#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (০৭)
তাহেরা বেগম লুবনার রুমে ঘুমালেন।অনেক দিন পরে নিশ্চিন্তে ঘুমালেন আজ।ঘুম থেকে উঠার পর তার মনে হলো আজকে থেকে তার চোখের সামনে আর ছোটলোকের মেয়েকে দেখতে হবে না।ফুরফুরে মেজাজে তিনি রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকলেন।হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে এলেন।সোফায় হামিদুর রহমান সাহেব বসে আছেন।তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
এতোক্ষণে তাহেরা বেগমের মনে হলো,সারারাত হামিদুর রহমান বাসায় ছিলো না।
তাহেরা বেগম নবনী চলে যাওয়ার আনন্দে হামিদুর রহমানের কথাই ভুলে গেলেন।হামিদুর রহমান তাহেরাকে দেখে বললো,”আমার পাসপোর্ট দাও।”
তাহেরা শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কেনো?”
হামিদুর রহমান রেগে গেলেন। রাগী স্বরে বললেন,”দিতে বলেছি দাও,বাড়তি কথা আমার সাথে বলবে না।আমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য না।”
তাহেরা আর কথা না বাড়িয়ে রুমে গেলো।হামিদুর রহমান ও তার পেছন পেছন গেলো।পাসপোর্ট বের করে দিলো।হামিদুর রহমান তার লাগজ গুছাতে লাগলেন।তাহেরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি কি আজকে চলে যাবেন কানাডায়? ”
হামিদুর রহমান বললো,”হ্যাঁ। ”
তাহেরা আবারও জিজ্ঞেস করলো,”আপনার না আরো ১০-১২ দিন পরে যাওয়ার কথা ছিলো?”
হামিদুর রহমান থমথমে গলায় বললো,”এই জাহান্নামে এক মুহূর্ত ও আমি থাকতে রাজি না।”
তাহেরা বেগম বাহিরে গিয়ে তামিম,দিশা,লুবনাক ডাকলো।ডেকে বললো,”তোর বাবা তো আজকে চলে যাচ্ছে।”
সামিম ওয়াশ রুমে ছিলো।সে কিছুই শুনতে পেলো না।
দিশা হেসে বললো,”তাহলে তো খুবই ভালো হবে মা।বাবা থাকলে ভাবীকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসার একটা রিস্ক থেকে যাবে।বাবা চলে গেলে মনে করেন ভাবী এই বাড়িতে না।কিন্তু বাবা একবার বললেই চলে আসবে।”
তাহেরা বেগম ভেবে দেখলেন আসলেই তো ঠিক বলেছে দিশা।লুবনা বললো,”মা ভাবী কি একেবারে চলে গেছে?”
তাহেরা বেগম ফিসফিস করে বললো,”তা নয়তো কি?আমি কি ওই ফকিরের মেয়েকে দ্বিতীয় বার ঘরে তুলবো?তামিমের বিয়ে হবে নিতুর সাথে। মাস গেলে ২৫ হাজার টাকা বউ আমার হাতে তুলে দিবে।আমার তো ভাবলেও কেমন আনন্দ লাগে।”
দিশা মুচকি হেসে মনে মনে বললো,”তামিম ভাইয়ের বিয়ে যে কার সাথে হবে আপনি এখনো বুঝতে ও পারেন নি।আপনার সাথে মধুর ব্যবহার করছি কি এমনি এমনি! ”
লুবনা চিৎকার করে বললো,”হুররে,তাহলে বাবা ভাবীর জন্য সেদিন যা যা এনেছে ওগুলো সব আমার। ”
লুবনা তামিমের রুমের দিকে দৌড়ে গেলো।
লুবনার পিছন পিছন দিশাও গেলো।চুড়ি কসমেটিকস সবকিছু দুজন সমান ভাগ করে নিলেও ঝামেলা বাঁধলো কাঞ্জিভরম শাড়িটি নিয়ে।
ওই শাড়িটি দু-জনের পছন্দ। কেউ কাউকে দিবে না।তাহেরা বেগম পড়ে গেলেন বিপাকে।কাকে কি বলবেন তিনি!
এ-তো নবনী নয় যে তিনি যা বলবেন তাই শুনবে সে।দিশা কিছুতেই শুনবে না।আর দিশাকে কিছু বলতেও তিনি ভয় পান কিছুটা।
এদিকে মেয়েকেও বলতে পারছেন না কিছু।সামিম একবার বাহিরে এসে নিজের স্ত্রী আর বোনের মধ্যে ঝগড়া দেখে রুমে চলে গেলো। ভোররাতেই সে চট্টগ্রাম চলে যেতো কিন্তু সারারাত বাবা আসে নি দেখে আর যেতে পারে নি।
হামিদুর রহমান নিজের রুমে থেকে শুনতে পেলেন বসার ঘরে ধুম ঝগড়া হচ্ছে। একবার উঁকি দিয়ে দেখলেন দিশা আর লুবনা মিলে ঝগড়া করছে শাড়ি নিয়ে।
হামিদুর রহমানের হঠাৎ করেই মনে হলো তিনি আসলে কি এই পরিবারের কেউ!
তিনি চলে যাচ্ছেন শুনেও কারো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কেউ একবার তাকে বললো ও না কেনো চলে যাচ্ছে?
কেউ এসে তার সাথে কথা ও বললো না।
তাহলে কেনো মিছে মায়া সন্তানের জন্য তার?
তিনি তো চাইলে পারতেন তামিমকে কঠোর শাস্তি দিতে।নবনী তার এতো প্রিয় ছিলো,তবুও তো তিনি তার সন্তানের প্রতি কঠোর হতে পারেন নি।
স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন নি।
অথচ এরা কেউ তার চলে যাবার কথা শুনে ও কোনো শোক প্রকাশ করলো না।একবার পাশে এসে দাঁড়ালো না।তারা ব্যস্ত তাদের নিয়ে!
এই ছেলে মেয়ে স্ত্রীর জন্যই কি-না তিনি এই ৫৭ বছর বয়সে ও এসে বিদেশে পড়ে আছেন।শুধু দেশে তারা সুখে থাকবে বলে!
কনকনে শীতের মধ্যে ও কাজ করেছেন যাতে ছেলে মেয়েরা দেশে শান্তিতে মাছে ভাতে খেয়ে দিন কাটাতে পারে।ছেলেরা ভালো করে লেখাপড়া করতে পারে। তাদের আরাম আয়েশের জন্য গাড়ি কিনে দিয়েছেন।
বিনিময়ে স্ত্রী সন্তানের কাছ থেকে তিনি কি পাচ্ছেন আজ?
হামিদুর রহমানের বুক ভারী হয়ে এলো।কোনোমতে টলতে টলতে রুম থেকে বের হলেন।আগে তাকে টিকিট কাটতে হবে।আজকের টিকিট না পেলে কাল পরশু যে দিনেই টিকিট পান সেদিন যাবেন।আপাতত একটা হোটেলে উঠতে হবে তাহলে তাকে তারপর।
ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলো দিশা শাড়ির এক মাথা টেনে ধরে আছে অন্য মাথা লুবনার হাতে।দুজনেই এক নজর তাকালো তার দিকে।তারপর শাড়ি নিয়ে টানাটানি করতে লাগলো। তাহেরা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।তামিম এক সোফায় বসে বসে নখ কাটছে।সেও এক নজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
তার দিকে তাকানোর সময় কারো নেই।সবাই দেখেও চুপ করে রইলো। কেউ তাকে আটকাতে চাইলো না।অথচ এদের নিয়ে তার কতো স্বপ্ন ছিলো।
তিনি তো ঠিক করে ও রেখেছেন যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে ফ্যামিলির সবাইকে নিয়ে ঘুরে আসবেন কোথাও থেকে।
বিদেশে গেলে দিশার ছেলেমেয়ের জন্য গহনা কিনবেন।মেয়ের বিয়ের জন্য গহনা কিনবেন।দুই ছেলের জন্য লেটেস্ট মডেলের ফোন কিনবেন।এতোসব ভেবে রেখেছেন যাদের জন্য তারা তো একবার ও তার কথা ভাবলো না।কেউ এসে তার সাথে একটা কথাও বললো না।মিথ্যে এই জগৎ সংসার,মিথ্যে সব মায়া।
বুকে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে বাসা থেকে বের হলেন।লিফটের দরজা বন্ধ হতেই হামিদুর রহমান অনুভব করলেন তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।ঘামে পুরো শরীর ভিজে গেলো। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো।
লিফট চার তলা থেকে নিচে নামতে নামতে হামিদুর রহমান সাহেব অজ্ঞান হয়ে গেলো।
নিচতলায় এসে লিফটের দরজা খুলতেই লোকজন দেখলো হামিদুর রহমান অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।মুহুর্তেই নিচে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেলো। দারোয়ান তামিমদের বাসায় ফোন দিলো।
সামিম ফোন ধরতেই শুনতে পেলো তার বাবা লিফটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।পাগলের মতো মা’কে বলে সামিম ছুটে বের হয়ে এলো সিঁড়ি বেয়ে। তাহেরা বেগম ভারী শরীর নিয়ে ছুটতে পারলেন না।
তামিম চোরের মতো পা টিপে টিপে এলো অনেক পরে।ততক্ষণে সামিম তার বাবাকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিয়েছে।
দিশা লুবনা কেউই এলো না।দুজনেই শাড়ি নিয়ে বসে আছে।
সামিম বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আধাঘন্টা পর তাহেরা বেগম সিএনজি করে হাসপাতালে পৌছালেন।তামিম অফিসে চলে গেছে।
এক ঘন্টা পর ডাক্তার এসে জানালো হামিদুর রহমান আর বেঁচে নেই। হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন তিনি।
তাহেরা বেগম কি করবেন বুঝতে পারলেন না।কান্না করবেন না-কি ছুটে যাবেন স্বামীকে দেখতে কিছুই তার মাথায় ঢুকলো না।হতভম্ব হয়ে সামিম ফ্লোরে বসে পড়লো। তার যে বাবাকে অনেক কথা বলার বাকি ছিলো!
আর কি সে সুযোগ পাবে বাবাকে এসব বলার!
বাবা কি আর একবার চোখ খুলে তাকাবে না?
একটা বার কি তার মাথায় হাত রাখবে না?
কতোদিন বাবা তার নাম ধরে ডাকে না।একবার কি ডাকবে না?
হায়,এই পৃথিবীতে আর কোথায় পাবে সে মাথার উপরে বাবা নামক বটগাছের দেখা!
চলবে…..
রাজিয়া রহমান