তিতির পাখির বাসা পর্ব-১৫

0
553

#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-১৫)
#জয়া চক্রবর্তী

ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত্রি দুটো অথবা আরো বেশী।
মানে স্বপ্ন ভঙ্গের মতো রাত পোহাবার এখনো অনেক দেরী।

সুদর্শন তিতিরকে নিয়ে ছাদ থেকে নীচে নেমে আসলো। বললো,’ঘুমিয়ে পরো পাখি,আমি একটু গুছিয়ে নিই।কাল সকালেই চণ্ডীগড় যাওয়ার বাস ধরতে হবে’।

‘আমার আর ঘুম আসবে না,বেটার আমিও হেল্প করি তোমাকে’তিতিরের কথায় সুদর্শন খুশীই হলো।

আসলে রাত্রি মানেই ফিরে পাওয়ার আশ্বাস,রাত্রি মানেই নতুন স্বপ্নে গা ভাসানো।

‘জানো পাখি এই জায়গাটা আমার ভীষণ পছন্দের।আগেরবার যখন নিলয়,কল্লোলদের সাথে এসেছিলাম,তখন পাহাড়ি গ্রাম গুলোতেও ঘুরে বেড়িয়েছিলাম’।
সুদর্শনের কথায় তিতির গোছানো থামিয়ে বললো, ‘ওমা তাই?ওখানে যাওয়া যায়?’।

সুদর্শন বললো,’পরের বার এসে তোমাকে ও নিয়ে যাব’।তারপর হেসে বললো,’আরে ডিভোর্স নিলেও তো আমরা ভালো বন্ধুই থাকবো,তাইনা?দুই বন্ধুতে আসা যাবে কখনো আবার,যদি তোমার আপত্তি না থাকে’।

তিতির মৃদু হেসে যত্ন করে একএকটা জামাকাপড় ভাঁজ করে এগিয়ে দিতে থাকলো সুদর্শনের দিকে।

তিতির না চাইতেও সুদর্শন ওর মনের কোথাও একটা জায়গা করে নিয়েছে।তাই হয়তো তিতির নিজেই ভিভোর্সের কথায় আনমনা হয়ে পরছে।ফিরে গিয়ে মুক্তি পাওয়ার খুশীটা ওর মধ্যে থেকে উধাও।

তিতির বুঝতে পারছে না,সুদর্শনের স্পর্শসুখ কি বিচলিত করেছে ওর মনকে!নাকি সুদর্শনের মাত্রাতিরিক্ত কেয়ারিং মনোভাবে ওকে আসক্ত করছে সুদর্শনের প্রতি!নাকি এটা সাময়িক আবেগ!

না,তিতির কিছুই বুঝতে পারছে না,আবার ব্যাপারটা এড়াতে চাইলেও এড়াতে পারছে না।

তার ওপর আজ যেভাবে অঝোরে কাঁদছিলো ছেলেটা,তাতে তিতিরের মনে হচ্ছিলো সুদর্শন কে বাদ দিয়ে এ কিসের স্বপ্ন দেখছে ও!!এতো সব পেয়েও সব হারানোর দেশে পৌঁছে যাওয়ার মত!!

‘পাহাড়ি বাচ্চা গুলোকে আমার দারুন লাগে জানো।ওদের নিয়ে কোন ঝঞ্ঝাটই নেই ওদের মা-বাবার।আপন মনে খেলে বেড়ায়,নাক দিয়ে সর্দি গড়ালে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নিজেরাই মুছে নেয়।বৃষ্টি পড়লে হুড়মুড় করে আস্তানায় ঢোকে,আবার থেমে গেলেই খেলায় মেতে ওঠে’।সুদর্শনের কথায় তিতিরের চিন্তায় ছেদ পড়লো।

‘আচ্ছা ওরা কি দিয়ে খেলে?মানে আমাদের মতো তো খেলার সামগ্রী ওদের নেই’।তিতিরের কথায় সুদর্শন হেসে বললো,’ কে বললো নেই?ওরা আমাদের থেকেও অনেক বেশী ভাগ্যবান।ওরা খেলে জলের মাছ,মাঠের ঘাস,ফুল,ফল,লতাপাতা,ঘাস ফড়িঙ আর প্রজাপতিদের সাথে।ওরা খেলে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসা ঝর্ণার সাথে, লুকোচুরি খেলে পাহাড়ি বৃষ্টি আর মেঘেদের সাথে’।

তিতির গোছানো থামিয়ে সুদর্শনকে বলে,’আচ্ছা বাসে উঠবার আগে আশপাশটা আর একবার ঘুরে আসলে হয়না?সকাল হতে তো বেশী দেরী নেই’।

তিতিরের কথায় সুদর্শন মাথা নেড়ে, চটপট হাত লাগিয়ে ব্যাগ গোছানো সেরে নেয়।
রাত্রি এখন অন্তিম পথের যাত্রী। কেয়ারটেকার কে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে মেন গেট খুলিয়ে আবছা অন্ধকার থাকতেই বেড়িয়ে পরে দুজন।

ঠান্ডাটা যেন কামড় লাগাচ্ছে হাড়ে।সুদর্শনের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে তিতির এগিয়ে যেতে থাকে।
সুদর্শন তিতিরকে বলতে চাইলো,’এই হাত ছেড়ে থাকতে পারবে তো পাখি?আমি তো তোমায় ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারছি না’।
কিন্তু মুখ দিয়ে কথা ফুটলো না।
আপাত ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে পরলো মন।

পূর্নতার আকাঙ্ক্ষায় অপ্রাপ্তিকে অস্বীকার করার মধ্যেও শক্তি চাই।
এই শক্তিই আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে,সমস্ত পরাভবের সম্ভাবনাতে ও নির্ভীক রাখে।

রাস্তার আশেপাশে বরফ।
যে কোন মুহুর্তে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।সুদর্শন তিতিরকে ধরা হাতের মুঠিটা আরো শক্ত করে নিলো।

দেখতে দেখতে মেঘের সীমানায় রোদ জাগলো।শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে পড়লো সেই রূপোলী মেঘ।স্বপ্নালু রাত শেষে ভোরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুজন দুজনকে সুপ্রভাতের অভিবাদন জানিয়ে ফেরার পথ ধরলো।এখনো সুদর্শনের মুঠোয় তিতিরের নরম আঙুলগুলো।

হোটেলে ফিরেই ব্রেকফাস্ট সেরে দুজন চন্ডীগড়ের বাসে উঠে বসলো।

‘আমি তুহিন,চিনতে পারছেন?কাল পরিচয় হয়েছিলো’।সুদর্শন বললো,’অবশ্যই চিনতে পারছি।আজকেই ফিরছেন?’
তিতিরের দিকে একঝলক তাকিয়ে তুহিন বললো,’ওই আর কি,একা একা উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরতে আর ভালো লাগছিলো না’,বলেই তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো,’কী সব ভালো তো?’ সৌজন্যের দেঁতো হাসি মুখে এনে তিতির বললো,হ্যাঁ আমি ভালোই থাকি’।

সুদর্শন তুহিনকে বললো,’কি করা হয় আপনার?মানে কোন প্রফেশনে আছেন?’
না,এখনো কিছুই পাইনি।আসলে সরকারি চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছিলাম,যদি লেগে যায়’।
তুহিনের কথায় সুদর্শন হেসে বললো,’বাহ সরকারি চাকরী করবেন,তাহলে তো মেয়ের বাবাদের লাইন লেগে যাবে।বেস্ট অফ লাক,ট্রাই করুন,পেয়ে যাবেন’।

তুহিন একবার তিতিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,ঠাট্টা করছেন?তা করতেই পারেন।তবে আর চাকরীর পরীক্ষা দেওয়ার কোন প্রয়োজন দেখছি না।ভাবছি ফিরে গিয়ে বাবার দোকানেই বসবো’।

‘কেন হঠাৎ আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন- প্রশ্নটা করে আপনাকে বিব্রত করতে চাইনা।তবে একটা সময় হয়তো আজকের সিদ্ধান্তটাকে ছেলেমানুষি বলে মনে হবে’।

সুদর্শনের কথায় তুহিনের চোখটা ভিজে আসছিলো।সামলে নিয়ে বললো,’কি জানেন আমরা প্রত্যেকেই একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোই’।

তিতিরের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার বললো,’সেখানে কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে।যখন দেখি পাওয়ার আর কিছু নেই, তখন না চাইতেও ভিতরটা ভেঙে যায়’।

‘বুঝলাম।কিন্তু চাওয়া-পাওয়া শব্দগুলো আপেক্ষিক।আজকের চাওয়াটা আগামী দিনে অন্য চাওয়াতে বদলে যাবে।কারন চাওয়া-পাওয়ারা বদলে যায় অহরহ’।সুদর্শনের কথার কোন উত্তর দিলোনা তুহিন।

তিতির অবাক হচ্ছে তুহিনদার কথাবার্তায়,সঙ্গে বিরক্তও…
‘সুদর্শন কি ভাবছে কে জানে!!’কথাটা মাথায় আসতেই মনটা অস্বস্তিতে ছেয়ে গেলো।

আচ্ছা সুদর্শন কি ভাবছে, সেটা নিয়ে তিতিরের কি যায় আসে!তিতিরের কেন অস্বস্তি হচ্ছে সেটা নিয়ে!

‘একটু ঘুমিয়ে নাও পাখি,কাল সারা রাত জাগা,না ঘুমোলে শরীর খারাপ হবে’,সুদর্শনের কথায় বাধ্য মেয়ের মতো চোখ বুজলো তিতির।

তুহিন আড় চোখে তাকিয়ে দেখে নিলো, তিতিরের মাথাটা সুদর্শনের কাঁধে।সুদর্শন হাতের বের দিয়ে ধরে আছে তিতিরকে, যাতে বাসের ঝাঁকুনিতে আঘাত না পায়।

না আর নিতে পারছে না তুহিন।পাগল পাগল লাগছে তুহিনের।
বুঝতে পারছে বাকী জীবনটা এইভাবেই একবুক অতৃপ্তি নিয়ে,প্রণয় পিলসুজে জ্বলতে হবে তুহিনকে।(চলবে)

(এরপর থেকে একঘন্টা পর পর… আর দু’-আড়াই ঘন্টা ওয়েট না…কেমন?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here