ফ্যানটা অফ করেন তো মনে হবে আগ্নেয়গিরির পাশাপাশি আপনার রুম। আর আমাকে তো গরম জ্বালা দেওয়ার জন্য আছেই। নীরবের বাসায় আসার পর থেকে একটা কথা ঘুরেফিরেই মনে হয়। বড়লোক বাপের মেয়েরা ন্যাকা হয়! আমি এ নিয়ে শোকাতুর! আজ বাবা বড় লোক বলে আদরে আদরে সত্যিই ঢংগী হয়ে গেছে নিলীমা। এই নিলীমা পরিবারের ছোট সন্তান বলে কোনো কাজে হাত দিতো না। কিন্তু আমি নিলীমা কি জানতাম? যেখন দিয়ে যে ভাবেই ঘুরি বউ আমার হতেই হবে। রান্নার ঘরে আসতেই হবে। মহিমান্বিত প্রধানমন্ত্রী, বিশ্ববিখ্যাত সুন্দরী কোনো মেয়েও যদি রান্না না পারে তাহলে তাকে মেয়ে উপাধি দিতে কষ্ট হবে জাতির। তাই মোট কথা রান্না শিখতে হবে, করতে হবে। সত্যি বলতে নারীর সৌন্দর্য ঘরে। বাইরে যতোই প্রফেশনাল পর্যায়ে সুখ্যাতি কেড়ে আনুক না কেন, ঘরোনি হিসেবে ঘরে সুনাম অর্জন করতে না পারলে বাস্তব সার্থকতা অর্জন করা যায় না। জগতের ধ্রুব সত্যগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে নিলাম। ডান হাতটা অপরিমেয় জ্বলছে। বুঝে গেলাম আমি অঘটন ঘটে গেছে। খুব বিপদে পরে শাশুড়ি মা ডেকে এনেছে আমায় রান্নায় সহায়তার জন্য। আজ সকাল আটটায় নীরবের ক্লিনিকে যাওয়ার কথা। অতি ব্যাস্ততার সাথে রান্না করেও হিমশিম খাচ্ছিলেন মা। তাই আমাকে একটু ডেকে এনেছে। কিন্তু আমি বেয়াক্কেল মেয়ে কি করলাম? পুটুস করে হাতটা ছুরির নিচে ফেলে দিয়েছি?

ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে চাইলাম হাতের দিকে। গলগল করে রক্ত আসছে। আমার লজ্জায় মাটির নিচে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি কি কোনো কাজ ভালোভাবে করতে পারি না? মা এখন কি ভাববে? আমি আস্তে করে ঘার ঘুরিয়ে চাইলাম শাশুড়ি মায়ের দিকে। উনি চুলোয় কি যেন নাড়ছেন। হাতের কাটা অংশে চাপ দিয়ে ধরতে চাইলাম রক্ত বন্ধ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু হলো আরেক বিপদ। চাপ দিতেই ব্যাথাতুর ধ্বনি বেরিয়ে গেলো মুখ থেকে। শাশুড়ি মা চমকে চলাকালে আমার দিকে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। মা চুলো বন্ধ করে তড়বড় করে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমি অগোছালো হাসলাম। তাকে শমিত করতে বলে উঠলাম

— একটু কেটে গেছে। আপনি তরকারিটা রাঁধেন আমি পেঁয়াজ কুচি করে দিচ্ছি মা।

আমার কথায় শাশুড়ি মা টেনে নিলেন আমার হাতটা। আমি বারবার গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সক্ষম হলাম না।

— কি মেয়ে তুমি বলো তো! কখন না জানি কেটেছে এখমো বসেই আছে। আমাকে বললে কি আমি মারবো? ছোট মানুষ আস্তেধীরে কাজ করবা। ইশ! রক্ত পরছে কত।

বিরক্ত আর শাসনের সুরে কথাগুলো বলে উঠলেন মা। আমার চোখ ভিজে আসছে ব্যাথায় আর শাসনে। মা রান্নাঘর থেকে আমায় বাইরে আনলেন। অতঃপর হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠলেন নীরবকে। নীরব এসে সেও এক ঝাঁক বকাঝকা করলো আমায়। আরো আমার মানসম্মত পানিতে অবিলম্বে ডুবিয়ে দিয়ে শাশুড়িকে জানিয়ে দিলো আমি গত রাতে বিছানা থেকে পারে গিয়েছিলাম। কি লজ্জার বিষয়! স্ক্রু ঢিলা ডাক্তার! এমন করে আমাকে লজ্জায় না ফেললে কি হতো না তার? তারউপর অবিরাম বকেই যাচ্ছে। আমি নাকি কোনো কাজই মনোযোগ দিয়ে করি না।

.
— নিলীমা হাত দাও।

কেঁদেকেটে অস্থির আমি। এখন শুধু বণ্যা আনয়নটাই বুঝি বাকি আছে। নীরব অত্যন্ত বিরক্ত আমার প্রতি। মুখ কুঁচকে হাতে তুলো নিয়ে বসে আছে। দশ মিনিট হলো জোড়াজুড়ি করছে হাতে ডেটল দিয়ে ব্যান্ডেক করিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু আমি দিচ্ছি না। ভয় লাগে। অনেক জ্বলবে আমি জানি।

— এদিকে এসো বলছি।

ঘর কাপিয়ে যেন ধমকে উঠলো নীরব। হাতের রক্ত পরা বন্ধ হয়নি। ব্যাথায় অস্থির লাগছে তার উপর এমন ধমক। আমার মুখ ধীরে ধীরে কান্নার অভিব্যাক্তি জমিয়ে আনলো। টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গাড়িয়ে পরলো। আমি বিছানার অন্যদিকে ঘুরে বসলাম নীরবকে বিপরীতে রেখে। সবসময় ডাক্তার বলে কি ভাব দেখাবে? ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছি। হাতের রক্তে শাড়ি ভিজে গেছে অনেকটাই। আমি এখনো কাটা, ফাটা, ইনজেকশন দেখে ডরাই বলে টিটিটিকা পর্যন্ত দেইনি। আম্মু টেনে হিঁচড়েও নিয়ে যেতে পারেনি।

চোখ বন্ধ করে কাঁদছিলাম আর নীরবের উপর রাগ উপড়ে ফেলছিলাম। ঠিক এমন সময় নির্দয়, পাষাণটা তুলে দিয়ে চেপে ধরেছে আমার হাত। না পেরে ভয়ে এবার ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলাম সব ভুলে। নীরব বুঝি একটু থামলো। ড্যাব ড্যাব করে তাকালো আমার দিকে। আমি কেঁদেই যাচ্ছি শব্দ করে। হাত জ্বলছে প্রচুর। নীরব দেখছে আমার কান্না। অবাক নয়নে হয়তো এটাই পর্যবেক্ষণ করছে যে আমি এতো বড় হয়েও ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদছি। কিন্তু আমি যে এভাবেই কান্নাকরি।

— তাকিয়ে কি দেখছেন। আমি এভাবেই কান্না করি। শব্দ ছাড়া কান্না করতে পারি না।

বোকার মতো হাত পা ছুড়ে তাকে অবলীলায় জানিয়ে দিলাম আমার স্বভাব। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কোনোভাবে বলে আবারও নতুন করে কান্নায় মন দিলাম। নীরব এবার আগের চেয়েও যেন বেশি স্তব্ধ হয়ে গেলো। ক্ষণকাল মৌন থেকে বলে উঠলো

— থাক বাবু কান্না করে না। এই তো হয়ে গেছে। এখন শুধু হাত বেঁধে দিলেই শেষ…. চকলেট এনে দেবো কান্না কোরো না।

নীরবের কথায় আমি হুট করে কান্না থামিয়ে দিলাম। সে আমার হাত অভিজ্ঞতার সাথে বেধে দিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে। সেই সাথে মুখে আছে তার বাচ্চা সামলানোর মতো বাণী। আমি মুখ ফুলিয়ে নিলাম। এমন করে বুঝ দেওয়ার মানে কি? আমি কি ছোট বাচ্চা? আবার চকলেটর লোভ দেখায়!

— আমি কি ছোট বাচ্চা? আপনি ছোট বাচ্চাদের মতো বুঝ দিচ্ছেন কেন?

নীরব আমার কথায় এমন একটা ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলল যেন সে সত্যিই ভয়ঙ্কর ভুল করেছে। সে তার পাতলা ঠোঁট দুটো হালকা ফুলিয়ে তুলে বলল

— সরি সরি। তুমি তো ছোট বাচ্চা নও। তুমি বড় বাচ্চা। কিন্তু আমি সত্যিই জানি না বড় বাচ্চাদের কিভাবে সামলাতে হয়।

বজ্জাত ডাক্তারের তিরস্কারে আমার ভীষণ রাগ হলো। কান্না পরিপূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়ে ঝাড়ি দিয়ে উঠে পরলাম তার সম্মুখ থেকে। থাকবোই না তার সামনে। আমি বড় বাচ্চা?

.
রাত বেশি না। আটটা কি নয়টা হবে। শাশুড়ি মা, নীরব আর হৃদ একপ্রকার পারিবারিক আলোচনার মধ্যে আছে। আমি নীরবের পাশে বসে দর্শকের গুরুদায়িত্ব পালন করছি। আলোচনার মূল বিষয় হৃদ আজ হঠাৎ করে মাকে জানিয়েছে সে ঈদের পূর্বেই বউ তুলে আনতে চায়। কথাটা যখন সে আমার সম্মুখে বলে তখন বুকটা মুচড়ে উঠেছিল আমার। এখনো এক ফালি ছটফটানি নিয়ে স্থির বসে আছি।

— হৃদ, ক’দিন পরে সুধাকে নিয়ে আসি? কিছু গোছানোর তো একটা ব্যাপার আছে। একটা ছেলেকে হুট করে বিয়ে করালাম আরেকটাকে তো আর হুট করে করানো যায় না। বড় করে অনুষ্ঠান করতে হবে। অনেক টাকার বিষয়।

শাশুড়ি মা শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সে ভাবেই খুব সুন্দর করে বুঝাতে চাইলেন হৃদকে। হৃদ মায়ের কথা শুনে আড়চোখে একবার দেখলো আমায়। অতঃপর কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেলো। হয়তো ভীষণ অস্বস্তিতে। মায়ের কাছে বউ নিয়ে তর্কাতর্কি করা নিশ্চয়ই লজ্জার বিষয়। আমি মুচকি হাসলাম। হৃদকে বুঝিয়ে দিতে চাইলাম আমার জন্য অতি শীঘ্রই ভাবি আনার দরুন আমি বেজায় আনন্দিত।

— মা ভাবিকে এনে দেন। আমি তো সারাদিন বাসায় একাই থাকি। আপনি তো স্কুলেই চলে যান।

নত মুখে মিনমিনিয়ে বললাম। চোরা দৃষ্টি চালাচালি হয়েছে হৃদের সাথে আমার। মা আমার কথায় ভাবনায় গম্ভীর হলো। এবার নীরব মুখ খুলল। সে আশ্বাস দিয়ে বলল

— আম্মু চাচাকে বলে সুধাকে আনার ব্যাবস্থা করো। টাকা নিয়ে সমস্যা হবে না। ইনশাল্লাহ হয়ে যাবে। আমি দেখছি।

কথাটা বলে নীরব হেলেদুলে চলতে লাগলো নিজ রুমে। আমিও উঠে দাড়ালাম। হৃদ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি অপ্রস্তুত হাসলাম তার চাহনির পিঠে। বুক থেকে কি যেন থমকে থমকে ধাক্কা দিচ্ছে গলায়। একসময় যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম সে এখন অন্যের আচলে বেঁধে যাবে। ভাবতেই বুকটা ভেঙে গুড়িয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু শক্ত আছি শুধু জেদের জন্য। দৌড়ে নীরবের ঘরে যেতে লাগলাম। খুব কান্না আসছে। কিন্তু আমাকে দৃঢ় থাকতে হবে। ছুটতে ছুটতে ভেবে নিলাম নীরবকে গিয়ে বলবো

— আমি কি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি? একটু কান্না করবো। আপনার বুকে মাথা রেখে কান্না করলে আমার মনটা অনেক হালকা হয়।

চলবে…….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here