তিতির পাখির বাসা পর্ব-১৬

0
518

#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-১৬)
#জয়া চক্রবর্তী।

‘আলু পরোটা আর রায়তা বলি?চাইলে অন্য কিছুও নিতে পারো।সুদর্শনের কথায় তিতির বললো,’আমার জন্য একটা আলু পরোটা আর টক দই বলো’।

‘নাম পাখির বলে তোর দেখছি খাওয়াটাও ওই পাখিরই মতো’,তুহিনের আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা দুজনের কারোরই ভালো লাগলো না। কিন্তু মুখে কেউ কিছু প্রকাশ করলোনা।

চণ্ডীগড়ে নামার পর থেকেই তুহিন ওদের সাথে।কারনে অকারনে সব বিষয়েই আগ বাড়িয়ে কথা বলে চলেছে।

তবে তিতিরকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা আদৌ ওর সামনে তুহিনের কোন অস্তিত্ব আছে কিনা।তুহিনের কথা গুলো শুনেও না শোনার ভান করছে।

হঠাৎ ফাঁক পেয়ে সুদর্শনকে জিজ্ঞেস করলো তিতির,’কি ব্যাপার বলোতো,তুহিনদা কি হাওড়া অবধি আমাদের সঙ্গে যাওয়ার প্ল্যান করছে নাকি?’
সুদর্শন দুষ্টুমি হাসি হেসে বললো,’বারন তো করতে পারিনা,তোমার একনিষ্ঠ প্রেমিক’।

তিতির মুখ ভেঙচে বললো,’হ্যাঁ তোমায় বলেছে’।সুদর্শন বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো,’বোঝা যায় ম্যাডাম,বোঝা যায়’।

তারপর চোখে চোখ রেখে,দুটো ভ্রূ নাচিয়ে বললো,’ওর জন্যই কি ডিভোর্স চাওয়া হচ্ছে নাকি?তিতির রেগে গিয়ে গুমগুম করে দুটো কিল মারলো।সুদর্শন হো হো হেসে উঠলো।

খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে এসে বসলো তিতিররা।

এখন পড়ন্ত বিকেল।
তিতিরের কাছে, বিকেল মানেই
গেরুয়া রঙ।
বিকেল মানেই
তিরতির হাওয়ায় খেলা।
বিকেল মানেই বন্ধুদের সাথে
এক পা তুলে কিতকিত।
কখনো লুকোচুরি,
কখনোবা এলাটিং বেলাটিং শৈল।
খেলা নিয়েই আড়ি-ভাব
খেলা নিয়েই ঝগড়াঝাঁটি।

তবে তিতির খেলার বিষয়ে বরাবরই ভাগ্যবতী।
বায়না করে দাদার সাথে ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টন খেলতো।তবে বল হারিয়ে গেলে বা ফেদার কক হারিয়ে গেলে তিতিরকেই খুঁজে আনতে হতো।

আবার কোনদিন খুঁজে পাওয়া না গেলে কষ্টি পেয়ারা গুলো দিয়েই খেলা চলতো,নাহলে খবরের কাগজ গোল করে পাকিয়ে রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকে দিব্বি চার ছয় মারা হতো।

‘আমি একটু ঘুরে আসি,তুমি বসবে না যাবে?’সুদর্শনের কথায় তিতির বললো,আমি বসছি,তুমি বরং তুহিনদাকে নিয়ে যাও’।

সুদর্শন তুহিনকে নিয়ে বেড়িয়ে গিয়ে রাতের আর পরের দিন সকালের মতো খাওয়ার প্যাক করিয়ে নিলো।
তুহিন ও নিজের জন্য খাওয়ার প্যাক করালো।

তুহিন উইদাউট রিজার্ভেশন ট্রেনে উঠেছে।উদ্দেশ্য কিছু টাকা খাইয়ে চেকারের থেকে তিতিরদের কামরাতেই একটা সিট ম্যানেজ করা।

তিতির কোনভাবেই চাইছিলো না,তুহিন ওদের সঙ্গে এক কামরাতে যাক।কিন্তু তুহিনের কাছে চেকার ভগবানের অবতার হিসেবে দেখা দিলেন।তিনি বেশী পয়সা খেয়ে তুহিনকে ওই কামরাতেই সিট বুক করে দিলেন,যদিও বলে গেলেন যে সকালেই সিটের মালিক ট্রেনে উঠবেন।

রাত বাড়তেই সুদর্শন বললো,’খেয়ে নিলে হয়না?’
তিতির বললো,আমি কিন্তু কিছু খাবো না।একেবারেই খিদে নেই।তোমাকে খাওয়ারটা বেড়ে দিয়েই শুয়ে পড়বো।সুদর্শন বললো,আমি বেড়ে নিচ্ছি,তুমি চাইলে শুয়ে পড়ো।

তিতির কথা না বাড়িয়ে নিজেই সুদর্শনের খাওয়ার বেড়ে এগিয়ে দিলো।হ্যান্ড ব্যাগ থেকে ফেসওয়াস বার করে বেসিনে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো।ফিরে এসে দেখলো তুহিন ও শোওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।তিতির নাইট ক্রিম মুখে হাতে ঘসে নিয়ে সোজা আপার বাঙ্কে।

সারাদিনের ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে এলো তিতিরের চোখে।

তিতিরের ঠিক উল্টো দিকের বাঙ্কে তুহিন উঠে এলো।এখন তুহিনের মাত্র দুহাত দুরেই ওর কাঙ্ক্ষিত নারী।
উত্তেজনায় তুহিনের সারা শরীর কাঁপছে।এই প্রচন্ড ঠান্ডাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে।

কল্পনায় দুটো বাঙ্ক মিলিয়ে এক করে নিলো তুহিন।

তিতির নিজেকে কম্বল দিয়ে মুড়ে রেখেছে।শুধু ওর মুখটা বার করা।তুহিন পরম যত্নে ওর কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো।কল্পনাতেই তিতিরের মাথাটা নিজের বুকে চেপে নিলো।তিতিরের নাকে নিজের নাক ঘষে দিলো।ওর গোলাপি ঠোঁটটায় নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।

হঠাৎ সুদর্শন তুহিনকে ডেকে বললো,’খাওয়ার পর জল খেলেননা তো’।জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,’খুলে একটু গলায় ঢেলে নিন’।

তুহিন সুদর্শনের দেওয়া জলের বোতলটা পুরো শেষ করে বললো,’ আপনার অসুবিধা না থাকলে প্লিজ আপার বাঙ্কে আসুন।আমার ওপরে ঘুম আসতে চায়না’।সুদর্শন বললো,’লাগেজ আছে যে’।তুহিন নীচে নেমে এসে বললো,’আমি খেয়াল রাখবো,আপনি ওপরে যান’।

তুহিনের কথায় সুদর্শন আপার বাঙ্কে তিতিরের মুখোমুখি শুয়ে পরলো।তবে হঠাৎ তুহিনের নীচে নেমে যাওয়াটা ওর কাছে ধোঁয়াশাই ঠেকলো।

তুহিন নীচের বাঙ্কে চুপচাপ আধ শোয়া হয়ে কাঁচের জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো।একটু আগের তুহিনের সাথে এই তুহিনের আকাশ পাতাল পার্থক্য।

সুদর্শনের ডাকার টাইমিংটা ঠিক ছিলো।নাহলে এতোক্ষনে কল্পনাতেই তুহিনের দ্বিধাহীন হাতেরা অবাধ্য আদিমতায় ভর করে গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে যেত।মনে মনে সুদর্শনকে ধন্যবাদ জানালো তুহিন।এখন তিতির সুদর্শনের বৌ।ওকে নিয়ে কল্পনাতেও একসাথে থাকা অন্যায়।

কলেজে পড়তে এই তিতিরকে নিয়ে তুহিন কল্পনায় কতবার যে একসাথে হারিয়ে গেছে তার ঠিক নেই।

কখনো গঙ্গার নিরিবিলিতে, কখনো ময়দানের ভিড়ে।কখনো সিনেমা হলের অন্ধকারে। কখনোবা বিয়ের পর সেই প্রথম রাতে।যেখানে তিতির লাল টুকটুক বেনারসিতে সেজে শুধু তুহিনের জন্যই অপেক্ষা করছে।

তুহিন প্রায় প্রতিরাতেই কল্পনায় তিতিরের ঘোমটা নামাতো।পকেট থেকে আংটি বের করে পরিয়ে,ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডোবাতো।ওর সাথে জীবনের পাওয়া না পাওয়াগুলো নিয়ে গল্প করতো।

ইস তখন যদি একটু সাহস করে তিতিরকে নিজের মনের কথাটা জানাতো,যদি তিতিরের কোন বন্ধুকে দিয়েই তিতিরকে চিঠি লিখে পাঠাতো, তাহলে হয়তো তিতির আজ অন্য কারো বৌ হতোনা। অনেকটা দেরী হয়ে ফেলেছে।এখন আর সেই সব ভাবনার কোন মূল্য নেই।

না তা বলে ভূলে যেতে পারবে না তিতিরকে।অনেকগুলি কঠিন কাজ অভ্যেস করার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হলো ভুলে থাকার অভ্যেস করা।

শুধু এতোদিন তুহিনের যে মন স্বপ্ন-অভিসারে আদিমতম সুখের আশকারা খুঁজতো,আজ সেই মন ডুবে যেতে চাইছে চিরতরে ভোরের সূর্য স্নানে।

সকাল হতেই চা-কফি ওয়ালাদের ভীড়।সুদর্শন নীচে নেমে এসে দুটো কফির অর্ডার দিলো।

‘সব পাখিরা উঠে গেলেও তিতির পাখির ঘুম ভাঙেনি এখনো’,কথাটা তুহিনকে বলতে বলতেই কফির কাপটা এগিয়ে দিলো সুদর্শন।
তুহিন হাত বাড়িয়ে কফিটা নিলো।

সুদর্শন বললো,’ঘুমোননি রাতে?চোখ দুটো লাল হয়ে আছে’।তুহিন বললো,’হুম নীচে এসেও ঘুমটা এলোনা।
তবে সত্যি কথা বলতে কী অনেককাল ঘুমিয়েই ছিলাম,কাল রাতেই ঘুম ভেঙেছে’।তুহিনের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলো না সুদর্শন।

সুদর্শন ব্যাগ থেকে স্লাইস কেক বার করে তুহিনের হাতে ধরালো,নিজেও নিলো।
তারপর বাঙ্কে উঠবার অর্ধেক সিঁড়ীতে উঠে তিতিরের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বললো,’পাখি নীচে নেমে এসো,কাল রাত থেকে পেট খালি’।

আড়মোড়া ভেঙে তিতির বললো,’ঘুমোতে দাও,পরে খাবো’।’আগে খাবে পরে ঘুমোবে’,সুদর্শনের কথায় কিছু একটা ছিলো,যাতে বাধ্য হয়ে তিতির নীচে নেমে ব্রাশ করে আসলো।

তিতির জানলার সামনে বসতেই সুদর্শন কেক এগিয়ে দিলো। তুহিন এখন নীরব দর্শক।দুজনের মধ্যে নিজেকে ওর অতিরিক্ত মনে হলো।ব্যাগ থেকে জীবনানন্দের একটা কবিতার বই খুলে বসলো।

সুদর্শন তুহিনের হাত থেকে বইটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে ফেরত দিয়ে বললো,’আপনি কি আবৃত্তি করেন?’।তুহিন বললো,’না না তেমন কিছু নয়,ভালো লাগে তাই পড়ি’।

সুদর্শন বললো,’তাহলে প্লিজ হয়ে যাক একটা,আজকের সকালটা আমাদের কাছে সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকুক’।

তুহিন ভরাট জমাটি গলায় পাঠ শুরু করলো,
“সুচেতনা তুমি এক দূরতম দ্বীপ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে,সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে নির্জনতা আছে………তুহিনের পাঠ চলতে থাকলো।

তিতিরের হাতের কেক হাতেই রয়ে গেলো।তিতির জানতোই না তুহিনদা এতো দারুণ আবৃত্তি করে।

তুহিনের পাঠ শেষ হতেই সুদর্শন শুরু করলো,”একদিন এ পৃথিবী জ্ঞানে আকাঙ্ক্ষায় বুঝি স্পষ্ট ছিলো,আহা,
কোনো এক উন্মুখ পাহাড়ে মেঘ আর রৌদ্রের ধারে,
ছিলাম গাছের মতো ডানা মেলে-পাশে তুমি রয়েছিলে ছায়া….সুদর্শন বলে চলেছে।

সুদর্শনের শেষ হতেই তুহিন তারপর আবার সুদর্শন….চলতেই থাকলো।তিতির শুধু মুগ্ধ শ্রোতা।দুজনের মধ্যে কে বেশী ভালো বক্তা সে বিচার করার ক্ষমতা তিতিরের নেই।আছে শুধু এক আকাশ ভালো লাগা।(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here