#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব-১৩)
#জয়া_চক্রবর্তী
মন্দিরের চাতালে বসে সুদর্শন ভাবছিলো,কিছুদিন আগেও কাজকর্ম,বন্ধুবান্ধব,ভ্রমণ এসব নিয়ে দিব্যি ছিলো।
হঠাৎ মা এর আনা তিতিরের ছবিটা ওর জীবনটাই কেমন বদলে দিলো।
মায়ের এককথায় সে রাজি হয়ে গিয়েছিলো তিতিরকে বিয়ে করতে।
তবে এই কথাটা সুদর্শন বুঝে গেছে যে,তিতিরের জায়গাটা আর কাউকে দেওয়াই সম্ভব নয়।
যদি সত্যিসত্যিই তিতির সুদর্শনের পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়,তখন নিজের ছায়াই হবে সুদর্শনের সর্বক্ষণের সঙ্গী।
ছায়ার সাথেই তখন চলাফেরা,ছায়ার সাথেই কথা বলা-ভাব ভালোবাসা।
সব কিছুই ওই ছায়ার সঙ্গে।
সুদর্শন কখনোই ভালো বক্তা ছিলো না।তবে তিতিরের সঙ্গে মনে মনে অনেক কথা বলেছে।
চোখে চোখ রেখে মনের কথা বুঝিয়ে দিতেও চেয়েছে।তিতির হয়তো বুঝতে চায়নি বলেই বোঝেনি।
সুদর্শন ভাবলো,
‘আমিই শুধু রঙহারানো সাদা কালোয়
জমিয়ে রাখি উড়ানরাঙা ইচ্ছেপালক’।
তুহিনের অহেতুক সঙ্গদানের কারনে তিতিরের আর মন্দির ঘুরে দেখতে ভালো লাগছিলো না।
তিতির দ্রুত পায়ে মন্দির ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই দেখলো,সুদর্শন চাতালে বসে।
কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সুদর্শন হেসে বললো,’দেখা হলো মন্দির?’
তিতির অপরাধী মুখ করে নিয়ে সবে বলতে শুরু করেছিলো…কিন্তু সুদর্শন থামিয়ে দিয়ে বললো,’কৈফিয়ত তো চাইনি পাখি,কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বোলো না।সম্পর্কের মধ্যে কৈফিয়ত আসলে সম্পর্কটা যে দমবন্ধ হয়ে আসবে,গল্প হিসেবে বোলো পরে শুনবো’।
সুদর্শনের কথাটা তিতিরকে কোথাও ছুঁয়ে গেলো।হেসে বললো,’আচ্ছা পরে শুনো’।
তুহিন নিজেই এগিয়ে এসে পরিচয়টা সারলো।
‘হাই আমি তুহিন চ্যাটার্জী,আমরা এক কলেজেই পড়তাম’।
সুদর্শন হেসে বললো,আমি সুদর্শন।
তুহিন গম্ভীর স্বরে বললো,’আজ তো আপনার গিন্নীকে হারিয়েই ফেলছিলেন।অচেনা পাহাড়ি রাস্তায় এই রকম একা বের হতে দেওয়া ঠিক হয়নি আপনার।যদি কোন বিপদে পড়তো মেয়েটা,ক্ষমা করতে পারতেন নিজেকে?খারাপ লোকের পাল্লাতেও তো পড়তে পারতো।তাছাড়া তিতিরের তো হোটেলের নামটাও মনে ছিলোনা,কি করে ফিরতো?’
সুদর্শন বললো,’সত্যিই ভারি অন্যায় হয়ে গেছে।কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো আপনাকে?ভাগ্যিস সাথে ছিলেন’।
একটু চুপ থেকে তুহিন বললো,’ধন্যবাদ নিয়ে আমি কি করবো?তিতির খুব ভালো মেয়ে,ওকে দেখবেন’।সুদর্শনের মনে হলো তুহিনের চোখটা ছলছল করছে।তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে তিতির কোথাও নেই।তুহিন বললো,’ও আবার মন্দিরের ভিতরে চলে গেছে।আপনিও ভিতরে যান।আমি এবার আসছি’।
তুহিন সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।”ভালোবাসা বিনিময় চায়না”,কথাটা যে কতবড় মিথ্যে সেটা অনুমান করতে পারছিলো।
আসলে ‘ভালোবাসা বিনিময়ে ভালোবাসা চায়’-এটাই চিরন্তন সত্য,সে যে যাই বলুক না কেন।
সুদর্শন তুহিনের উদ্বিগ্ন কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলো তিতিরকে ছেলেটা ভালোবাসে,এক তরফা ভালোবাসা যে কী ভীষণ কষ্টের সেটা সুদর্শন ভালোই বোঝে।তুহিনের সাথে একাত্ম লাগলো নিজেকে।
তবে তুহিনের সাথে মন্দিরে ঢোকবার আগে তিতির বলছিলো যে, ওর হাবি ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আর ও নিজেও।
কথাটা কি শুধু তুহিনকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ছিলো!?
তিতির মন্দির থেকে বের হতেই সুদর্শন বললো,এবার ফেরা যাক’।তিতির মাথা নাড়িয়ে সুদর্শন কে সায় দিলো।
তিতিরের হাত সুদর্শন নিজের মুঠোয় ভরে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো।
তিতির মুদ্ধ দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে।হঠাৎ সুদর্শন বলে উঠলো,’আচ্ছা তিতির তুমি কি সত্যিই হারিয়ে যেতে চাইছিলে?’তিতির বললো,’হারিয়ে আর কোথায় যেতাম,আমি তো জানতাম খুঁজে নেবে আমায়’।
‘তুহিন কিন্তু ভালোবাসে তোমাকে’,কথাটা বলেই সরাসরি তিতিরের চোখের দিকে তাকালো।হয়তো কিছু বুঝে নিতে চাইছিলো।
তিতির বললো,’তাতে কি হলো?এমন অনেকেই ভালোবাসে আমায়’।সুদর্শন বললো,’তুমি কাউকে ভালোবাসো না?’।
তিতির বললো,’হ্যাঁ বাসি তো।আমার গল্পের বই এর পুরুষ দের প্রেমে আমি হামেশাই পরি।চোখ বুজলেই ওরা রক্তমাংসের শরীর ধারন করে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।আমি আমার মতো করে ওদের সাথে মিশি,ভালোবাসি’।
সুদর্শনের একটু অবাক লাগে কথাটা।বললো,’ এখনো এমন হয় নাকি?’।
ততক্ষনে তিতির নীচু হয়ে, বরফ কুচি মুঠোয় ভরে বল বানাতে ব্যস্ত।কিছুক্ষণ চুপ করে সুদর্শন বললো,তাহলে তো আমাকে তোমার পছন্দই হয়নি।গল্পের বই এর নায়কদের মতো সৌন্দর্য্য,ব্যক্তিত্ব কোনটাই নেই আমার।
তিতির কোন উত্তর না দিয়ে সুদর্শন কে বললো,জল তেষ্টা পেয়েছে বড্ড।সুদর্শন খুব চিন্তিত মুখে বললো,কাছেপিঠে তো কোন দোকান দেখছি না।আসার সময়তেও চোখ শুধু তোমাকেই খুঁজছিলো,তাই খেয়াল নেই দোকান ছিলো কিনা’।
তিতির নিজেই একটা পাহাড়ি বাড়ির দরজা নক করলো।একটা বাচ্চা মেয়ে বেড়িয়ে আসলো।
জল তেষ্টার কথা বলতেই মেয়েটি হাসিমুখে ওদের জল এনে দিলো।দুজনেই জল খেয়ে মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে এলো।
সকাল থেকে কিছুই পেটে পরেনি।পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার পরিশ্রমে খিদেও পেয়েছে প্রচণ্ড।সুদর্শন ঠিক করলো প্রথম যে খাওয়ারের দোকানটাই দেখবে,সেখানেই ঢুকে লাঞ্চ সেরে নেবে।
খাওয়াদাওয়া সেরে সুদর্শন তিতিরকে নিয়ে হোটেলে ফিরলো।
বিকেলের অস্তগামী লাল সূর্য্যটা শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের ওপর মায়াবী আলো ছড়িয়ে দিতেই,ভালো লাগা ছড়িয়ে পরলো দুজনের রক্তের শেষ বিন্দুতে।
দুজনেই জানালার ধারে, আলো আঁধারীতে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে থাকলো।
রাত বাড়তেই সুদর্শন পরের দিনের প্ল্যানিং নিয়ে তিতিরকে জানিয়ে দিলো।
আগামীকাল ওদের গন্তব্য সোলাং ভ্যালি আর রোটাং পাস।
সোলাং ভ্যালি হোটেল থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরে।তবে ছবির মতো সুন্দর।পথে ভ্যাসিসথ উষ্ণ প্রস্রবণ পরবে।
রোটাং পাস প্রায় ১৩.৫০০ফিট উঁচুতে।পথ ভয়ঙ্কর হলেও অসাধারণ সুন্দর।তিতির গোল গোল চোখ করে সুদর্শনের কথাগুলো শুনলো।তারপর টাওয়াল নিয়ে ফ্রেশ হতে যেতেই,সুদর্শন জোরে জোরে বলল,’ দেখো কালকের মতো যেন গরম করতে না হয়’।
তিতির লজ্জার লাল হয়ে টাওয়াল দিয়েই মুখ ঢাকলো।(চলবে)