তিতির পাখির বাসা পর্ব-৮

0
490

#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব-৮)
#জয়া_চক্রবর্তী

সিমলা মলের কাছেই একটা হোটেলে উঠেছে তিতিররা।হোটেলে ঢুকেই সুদর্শনের কথায় গরম জলে স্নান করে নিলো তিতির।কিন্তু ডাইনিং এ খেতে যাওয়ার আর ক্ষমতা নেই তিতিরের।কম্বলের ওমে নিজেকে মুড়িয়ে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলো।
অগত্যা সুদর্শন সার্ভিসিং এ ফোন করে রুমেই খাওয়ারটা দিতে বললো।

একপ্রকার জোড় করেই ঘুমন্ত তিতিরকে বসিয়ে নিজের হাতে একটা রুটি চিকেনকারি দিয়ে খাইয়ে,যত্ন করে মুখ মুছিয়ে দিলো সুদর্শন।

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো সুদর্শনের।তিতিরের নিশ্বাস পরছে সুদর্শনের ঘাড়ে।ঘুমের মধ্যেই তিতির কখন জড়িয়ে ধরেছে সুদর্শনকে।তিতিরের অর্ধেক শরীর সুদর্শনের শরীরের সাথে মিশে যাওয়ার, সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে সুদর্শনের।তিতিরের বুক ওঠানামা করছে সুদর্শনের গায়ে।এই ঠান্ডাতেও ঘামছে সুদর্শন।

না এরপর আর ঘুম আসেনি।নিজেকে সংযত রেখে,অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলো সুদর্শন।তারপর সময়ের গাড়ি চেপে আলো এলো,জল এলো,খবরের কাগজ এলো,শুরু হলো পথ চলা,কোথাও যানজট,কোথাওবা মুক্তি মন্ত্র- প্রভাতি সঙ্গীত।
কিন্তু সুদর্শনের অসহায় দিনলিপি যেন তিতির দিয়েই শুরু,তিতির দিয়েই শেষ।
সুদর্শনের গানের লাইনটা মনে পরলো,”সব পথ এসে মিলে গেল শেষে,তোমারি দুখানি নয়নে।”

অবশেষে ঘড়ির কাঁটার বাঁধা নিয়মের দোসর হয়ে,তিতিরকে সরিয়ে বিছানা ছাড়লো সুদর্শন।কাল রাতেই হোটেলে ঢুকে ট্রাভেল এজেন্সির সাথে কথা বলে দুদিনের প্রোগ্রাম ঠিক করে নিয়েছে সে।
সেই অনুযায়ী আজ ৮ টার মধ্যেই গাড়ী আসবার কথা।

তিতির ঘুমোচ্ছে।সুদর্শন প্রথম দর্শনেই,নিজের অজান্তে হৃদয় গোলাপটা তুলে দিয়েছিলো এই মেয়েটির হাতে(যে হাত এখনো আশ্চর্য রকমের শীতল)।

জানলার বড়ো বড়ো পর্দা সরিয়ে দিতেই প্রকৃতির অসাধারণ রূপ।

মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সুদর্শন। হঠাৎ দেখলো ওর পাশে তিতির।ওর চোখেও একরাশ মুগ্ধতা।কাল রাতে টয়ট্রেনে আসার সময়ও এই একই রকম মুগ্ধতা ছিলো ওদের দুজনের চোখে।পাহাড়ের গা বেয়ে টয়ট্রেন চলছিলো,কখনো অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ, কখনো বা টানেল দিয়ে।চার ঘন্টার পথ কিভাবে যে কেটে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি ওরা।

তিতিরকে চটপট রেডি হতে বলে,নিজেও রেডি হয়ে নিলো সুদর্শন।তারপর বেড়িয়ে গেলো গাড়ীর খোঁজে।তিতির আজ ডেনিম ব্লু-জিন্সের সাথে লাল জ্যাকেট পরলো।দীর্ঘ চুলটা আঁচড়ে নিয়ে,হাল্কা লিপস্টিক বুলিয়ে নিলো ঠোঁটে।

গাড়ীতে এসে বসতেই পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো গাড়ি।আজ জাখুপাহাড়ের জাখুমন্দির,ক্রাইস্ট চার্চ,সেন্ট মাইকেল চার্চ,রিজ,সামারহিল,গেইটি থিয়েটার কভার করার ইচ্ছে।কাল কুফরি, ফাগু হয়ে পরশু সকালেই মানালির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরবে,এমনটাই প্ল্যানিং সুদর্শনের।

গাড়ীর ড্রাইভারকেও সেই ভাবেই বোঝানো আছে।যেহেতু আগে দুবার ঘোরা আছে,তাই তিতিরকে প্রতিটি জায়গার বিশেষত্ব নিয়ে খুব সুন্দর করে গল্প শোনাতে পারছে সুদর্শন।গেইটি থিয়েটার দেখে তিতির ভীষন উচ্ছ্বসিত। এটা মূলত ব্রিটিশদের বিনোদনের জন্য এক প্রদর্শনী সভা।সিমলার চার্চগুলোতে অসাধারণ কাজ করা কাঁচের জানলা,মার্বেলের বেদী,পাইপ অর্গান দেখে তিতির মুগ্ধ।নিজে থেকেও অনেক প্রশ্ন করছে সুদর্শনকে।তিতিরের উচ্ছ্বাস ভালো লাগছে সুদর্শনের।

ওক,সেডার,রডোডেনড্রন ইত্যাদি পাহাড়ি গাছ,যা এতোদিন শুধুমাত্র ভূগোল বই এ পড়েছিলো সেগুলো সুদর্শন চিনিয়ে দিলো সামারহিলে যাওয়ার পথে।

হোটেলে ফিরেই দেখলো অচিন্ত্য আর দিয়া ওদের সাথে দেখা করার জন্যই বসে আছে।ওরা পরেরদিন সকালেই বেড়িয়ে পরবে মানালির উদ্দেশ্যে।ডিনারটা চারজন একসাথেই করলো।

রাতে শোয়ার পরে আজ আর ঘুমিয়ে পরলোনা তিতির।সদ্য ঘোরা জায়গা গুলো নিয়ে অনর্গল কথা বলে চলেছে।
সুদর্শন একসময় বললো,’আমি কি তোমার চুলে বিলি কেটে দেবো?কাল সকালে উঠতে হবে যে।’
তিতির বাধ্য মেয়ের মতো চোখ বুজে,নিজেই সুদর্শনের হাতটা টেনে মাথায় রাখলো।সুদর্শন মুখটা নামিয়ে তিতিরের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ওকে শুভরাত্রি জানালো। তিতিরের চুলে বিলি কেটে ঘুম পারিয়ে,নিজেও ঘুমিয়ে পরলো দুচোখে স্বপ্ন মেখে।

স্বপ্নরা ফিরে ফিরে আসে,
স্বপ্নরা ফিরে ফিরে যায়।
রক্ত পায়ে জীবন চলার পথ,
চলার ছন্দে থেমে থেমে যায়।
হঠাৎ আসে দুঃখ মেঘের ঝড়,
এলোমেলো হাওয়ার কথকতা
হঠাৎ কোথাও সুখের টলোমল
দুঃখ তখন সুখের সাথে মিতা।

ঘুম ভাঙলো তিতিরের ডাকে।সার্ভিসিং রুমে ফোন করে তিতির নিজেই ব্রেকফাস্ট এর অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলো।সুদর্শন দাঁত মেজে,চোখে মুখে জল দিয়ে, একসাথে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলো।
তিতির রেডিই ছিলো,সুদর্শন গরম জলে স্নান সেরে, নিজেও চট করে রেডি হয়ে নিলো।আজ সিমলায় তাদের দ্বিতীয় আর শেষ দিন।দুজনেই এক সাথে বেড়িয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলো।

সুদর্শন জানালো,আজ ওরা কুফরি আর ফাগু কভার করবে।
কুফরি সিমলা থেকে প্রায় ১৩/১৪ কিলোমিটার দুরের একটা ছোট্ট হিল স্টেশন।এখানেই হিমালায়ান ওয়াইল্ড লাইফ জু আছে।ফেব্রুয়ারি মাসে কুফরিতে উইন্টার স্পোর্টস ফেস্টিভাল হয়।
আর দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক তখন কুফরিতে ভীড় জমায়।

এই প্রথম তিতিরের বেড়াতে এসে ভালো লাগছে,কারন সুদর্শন প্রতিটি জায়গায় যাওয়ার আগে ও সেই স্পটে পৌঁছে সেই জায়গা নিয়ে অনেক খুঁটিনাটি খবর দিচ্ছে।সুদর্শনের সাথে কথা বলতে বলতে আর পথের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তিতিরদের গাড়ি থেমে গেলো।বাকী পথ ঘোড়ায় যেতে হবে।এবার তিতিরের ভয় করতে শুরু করলো।ঘোড়া সে চড়েনি কখনো। কিন্তু ঘোড়া ছাড়া ওই পথে যাওয়া অসম্ভব।সুদর্শন ভরসা দিয়ে কোলে তুলে নিজেই তিতিরকে ঘোড়ায় বসিয়ে দিলো।তিতির ভয়ে চোখ বুজে ছিলো।চোখ খুলতেই দেখলো সুদর্শনের মুখে দুষ্টু হাসি।তিতির হেসে ফেললো।

ঘোড়াগুলো সব পর্যটকদের পিঠে নিয়ে এক লাইনে,এক ছন্দে, খাদের গা ঘেঁষে হেঁটে চলছে।
সিনেমায় দেখা ঘোড়া গুলোর মতো এই ঘোড়া গুলো ছুটছে না দেখে,তিতিরের ভয়টা অনেকটাই কেটে গেছে।ও আনন্দের সাথে চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছে গন্তব্যে।মাঝে মাঝে সুদর্শনের সাবধান বানী শুনতে পাচ্ছে,’লাগাম শক্ত করে ধরে রেখো’ বা ‘নীচের দিকে তাকিও না’।

অবশেষে ওরা কুফরি পৌঁছোলো।সুদর্শন এবারো কোলে করে নামিয়ে দিলো তিতিরকে।সুদর্শনের পুরুষালি গন্ধ তিতিরের অজান্তেই আচ্ছন্ন করে দিলো শরীর।তিতির লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো।

কুফরি থেকে ফাগু প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে ।শীতকালে ফাগুতে স্কিয়িং আর উইন্টার স্পোর্টস এর জন্য পর্যটকরা ভিড় করে।স্থানীয় মানুষরা গরমকালে এখানে এসে পিকনিক ও করে। কুফরি আর ফাগু দুটোই ভীষন এঞ্জয় করলো তিতির।এর আগে বেশ কয়েকবার সমুদ্রে গেলেও পাহাড়ে এই প্রথম।
মনের মনিকোঠায় সঞ্চয় হয়ে রইলো এক আকাশ ভালো লাগা।

শোয়ার আগেই ব্যাগ গুছিয়ে রাখলো সুদর্শন কারন পরের দিন সকালেই ওদের গন্তব্য বরফের রাজ্য মানালি।(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here