তিতির পাখির বাসা পর্ব-১৭

0
607

#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-১৭)
#জয়া চক্রবর্তী।

কথায় কবিতায় বেলা বাড়লো।তুহিনের চোখ জুড়ে ঘুম।কাল সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি তুহিন।

তুহিনের চোখ মুখ খেয়াল করে সুদর্শন বললো,’কিছু খেয়ে বরং দুপুরটা একটু ঘুমিয়ে নিন ওপরের বাঙ্কে উঠে’।

তুহিন বললো,’কিরে তিতির তোর আবার দিবানিদ্রার অভ্যেস নেইতো?তিতির হেসে বললো,আরে না না,দুপুরে আমি ঘুমোইনা’।

‘তাহলে তো আপনার প্রস্তাব চমৎকার,সত্যিই আজ ঘুমটা বড্ড প্রয়োজন আমার’,তুহিনের কথায় সুদর্শন হাসলো।

দুপুরের খাওয়ার খেতে খেতে তেমন কথা হলোনা কারোর।তুহিন খাওয়ারটা শেষ করেই সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলো বাঙ্কে।অনুমতি নিয়ে তিতিরের হাওয়া বালিশে মাথা দিয়ে পায়ের তলার কম্বলটা খুলে গায়ে চড়িয়ে নিলো।

কিন্তু ঘুমের বদলে এলো একরাশ অস্থিরতা।এই বালিশে তিতিরের মাথা ছিলো,এই কম্বলটাই তিতিরের সারা শরীরকে উষ্ণ রেখেছিলো এমন সব ভাবনা তুহিনের শরীর মন অসাঢ় করে দিচ্ছিলো।

তুহিন চোখ দুটো বুজতেই তিতিরের শরীরের ভার ওর শরীরের ওপর।তিতিরের নিশ্বাস পর্যন্ত ও অনুভব করতে পারছে।

কতক্ষণ সময় এইভাবে কেটে গেলো তুহিন নিজেই জানেনা।যখন চোখ খুললো,তখন দিনের আলো শেষ।ট্রেনের কামরায় আলো জ্বলছে।

তুহিনের শার্ট ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।হাতঘড়ি চোখের সামনে নিয়ে দেখলো সাড়ে আটটা বাজে।তুহিন বুঝলো, এতোক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো।

তুহিন পড়েছিলো, স্বপ্ন হলো অবচেতন মনের ইচ্ছে ও চিন্তা ভাবনার প্রকাশ।স্বপ্নেই আমরা কাঙ্ক্ষিত বস্তুর সান্নিধ্য পাই,প্রিয়তমার স্পর্শ পাই।

তুহিন বাঙ্ক থেকে নেমে আসে।সুদর্শন হেসে বললো,’কি ঘুমটাই না ঘুমোলেন।দাঁড়ান চা বলছি’।তুহিন চা খেতে খেতে গুনগুন করে সুর ভাজছিলো গলায়।সুদর্শন বললো,’আসতে কেন,গলা ছেড়ে হয়ে যাক’।

“আবার হবেতো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো,কি চোখে তোমায় দেখি বোঝাতে পারিনি আজো হয়তো”… তুহিন মান্না দের গানটা গেয়ে উঠলো।

গাইতে গাইতে তুহিনের চোখ তিতিরের চোখ ছুঁয়ে গেলো বেশ কয়েকবার।
তিতিরের মুগ্ধ দৃষ্টি তুহিনের ভালো লাগছিলো।

তুহিনের গান থামতেই তিতির বলে উঠলো,’তোমার এতো গুন আমি জানতাম না তুহিনদা’।

‘কেন জানলে কি প্রেমে পরতিস আমার?’তুহিনের কথায় তিতির জোরে হেসে উঠলো।
তুহিন বলে উঠলো,

না হয়,বেঁচে রইলি আমার মাঝে
এক টুকরো না পাওয়া হয়ে।
সব পাওয়া স্বর্ণোজ্জ্বল দিনের মাঝে
এক টুকরো মেঘ হয়ে।

সেই এক টুকরো ঘন কালো
পোয়াতি মেঘ চিরে,বৃষ্টি এসে না হয়
ধুয়ে দেবে আমার মনের
যাবতীয় দুঃখ,ক্লান্তি,হতাশা।

ছিঁড়ে দেবে পুরনো হিসেব খাতার
সমস্ত দেনা-পাওনার হিসেব।

না হয় বেঁচে রইলি আমার মনের
এক টুকরো মন খারাপ হয়ে।
বিগতা যৌবনা কোন গাছের ডালে,
মাকড়সার জালে লেগে থাকা,
সেই শিশিরের ছলে।

অমূল্য হীরক কুচি ভেবে হৃদয়ে ছোয়াতেই,
যা মিলিয়ে যাবে কোন এক যাদুমন্ত্রে।

সে যাদু মন্ত্রের ছোঁয়াতেই,
তোর মর্মর দেবীরূপ ভেঙে,
না হয় আবার মানবী হলি!!
চপল বালিকার মতোই,
না হয় ভুল করলি…
‘জীবনের যোগ-বিয়োগের হিসেব’।

সুদর্শন হঠাৎ ‘আসছি’ বলে উঠে
যেতেই তুহিন সম্বিৎ ফিরে পেলো।বুঝলো প্রচন্ড ভূল হয়ে গেছে।

মনে মনে ঠিক করলো,আর নয় নেক্সট স্টেশনেই নেমে পরবে।
কাল সারাটা রাত নিজের সাথে যুদ্ধ করে মনটাকে শান্ত করেছিলো।কিন্তু বুঝতে পারছে বাঙ্কে শোয়ার পর থেকে মনের লাগাম আর তার নিজের আয়ত্তে নেই।

ট্রেন থামতেই তুহিন তিতিরের দিকে তাকিয়ে ‘ভালো থাকিস’ বলে তিতিরকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত পায়ে নেমে পরলো অজানা স্টেশনে।

সুদর্শন অনেকক্ষণ সময় নিয়ে টয়লেটে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলো।কি যে করবে বুঝতে পারছে না।তুহিনের প্রতি তিতিরের মুগ্ধতা সুদর্শনের মনের গভীরে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে।

একা একা বসে আছে তিতির।সুদর্শন সেই যে আসছি বলে চলে গেলো, এখনো আসার নাম নেই।তুহিনদাও হঠাৎ নেমে গেলো কেনো,সেটাও ক্লীয়ার নয় তিতিরের কাছে।

ট্রেনটা হু হু করে ছুটছে।তিতির শান্ত মনে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না।এদিকে লাগেজ ছেড়ে সুদর্শনের খোঁজ করতে যেতেও পারছে না।সুদর্শন যে কেন এখনো আসছে না!অশান্তির ঝড় বয়ে যেতে লাগলো তিতিরের মনে।

কাল সকালেই ওদের হাওড়া পৌঁছোবার কথা।সুদর্শন কথা দিয়েছিলো, ফিরে গিয়েই ডিভোর্স নিয়ে কথা বলবে উকিলের সাথে।তিতির সুদর্শনকে বলতেও পারছেনা,যে আর সে ডিভোর্স চায়না।

‘কি হলো কোথায় ছিলে এতোক্ষন?’তিতিরের কথা শুনে সুদর্শন একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলো।’কি হলো জিজ্ঞেস করছি তো,কোথায় ছিলে এতোক্ষন?’সুদর্শন এবারো কোন উত্তর দিলোনা।’সেই কখন থেকে দুশ্চিন্তা করছি একা একা বসে’।

সুদর্শন চারদিকটা তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললো,’তোমার তুহিনদা কোথায়?’তিতির রাগ মিশ্রিত গলায় বললো,’সে আমি কি জানি?ট্রেন থামতেই নেমে গেলো’।সুদর্শন বললো,’হঠাৎ নেমে গেলেন কেন?’

তিতির বললো,’সেইতো আমি এখন পরের খবর নিয়ে বেড়াই।নিজেরটার কোন খবর থাকেনা আমার কাছে।আসছি বলে একঘণ্টা বাদে এসেও কোথায় ছিলো তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়না তার’।

সুদর্শন বললো,’নিজেরটা?কে তোমার নিজের?নিজের বলে ভেবেছো নাকি কখনো আমায়?ফিরে গিয়েই তো উকিলের কাছে ছুটতে হবে’।

তিতির রেগে বললো,’সে না ছুটলেই হয়,আমি তো আর মাথার দিব্বি দিয়ে রাখিনি যে আমায় ডিভোর্স দিতেই হবে।তাছাড়া তুমি চাইলেই বা কি,আমি তো আর ডিভোর্স দিচ্ছিনা তোমায়’।

তিতিরের কথায় অবাক সুদর্শন।’সেকি ডিভোর্স কেন্সেল মানে?তোমার মতো একটা রাগী মেয়ের সাথে আমায় কাটাতে হবে নাকি সারা জীবন?’

তিতির রেগে বাঙ্কে চলে গেলো।সুদর্শন অর্ধেক সিঁড়ি উঠে বললো,’না খেয়ে আবার উঠলে কেন উপরে?’
‘বেশ করেছি,আমি খাবোনা কিছু’।

তিতিরের কথায় সুদর্শন বলে,’খেয়োনা,খেয়োনা।আমি ও তোমার বাবাকে গিয়ে জানিয়ে দেবো প্রচণ্ড জ্বালাও তুমি’।

বাবার কথায় তিতিরের দুচোখে আগলে রাখা অপেক্ষার মোম গলে চোখ বেয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে।

সুদর্শন কথা না বলে তিতিরের হাত মুঠোয় ভরে নেয়,তিলে তিলে জমা করা ধৈর্য্য সময় হাতের মুঠিতে খুঁজে পায় সুখ- ঐশ্বর্য্য।ছুঁয়ে থাকা আঙ্গুল গুলিতে জন্ম নেয় শিকড়ের টান।

ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যেতেই তুহিন কান্নায় ভেঙে পড়ে।অলস পায়ের পাতা যে নির্ভীক পথিকের বেশে শুধু তিতিরের দিকেই যেতে চায়।(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here