তবু মনে রেখো পর্ব-৪

0
4807

তবু মনে রেখো
৪র্থ পর্ব

ছ’টা নাগাদ শিমুলদের বাড়িতে তারা পৌছালো। সারারাস্তা ইফতি আর শিমুলের মাঝে কোনো কথা হয় নি। দু এক বার চোখাচোখি হতেই ইফতি চোখ সরিয়ে নিয়েছে। অথৈর বয়স এখন দুই বছর দশ মাস। তার কৌতুহল অনেক। গাড়ির কাচ দিয়ে রাস্তায় যা দেখছে, খুব আগ্রহের সাথে তার মামুনিকে সে দেখাতে দেখাতে এসেছে। ভাঙা ভাঙা বাক্য বলে, কিছু শব্দ বলতে পারে না আবার কিছু শব্দের উচ্চারণ ক্লিয়ার না। যেমন, মামুনি কে মাউনি, তরকারিকে তককারি, বাদামকে বাদান, গাড়িকে গাইইইই।
রাস্তায় কিছু দেখলেই, “মাউনি উযে”। আর শিমুল ও তাকে জিনিসটার বিবরণ দিতে দিতে এসেছে। এখন এইটা অথৈ কতটুকু বুঝছে কে জানে। ইফতির মাঝে মাঝে খুব হাসি পাচ্ছিলো। এতো আগ্রহ নিয়ে শিমুল যে তাকে বুঝাচ্ছে, দশ মিনিট পরই সে ভুলে যাবে। বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালে দারোয়ান গেইট খুলে দেয়। শিমুলদের বাড়ি ধানমন্ডিতে, খুব পুরাতন পাঁচ তলা বাড়ি। শিমুলরা তিন তলায় থাকে। বাসায় হারুণ সাহেব আর একটা বিশ্বস্ত কাজের ছেলে, ঠিক কাজের ছেলে নয় কেয়ারটেকার লোকমান থাকে। এতোদিন শিমুলই ছিলো হারুণ সাহেবের কাছের সঙ্গী। এখন তাকে লোকমানের সাথেই থাকতে হবে। মেয়ে যে এখন অন্য সংসারে আলো হয়ে আছে। নানাকে দেখেই অথৈ দৌড়ে নানার কোলে উঠে গেলো। মেয়েকে একদিন না দেখতে পেয়ে অস্থির হয়ে ছিলেন হারুণ সাহেব। মেয়ে, মেয়ে জামাইকে দেখে যেন প্রাণে পানি এলো তার। যতই হোক বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মতো তো নয়।

ইফতির খুবই অস্বস্তি লাগছে। এর আগেও সে এ বাড়িতে এসেছে। পার্থক্য একটাই তখন সে বকুলের সাথে আসতো। বকুলের রুমটা তালাবদ্ধ, হারুন সাহেব তালা দিয়ে রেখেছেন। খোলা থাকলে শুধু মনে হয় মেয়েটার স্মৃতি তাড়া করে বেরাচ্ছে। এখন ইফতিকে শিমুলের ঘরেই থাকতে হবে। যতই হোক, শিমুল তার বিয়ে করা বউ। এখন শ্বশুরের সামনে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটুক সে তা চায় না। তাই ফ্রেশ হতে শিমুলের রুমেই সে গেলো। এই প্রথম এতো বছরে শিমুলের ঘরে সে প্রবেশ করেছে। বকুলের সাথে ইফতির বিয়ে প্রায় পাঁচ বছর হতে চলেছে। এই এতো বছরে সে কোনোদিন শিমুলের রুমে আসে নি। মূলত প্রয়োজন হয় নি। শিমুলের রুমটা খুব সিমসাম, গোছানো। এক পাশে বিশাল বুক সেল্ফ, তাতে বিভিন্ন রাইটারদের বই। শিমুল পড়তে ভালোবাসে তাই বিভিন্ন রাইটারের বই জোগাড় করে রেখেছে। টেবিলে তার মেডিকেল বই ভর্তি, সব সুন্দর করে সাজানো। সমস্যাটা হলো, খাট ব্যতীত কোনো শোবার ব্যবস্থা নেই। আজ তাদের একই বিছানায় ঘুমাতে হবে। ইফতির এখানে আগে কিছু কাপড় ছিলো যা এখন শিমুলের রুমে রাখা হয়েছে। শিমুল অথৈর জামা বদলাতে রুমে আসলে দেখে ইফতি কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত।
– কি হয়েছে? কিছু ভাবছেন?
– না, তেমন কিছু না।
– ওহ! তাহলে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি কফি দিচ্ছি।
– আচ্ছা, শিমুল। ঘুমানোর কি ব্যবস্থা?
– ওটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। অথৈ আর আপনি খাটে শুয়ে যাবেন। আমি নিচে বিছানা করে নিবো।
– ঠান্ডা লাগবে না?
– সেটা নিয়ে ভাববেন না। এছাড়া তো উপায় নেই। আর সত্যি বলতে আমরা তো কালকেই চলে যাবো তাই এটা নিয়ে প্যারা নেওয়ার মানে নেই।
– তাহলে তুমি উপরেই শুইয়ো। একটা রাতের ই তো ব্যাপার আর অথৈতো তোমাকে ছাড়া ঘুমাবে না। তাই সমস্যা হবে না।
– না না, তার দরকার নেই
– দরকার আছে, এ নিয়ে কথা বাড়িয়ো না।

বলেই ইফতি ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। শিমুলের মাথায় ঢুকছে না, এই অবুঝ,মাথামোটা,ঢিট লোকটা বুঝদারের মতো কথা কিভাবে বলছে। শিমুল অথৈর জামা বদলে হারুন সাহেবের কাছে দিয়ে লোকমানকে খুজতে গেলো। ছেলেটা আজ না, বছর দশেক হবে তাদের সাথে আছে। আঠারো উনিশ বছরের একটা ছেলে, ছিমছাম গড়ন, প্রচুর বলদ। এবার দ্বিতীয়বার এস.এস.সি দিলো। গতবার ফেল করেছে। হারুন সাহেব ওকে কাজের লোক হিসেবে দেখেন না। যখন সাত কি আট বছর বয়স হবে তখন এক বৃষ্টির রাতে বাসার সামনের টঙের দোকানে ছেলেটাকে পান তিনি। সেখান থেকেই আশ্রয় দিয়েছেন। আত্নভোলা কিসামের ছেলে লোকমান। শিমুল একদন্ড ওকে ভরসা করতে পারে না। আগে যখন শিমুল ডিউটিতে থাকতো একশবার ওকে ফোন করে শুনতো বাসার সব ঠিক আছে কিনা। এখন শিমুল রান্না করতে যাবে, তাই অথৈকে পাহাড়া দিতে লোকমানকে প্রয়োজন। ইফতি ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে যাতে অথৈকে দেখে রাখে। অবশেষে রান্নাঘরে পেয়াজ কাটতে পাওয়া গেলো লোকমানকে।
– ওই কি করছিস?
– আফা পাক করাম, আফনে আইছেন; আজকে আফনেরে আর দুলাভাইরে আমার হাতের রান্না খাওয়ামু।
– রান্নাটা আমি করবো,অন্য আরেকদিন তুই করিস। যা অথৈকে একটু দেখে রাখবি।
– কেন আফা, আমার রান্না খাইবেন না?
– আজ না, আজকে বাবার পছন্দের সব বানাবো। তুই বাবার রুমে যা, অথৈ ওখানে আছে। আর দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করিস কিছু লাগবে কিনা।

লোকমান মন খারাপ করে রওনা দিলো হারন সাহেবের রুমের দিকে। শিমুল খোঁপাটা বেধে শাড়ির আঁচল মাজায় গুজে নিলো। দুর থেকে বেশ গিন্নি গিন্নি লাগছে। কেউ বলবে না ওর কালকে বিয়ে হয়েছে। আধা ঘন্টা যাবৎ শিমুল রান্নাঘরে আছে। ঘেমে নেয়ে একসার। এরই মধ্যে হারুন সাহেব রান্নাঘরে আসেন। নিজের মেয়েকে এরুপ গিন্নি রুপে দেখতে তার বেশ লাগছে।
– কি রে মা, কি করিস?
– রান্না করি গো, আজকে স্পেশাল রান্না। মৌড়লা মাছের চচ্চরি, মুড়িঘণ্ট, পাবদা মাছের ঝোল আর টমেটোর টক।
– সে কি রে, কোনো মাংস,বড় মাছ রান্না করবি না। জামাই আছে তো।
– বাবা তুমি ভুলে যাচ্ছো তোমার জামাই কিন্তু নতুন জামাই নয়। পুরান জামাই, শুধু সম্পর্কের নাম বদলেছে। আর ইফতি কোন কালে তোমার বাড়ি এসে মণ্ডামিঠাই খেত। সেই তো বাঙালি ভর্তা ভাত। ওর কিছুতে কিছু যায় আসবে না।
– তোর সাথে আমি কথায় পারবো না। আচ্ছা ইফতি তোকে মেনে নিয়েছে তো?

হারুন সাহেবের কথায় স্মিত হেসে উওর দিলো,
– ও যে মানবে না তাতো অজানা ছিলো না বাবা। ইনফ্যাক্ট ও যে আমায় মেনে নেয় নি, তাতে বরং একদিক থেকে আমি খুব খুশি। কারণ ও আমার বোনটাকে খুব ভালোবাসে। আজ আমার জায়গায় অন্যমেয়েকে বিয়ে করে যদি মেনে নিয়ে সংসার করতো, তখন কি জিনিসটা তোমার ভালো লাগতো বাবা? না তাই না। আর সত্যি বলতে, আমি আর ইফতি অনেকটা তেল আর পানি। যতই ঝাকাও না কেনো ক্ষনিকের জন্য তা মিলবে পরে আবার আলাদা হবে যাবে। তাই অহেতুক জোর করে একটা সম্পর্ক তৈরি করার দরকার নেই।
– আমরা তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম, তাই নারে??
– আহা বাবা, সবার জীবনে সব পেতে হবে এমন তো কথা নেই তাই না! এই দেখো না আমি তো মেনেই নিয়েছিলাম আমার কোনোদিন বিয়ে হবে না। আল্লাহর রহমতে হয়েছে তো। আমি কোনোদিন মা হতে পারবো না, মা ডাক শুনতে পারবো না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছেতে তাও হয়েছে। অথৈ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া বাবা। হতে পারি আমি ওর খালা, সৎ মা, মামুনি কিন্তু মামুনিতে মা ডাকটা তো আছে। সারাজীবন ও আমার কাছে থাকবে আমার মেয়ে হয়ে। বাবা জীবন নষ্ট হয় নি, করলাম না সংসার কি যায় আসে বলো।
– মারে, তুই এমন কেনো রে মা।
– হয়েছে, এখন যাও রুমে। চা করে পাঠাচ্ছি, লোকমানকে ইফতির কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে বলো।

এতোক্ষণ বাবা-মেয়ের কথা একজন আড়ালে শুনছিলো। দ্বিধা কাজ করছে, মস্তিষ্ক বলছে এই বিয়েটাকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না তাহলে বকুলের অধিকার শিমুলকে দিতে হবে; অপরদিকে মন বলছে তোমার মেয়ের জন্য একটা মেয়ে তার সারাটা জীবন বলি দিচ্ছে তোমার উচিত বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। মন এবং মস্তিষ্ক কার জিত হবে এটাই এখন দেখার পালা। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here