#তিতির_পাখির_বাসা
(পর্ব-১১)
#জয়া_চক্রবর্তী
তিতিরের অনিশ্চিত প্রেমের কথা ভেবে মাঝেমাঝেই মেঘলা হয়ে যাচ্ছে সুদর্শনের মনের আকাশ।
আসলে তৃষ্ণার জল আশার অতীত হলে তবেই না মরীচিকা বিভ্রান্ত করে।সুদর্শন এতোদিন কল্পনায় তিতিরকে সাজিয়েছে,ভালোবেসে পাগল করেছে।
সেই তিতিরকে কাল পুরোপুরিভাবে কাছে পেয়েও আজ হারাবার ভয় সুদর্শনের চোখদুটোকে আর্দ্র করে দিচ্ছে বারবার।
আজ সকালে তিতির চোখ মেলতেই দেখেছিলো ঘর জুড়ে সোনালী রোদ্দুর লুকোচুরি খেলছে।
আবার বাইরে তাকাতেই দেখেছিলো রোদেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে উঁচু নীচু শ্বেত শুভ্র পাহাড়ের গায়ে,মাথায়।
পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে ছিলো ঝকঝকে নীল আকাশ।সাদা মেঘেদের সেনা গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো এখানে সেখানে।
তিতির আলসেমি ছেড়ে রেডি হয়ে নিলো।
সুদর্শন কে জাগিয়ে দিয়ে বললো,”আমি বাইরে যাচ্ছি,কাছাকাছিই থাকবো’।
এরপর সুদর্শনের সম্মতির অপেক্ষা না করে, তিতির প্রায় উড়েই বেড়িয়ে গেলো।
মানালির রাস্তার দুই ধারেই বরফ।তিতির হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমাঝেই নীচু হয়ে বরফের কুচি মুঠোয় ভরে নিচ্ছে।এ হাত ও হাত করে নিয়ে বল বানাচ্ছে।আবার ছুঁড়ে দিচ্ছে বরফের দিকেই।
বেশ মজা লাগছে তিতিরের।বিয়ের আগে কখনো এই রকম একা কোথাও বের হওয়ার সুযোগ পায়নি তিতির।সবসময় হিটলার দাদা সঙ্গে থেকেছে।
তিতির যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে।পাহাড়ি রাস্তার এক একটা বাঁক ঘুরছে আনমনে।
হঠাৎ একটা বড়ো পার্ক দেখে এগিয়ে গেলো। দোলনায় চড়ে দোল খেতে শুরু করলো।
আচ্ছা ওকে তো ফিরতে হবে।হোটেলের নামটা যেন কি ছিলো!
উঁহু হোটেলের নামটা তো ওর মনে নেই।
কি করে ফিরবে এবার!!
ঠিক যেভাবে ফেরবার চিন্তাটা হঠাৎ মনে এসেছিলো, সেই ভাবেই নিমেষে তা ঘাস ফড়িং এর মতোই উধাও হয়ে গেলো।
তিতির ছোট থেকেই হারিয়ে যেতে চাইতো।আর হারাবার জন্য এর চাইতে সুন্দর জায়গা তো আর হতেই পারেনা।
কথাটা মনে হতেই, এক চিলতে হাসি খেলে গেলো ওর পাতলা ঠোঁট দুটিতে।
দোলনা থেকে নেমে আরো এগিয়ে গেলো।
একটা আপেল বাগান দেখে দাঁড়িয়ে পরলো তিতির।যে লোকটা বাগানে কাজ করছিলো,তার সাথে ডেকে কথা বলতে বলতে জানতে পারলো সামনেই হাদিম্বা দেবীর মন্দির।
তিতিরকে জোর করে মালীভাই দুটো আপেল হাতে দিলো।
মালীভাই কি বুঝতে পেরেছিলো তিতিরের খিদে পেয়েছে?নাকি সবাইকেই ও আপেল খেতে দেয়!
তিতির আপেলে কামড় দিতে দিতে এগিয়ে গেলো।
মন্দিরে পৌঁছে অনেকটা সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলো।
কাল প্রায় সারা রাত সুদর্শন তিতিরের শরীরে ডুবে ছিলো।তিতিরের ঘ্রাণ এখনো ওর শরীরে মিশে।তিতির মিশে গেছে ওর রক্তকণিকায়,ওর অস্থি মজ্জায়।
ওর সমস্ত অনুভুতি জুড়ে শুধু তিতির।তিতিরের কথা ভাবতে গেলেই এক চুড়ান্ত ভালো লাগায় ডুবে যাচ্ছে সুদর্শন।আবার হারাবার আশঙ্কাও চেপে ধরছে সুদর্শনকে।
কিন্তু এখনো তিতিরকে ওর মনের কথাটা জানানো হয়নি।আচ্ছা তিতির কি এখনো জানেনা?
তিতির কি এখনো বোঝেনা?এখনো কি ওর মাথায় ডিভোর্স শব্দটা ঘুরছে?
সুদর্শন কে ডিভোর্স দিয়ে কি ভালো থাকতে পারবে তিতির?
ভালোবাসি,এই গভীর শব্দটা নাইবা শুনলে পাখি…
তাতে কি কিছু কম পাওয়া হবে, তোমার কিম্বা আমার?
যা পেয়েছি কাছে থেকে তোমার,
শত বসন্ত কি পারতো দিতে সে রোমাঞ্চ?
বৃষ্টি ভেজা কেতকীর মতো তোমার ভেজা শরীর।
দুচোখের রহস্যময়তা পারেনা ধরতে,গভীর মনের তল।
ভালোবাসি এই গভীর শব্দটা নাইবা শুনলে পাখি,
তাতে কি কিছু কম পাওয়া হবে,তোমার কিম্বা আমার??
মনে মনে শব্দমালা গাঁথতে গাঁথতেই সুদর্শন রেডি হয়ে বেড়িয়ে পরেছিলো।কিন্তু তিতিরের দর্শন পায়নি।আশেপাশে সব জায়গা দেখে নিয়েছে।কোথায় যে গেলো মেয়েটা!
বাধ্য হয়ে সুদর্শন সবাইকেই তিতিরের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে।
যেতে যেতে রাস্তায় আরো অনেক সদ্য বিবাহিত নারী-পুরুষও দেখলো।তারা কিন্তু দিব্যি একে অপরের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।নিজেদের মধ্যে দুষ্টুমি করছে।শুধু তিতিরের হাতটাই সুদর্শনের মুঠোয় ধরা নেই।সুদর্শন বাঁহাত দিয়ে চোখের কোন মুছে নিলো।
কাল রাতে তিতিরের অবস্থা দেখে সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সুদর্শন। পুরো বরফ ঠান্ডা হয়ে গয়েছিলো মেয়েটা।নাহলে ওই ভাবে তিতিরকে সে পেতে চায়নি।আচ্ছা সেই কারনেই কি তিতির ওকে ছেড়ে চলে গেলো!নাকি তিতির রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে!
না আর ভাবতে পারছে না সুদর্শন।
অনেকটা রাস্তা আসার পর আপেল বাগান দেখে এগিয়ে গেলো।ভেতরে মালী কে ডেকে তিতিরের ছবি দেখাতেই মালী বললো,দেখেছে আর মেয়েটি আগে হাদিম্বা দেবীর মন্দিরে গেছে।
সুদর্শন মন্দিরে পৌঁছে দূর থেকে তিতিরকে দেখতে পেলো।খুব শান্ত ভাবে তিতির মন্দির প্রদক্ষিণ করছে।মুখে চিন্তার ছাপ মাত্র নেই।
নিজেকে তিতিরের থেকে দুরেই রাখলো, ও দেখতে চায়,যাকে এতোটা ভালোবাসলো,তার কি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর ওপর?(চলবে)