তবু মনে রেখো
৩য় পর্ব
– মা এসব আদিক্ষেতা কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। একেই চোখের সামনে শিমুল ঘুরঘুর করছে, তার উপরে তোমরা বারবার ওকে আমার কাছে ঠেলে পাঠাচ্ছো। এইটাতো আমার নতুন বিয়ে নয় যে নতুন বউ এর মতো ওকে ট্রিট করতে হবে। এখন আবার ওকে নিয়ে ওর বাপের বাড়ি যেতে হবে, কেনো??
– দেখ ইফতি এতো কেনোর উত্তর আমার কাছে নেই, যেতে হবে ব্যাস যেতে হবে। এতো অবুঝ কবে থেকে হয়ে গেলি তুই!! আর ভুলে যাস না তোর বাবা আর আমি ওর বাবাকে জোর করে রাজি করিয়েছি অথৈর জন্য। তুই কালকে মেয়েটাকে রুম থেকে রাতে বের করে দিয়েছিলি, এটা যে কারোর চোখে পড়ে নি এমন কিন্তু নয়।
– কি ফাজিল মেয়ে রে বাবা!! এখন সে তোমাদের এগুলো বলেও বেরিয়েছে??
– ও বলে নি, ও কিছুই বলে নি। আমি ওকে অথৈর রুমে রাতে ঢুকতে দেখেছি। দেখ ইফতি, জীবন কারোর জন্য থেমে থাকে না। প্রতিটা মানুষ তার জীবনে একজন সঙ্গী চায়। তুই ও ব্যতিক্রম না। অথৈ এর বয়স এখন বাড়ছে, ওর একটা পার্ফেক্ট পরিবার লাগবে। এই কথাটা মাথায় রাখ। নিজের স্বার্থপরতা নিজের মেয়ের জীবনের কাল হতে দিস না। শিমুল মেয়েটা খুব ভালো। ওকে বকুলের জায়গা দিতে হবে না। দেখিস ও নিজের জায়গাটা নিজে বানিয়ে নিবে। আর তোরা আজ ওদের বাড়ি যাচ্ছিস এটা ফিক্সড, কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না।
আফসানা বেগম আর কথা বাড়ালেন না, উনার যা বলার তা বলা শেষ। ইফতি যাই করুক উনার কথার অমান্য করবেন না। উনি যাওয়ার পর ইফতি হাতে থাকা মোবাইলটা ছুড়ে ফেলে দিলো বিছানায়। মাথা রাগে ফেটে যাচ্ছে। মাথার রগ ফুলে গিয়েছে। সব তছনছ করতে মন চাচ্ছে। কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না। হাত দুটো দিয়ে মাথা চেপে ধরে বিছানায় বসে পড়েছে। বকুলের একটা বড় ছবি বেডরুমে বিছানার বিপরীতে লাগানো। ছবিটা ইফতির খুব প্রিয়। বকুলের ছবিটায় ওর দুষ্টু হাসিটা স্পষ্ট, চোখ মুখ উজ্জ্বল। এই মুখশ্রী কার না পছন্দ। ছবিটা যেন জীবন্ত, এখনি ইফতিকে বলে উঠবে,
” মার কথায় কিছু মনে করো না, জানোই তো মা একটু রাগী। তোমার জন্য ব্লাক কফি করে আনছি, কফি খেলে দেখবে মেজাজ খারাপটা আর থাকবে না। কথায় আছে, তিতায় তিতা কাটে”
বলে খিলখিল করে হাসবে। বকুলের চঞ্চলতা যেন ইফতির সর্বত্র ঘিরে ছিলো। কেন তার বকুলকে কেঁড়ে নিলো নিয়তি, কেন আল্লাহ তাকে তার ভালোবাসা থেকে দূর করে দিলো। এমনই যদি হওয়ার ছিলো কি দরকার ছিলো মায়া বাড়ানোর। বকুলের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে ইফতি, অজান্তেই চোখ থেকে পানি পড়ছে। সে জানে তার বকুল আর ফিরবে না; না ফেরার দেশে সে হারিয়ে গেছে। তবুও মন যে মানে না। আজ দু মাস পর ও বকুলের স্মৃতি আঁকড়ে আছে সে। ছবির দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে;
– হতে পারি স্বার্থপর, হতে পারি অবুঝ, হতে পারি সবচেয়ে নিম্নশ্রেণি কিন্তু দিন শেষে আমার বৃত্তের কেন্দ্র কিন্তু তুমি। তুমিহীনা আমি ভালো নেই, সত্যি ভালো নেই।
দুপুরের খাবারের জন্য সখিনা শিমুলকে ডাকতে এলে, শিমুলকে অথৈকে কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে। হালকা ডাক দিতেই শিমুল ধরফরিয়ে উঠে পড়ে।
– খালায় আপনারে ডাকছে ছোট ভাবী।
– তুমি খেয়েছো?
– না এখনো খাই নাই।
– ওহ, তাহলে ভাত নিয়ে এখানে একটু বসো কেমন। বাবু গভীর ঘুমে, কেউ না থাকলে হঠাৎ উঠে ভয় পাবে। ঠিক আছে?
– আইচ্ছা
সখিনা মেয়েটার বয়স খুব বেশি না, তেরো কি চৌদ্দ হবে। তবে মেয়েটা খুব চটপটে; বকুল নিজ উদ্যোগে ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলো। এবার সেভেন এ পড়ে। মেয়েটার কাজ একটু ঝটপট কিন্তু নিপুণ। শিমুলের বেশ লাগে মেয়েটাকে। তবে একটু বেশি বকবক করে; এই বয়সে এটা বেমানান তা নয়। কিন্তু কিছু কিছু সময় বিরক্তিকর ও লাগে।
খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত; বিয়ের কারণে যে আত্নীয়রা এসেছেন তারা খাবার পর চলে যাবেন। শিমুল এতো দেরিতে আশায় সবার ভেতর একটা কানাঘুষা ব্যাপার চলছে। আফটার অল বউ বলে কথা। আফসানা বেগম কাছে এসে বললেন,
– শিমুল তোমার নিশ্চয় ক্ষুদা লেগেছে?
– না মা, তেমন কিছু না। আসলে অথৈকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এতোটা বেলা হয়ে গেছে টের পাই নি।
– ভালো করেছো, তোমাকে সকালে একটু টায়ার্ড লাগছিলো।
– কি গো এসো, বউ মাকে দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি?? ( সিকান্দার সাহেব)
– মা আপনি বসুন, আমি বেড়ে দিচ্ছি।
– সেটার কি দরকার!!
– বসুন না মা
আফসানা বেগম বহু মানা করার পর ও শিমুলের কাছে তাকে হার মানতে হলো। সবাইকে বেড়ে দেওয়ার পর আফসানা বেগম তাকে জোর করে খেতে বসালো। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর আত্নীয় স্বজন বিদায় নিলেন। একদিকে যেন ইফতি হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। তাদের সামনে একরকম বউ বর খেলতে হচ্ছিলো। ইফতি নিজের রুমে যাবে তখন সিকান্দার সাহেব তাকে স্ট্যাডি রুমে যেতে বললেন। ইফতি ভালোভাবেই বুঝতে পারছে কি নিয়ে কথা হবে। তার বাবা অহেতুক কারনে তাকে ডাকে নি।
– ইফতি, বস। বসে কথা বলাটা দরকার।
– জ্বী বাবা, বলো শুনছি।
– হারুণ সাহেবকে আমি ফোনে বলে দিয়েছি তোরা সাড়ে চারটায় এখান থেকে বের হবি। It’s already 4 pm, I think you should hurry up. বউ মাকে বল রেডি হতে, মেয়েদের রেডি হতে টাইম লাগে।
– বাবা, অথৈ আর শিমুল গেলে হয় না?? অহেতুক আমাকে এর মধ্যে টানা কি খুব দরকার?
– শোন, মানুষ সামাজিক জীব। তার জীবন সমাজকে ঘিরে হয়। আমি জানি, তোর উপর আমরা চাপ সৃষ্টি করছি। কিন্তু সত্যি বলতে এটা অপ্রয়োজনীয় নয়। আজ দু মাস তুই অথৈকে কতোটুকু দেখেছিস? তুই বকুলের শোকে এতোটাই বিভর যে মাঝে অথৈ খেলতে যেয়ে চেয়ার থেকে পড়ে থুতনি ফাটিয়ে ফেলেছে, অথচ তোর খেয়াল নেই। মেয়েটা বাবা বলতে পাগল অথচ তুই ওকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছিস না। আচ্ছা, ওর এই বাড়তি বয়সে একটা পারফেক্ট পরিবার কি ওর প্রাপ্য নয়। মা বলতে মেয়েটা পাগল ছিলো, শিমুল অনেকটা নয় পুরোটাই ওকে সামলে নিয়েছে।এখন ও যদি দেখে ওর মামুনি আর বাবার মধ্যে সম্পর্কটা ভালো না দেখে, লাইক আদার চাইল্ড; ওর সাইকোলজিতে এটা কতোটা ইমপ্যাক্ট পড়বে তা তোর অজানা নয়। আর বন্ধু হয়ে যে দাম্পত্য কাটানো যায় না তাতো নয়। তোরা বন্ধু হ। ওকে ভালোবাসতে আমি বলবো না, তবে ওকে বন্ধুর জায়গাটা দে। এটা নিজের জন্য নয় অথৈর জন্য। Now go.
ইফতি তার বাবার কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো। একটি কথাও ভুল বলেন নি তিনি। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি পয়েন্ট একদম সঠিক। বলে না, বাবা-মা কোনোদিন ভুল হোন না। আমরাই কেনো জানে তাদের কথা বুঝতে চাই না। ইফতি শিমুলকে সকালে এতো উল্টোপাল্টা জিনিস বলেছে যে এখন তার সামনে যেতে মন খচখচ করছে। না পেরে সখিনাকে ডাকে সে।
– ভাইজান ডাকছিলেন?
– হুম, ভাবীকে গিয়ে বল রেডি হয়ে অথৈকে নিয়ে নিচে নামতে। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।
– জে আইচ্ছা ভাইজান। আর কিছু কমু?
– ওই ঠিকভাবে উচ্চারণ কর। ( ধমকের স্বরে)
– জ্বী আচ্ছা ভাইজান, আর কিছু বলবো?
– হুম এবার ঠিক আছে, না এটা বললেই হবে। এখন যা।
সখিনার এক সমস্যা, নিজের আঞ্চলিকতা ছাড়তে পারে না। মেয়েটা চাইলে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে কিন্তু বলে না। মাঝে মাঝে ইফতির ঝাড়ে যদি বলে। এছাড়া কুমিল্লা,খুলনা মিলিয়ে কিছু একটা মিশ্রভাষা বলে। বিগত আধা ঘন্টা যাবৎ ইফতি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, শিমুলের খোঁজ নেই। ইফতির মেজাজ বিগড়াতে লাগলো। এতো দেরি কেন হচ্ছে!! এই মেয়েকি তবে বিয়েবাড়ি সাজ দিতে বসলো?? আধা ঘন্টা পর, বকুল নেমে এলো অথৈকে নিয়ে। পরণে তার ক্রিম-গোল্ডেন মিহি কাজের জামদানী, শাড়িটা যেন হলদেটে ফর্সা গায়ের সাথে মিশে আছে। চোখে কাজল, চুল খোলা, বাতাসে চুলের সাথে কানের ঝুমকোটাও দুলছে। হালকা সাজে মোমের পুতুল লাগছে যেন শিমুলকে। দূর থেকে মনে হচ্ছিলো বকুল তার কাছে আসছে। খুব কাছাকাছি এলে ইফতির ঘোর কাটে, এটা বকুল নয় এটা শিমুল। দু বোনকে দেখতে অনেকটা একই রকম লাগে। যদিও এই প্রথম ইফতির কাছে এটা ধরা পড়েছে। ইফতির নিজের উপর মেজাজ খারাপ লাগছে, সে কি করে শিমুলকে বকুল ভেবে নিলো। বকুল ফিরবে না, কোনোদিন ফিরবে না। কোনো কথা না বলেই ইফতি গাড়িতে উঠে পড়ে। শিমুলও কোনো কথা বলে নি। একই গাড়িতে পাশাপাশি দুজন, দুজনের মধ্যকার দূরত্ব দু হাত ও নয় অথচ তাদের মনের দূরত্ব বহু মাইল। কেউ কোনো কথা বলছে না; পিনপতন নীরবতা। গাড়ি ছুটছে আপন গতিতে নিজ গন্তব্যের দিকে।
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি