তৃষ্ণা পর্ব ১৬

0
1223

তৃষ্ণা
পর্ব ১৭
মিশু মনি
.
কিশোরী বয়সের ভালো মন্দ দুটো ব্যাপার আছে। কিন্তু মেয়েরা মন্দ দিকটাকেই বেশি ভালোবাসে। মেয়েদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা উঠতি বয়সে কারো কথাকে কানে তুলতে চায় না। ভাবে অন্য কেউ তার সুখে হিংসে করে ভুলভাল বকছে কিংবা যা বলছে তা করতে তাদের মন সায় দেয় না। কিশোরী বয়সের বায়বীয় আবেগ বাড়তেই থাকে, এতে কেউ জল ঢালতে এলে পারলে মেয়েরা তাকে উপড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু নিজের আবেগটাকেই সবচেয়ে বড় জ্ঞান মনে হয়। যা ভালোলাগে, সেটাই করতে হবে এরকম একটা ঝোঁক মাথায় চেপে বসে। সাধারণত এ সময় তারা ভাবতেও চায় না ভবিষ্যতে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে!

অভাগিনী তৃষ্ণা মাহিবের থেকে হাজার পাঁচেক টাকা ধার নিয়ে হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। অসুস্থ শরীরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। শরীরে এতটুকুও শক্তি নেই, কিন্তু অবলা মন বড্ড জেদী। জেদ করেই মাহিবের থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে আর এক মুহুর্ত ও থাকতে চায়নি অংশী। এখন বেরিয়ে এসে আর পা নড়ছে না কোথাও যেতে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিরবে অশ্রুপাত করছিলো।

মাহিব এসে পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘যা করতে পারবে না তা করতে চাও কেন?’
অংশী ফিরে তাকায়, চোখে সাগরের জল উছলে উঠছে। মাহিব অংশীর চোখ মুছে দিয়ে বলে, ‘তুমি আমার সাথেই থাকো। কোনো বাঁধা তো এতে দেখছি না আমি। আমার সাথে থাকলে তোমার কষ্টেরও কারণ দেখি না। একটা বাচ্চা নষ্ট করলে কি এমন ক্ষতি হয়?’

অংশী মাহিবকে জাপটে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। মাহিবের কলার দুহাতে টানতে টানতে আর্দ্র কণ্ঠে বললো, ‘আমি আপনেরে ছাড়া বাঁচতে পারুম না। আমি আপনেরে প্রচন্ড ভালোবাসি মাহিব সাহেব। নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসি। নিজের জন্য কোনোদিনো কাঁদিনাই, আপনি চইলা আসার পর কত রাত কান্নাকাটি কইরা পার করছি আপনে জানেন না। ক্যামনে আমি আপনেরে ছাইড়া বাঁইচা থাকুম মাহিব সাহেব? ক্যামনে?’

মাহিব অংশীর হাত শক্ত করে ধরে নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো, ‘আমি সবসময় তোমাকে আমার পাশে রাখতে চাই। আমিও যে তোমার পরশ অনেক মিস করি। তোমাকে ছাড়া থাকতে আমারও কষ্ট হবে অংশী।’

অংশী হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘আপনে তো আমারে বিয়া করবেন না। আপনে আমারে একলা ফালাইয়া রাখবেন। এত নিষ্ঠুর নিয়ম আপনেরা ক্যান বাইর করছেন?’
– ‘এটাকে বলে লিভ টুগেদার। শহরে এসবই চলে তুমি বোধহয় জানো না। একসাথে যতদিন ইচ্ছে থাকবো, এরপর যদি মনেহয় আমরা সারাজীবন একসাথে ভালো থাকবো তাহলে বিয়ে করবো নয়তো নয়।’
– ‘আপনেগের শহরের এইসব নিয়ম কানুন কারা বানাইছিলো? পাইলে তারারে মাইরা ফালাইতাম। এত নিচু মন নিয়া ক্যামনে এই শহরে আপনেরা চলাফেরা করেন? শরম করে না?’

মাহিব অংশীর হাত ছেড়ে দিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘যা বলবা মুখ সামলে বলবা। আমি তোমাকে থাকতে বলিনি।’

তারপর অংশীর মুখের কাছে মুখ এনে মাহিব ফিসফিস করে বললো, ‘আমার বিছানায় যাওয়ার জন্য হাজারটা মেয়ে পাগলের মত পিছে পিছে ঘোরে। আমাকে একরাতের জন্য হলেও পেতে চায়, এরকম মেয়ের অভাব নেই। তোমার ভাগ্য ভালো যে নিতান্ত অসহায় বলে আমি তোমাকে নিয়ে লিভিংয়ে থাকতে চেয়েছি।’

অংশীর গাল বেয়ে আবারো অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। নিষ্ঠুরের মত লোকটা কথা বলে যায়, কথাগুলো কলিজায় গিয়ে লাগে। বুক ছিঁড়ে খানখান হয়ে যায়। না সহ্য করা যায়, না কিছু বলা যায়। অংশী মাথা নামিয়ে নিলো।

মাহিব বললো, ‘এখনও সময় আছে ভেবে দেখো। যাওয়ার ইচ্ছা হলে যাও। আমার দরজা তোমার জন্য খোলা রইলো। প্রয়োজন মনে হলে ফোন করো।’

অংশীর খুব অভিমান জমতে শুরু করেছে। এরপরেও আর দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। জীবনের কঠিন মুহুর্তে এসে ও হারে হারে টের পাচ্ছে জীবন কি! বাস্তবতা বয়স মানে না, ছোট বড় সবার জীবনে আছড়ে পড়ে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের মত। অংশী চোখ বুজে কয়েক ফোঁটা জল ফেললো।

মাহিবের থেকে ধীরেধীরে পিছিয়ে আসতে লাগলো অংশী। তারপর একসময় আড়াল হয়ে গেলো। মাহিব অপলক ভাবে চেয়ে রইলো অংশীর পথের দিকে। আটকাতেও পারলো না, চলে যেতে দিতেও কষ্ট হচ্ছে। নিবিড়ভাবে তাকিয়ে থেকে অংশীর চলে যাওয়া দেখলো।

১৯
ব্যস্ত ঢাকা শহর। মানুষ ছুটছে তাদের কর্মক্ষেত্রে। বিশাল হাইওয়েতে মানুষ দাঁড়াবার মত জায়গা নেই। একটার পর একটা গাড়ি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর পিঁপড়ার মত আগাচ্ছে গাড়িগুলো। রাস্তার উপরে ওভারব্রিজ, সেখানেও মানুষ দাঁড়ানোর মত জায়গা নেই। মানুষে গিজগিজ করছে চারিদিক। লোকজন অংশীকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছে। ধাক্কা খেতে খেতে ওভারব্রিজের খুঁটি ধরে দাঁড়ালো অংশী। এখন যাওয়ার মত কোনো জায়গা নেই। নিরবে অশ্রু ফেলতে ফেলতে ভাবতে লাগলো, কতই না সুখে ছিলাম। প্রতিদিন সকালে আয়না বুলবুল কে নিয়ে ঘুম ভাংত, মায়ের শাসন, বাবার আদর, পাহাড়ি বান্ধবীদের নিয়ে হাসাহাসি। জংগলে গিয়ে বসে থাকা। সবমিলিয়ে একটা অর্থপূর্ণ স্বাধীন জীবন ছিলো। সবকিছু কেমন করে হারিয়ে গেলো নিজের ভুলের কারণে। একটা ছোট্ট ভুল, একটা নিষ্পাপ আবেগ, পাপে জরাজীর্ণ করে দেয় মানুষের জীবন। এখন অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া ছাড়া ক্ষমা প্রাপ্তির কোনো পথ নেই।

খুঁটির নিচেও এক লোক অংশীকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। চোখ মুছে হাঁটতে শুরু করলো অংশী। ফুটপাত ধরে লোকজনের দেখাদেখি হাঁটছিলো। সবই দোকানপাট, মানুষে গিজগিজ করছে। এখানে মানুষ কোথায় থাকে অংশী জানে না। কার বাসায় গিয়ে আশ্রয় চাইবে?

সূর্যের রোদ তপ্ত হয়ে উঠেছে। গা ঘামছে ক্রমাগত, হাঁটছে অংশী। একসময় পথের মাঝখানে বসে পড়লো। এক মহিলাকে ভিজ্ঞা করতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘এইখানে মানুষের বাড়ি কোনগুলান?’
মহিলা অংশীর কথা বুঝতেই পারলো না। অনেক সময় লাগলো ওনাকে বুঝাতে। সে অংশীকে দেখিয়ে দিলো মানুষের নিবাস কোনগুলো। কিন্তু একবারের জন্য জানতেও চাইলো না অংশী কোথায় যেতে চায়। এখানেই বোধহয় শহরবাসী আর গ্রামবাসীর পার্থক্য। একটা মানুষ অসহায় অবস্থায় থাকুক,বিপদে থাকুক, শহরের মানুষ গুলোর তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।

রাস্তা পার হতে পারলো না অংশী। ভয়ে রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো। ক্রমাগত চোখ মুছতে লাগলো। রাস্তার পাশে একটা বিশাল দালান দেখে মনেমনে ভাবলো আগে এই বাড়িটাতেই যাই, যদি কিছু উপায় মেলে।

বাড়ির গেটের সামনে উঁকিঝুঁকি মারতেই দাঁড়োয়ান জিজ্ঞেস করলো, এই মেয়ে কি চাও এইখানে?

অংশী ধমক শুনে ভয়েভয়ে তাকিয়ে রইলো। অংশীর মুখ দেখে দাঁড়োয়ান বুঝে গেছে নিশ্চয়ই কোনো ধান্ধা নিয়ে এসেছে। একে তো সুন্দরী মেয়ে, তার উপর কান্নাকাটি। সে ধমক দিয়ে বললো, এইখানে থাইকো না। যাও এইখান থেকে যাও।

হায়রে মানুষ! কত নিষ্ঠুর আচরণ সবার। মানুষের মত নিষ্ঠুর প্রাণী জগতে কি আর একটিও আছে? অংশী ভয় পেয়ে আর কোনো বাড়িতেই যাওয়ার সাহস করলো না। পথের ধারে বসে রইলো। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। আগে কিছু খাওয়া দরকার। কিন্তু খাবার কোনো দোকানই খুঁজে পেলো না অংশী। এক মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এইখানে খাবার দোকান আছে?’
মহিলা অনেক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘সামনে হাঁটো৷ একটা ভাতের দোকান পাইবা।’

অংশী সামনে হাঁটা ধরলো। কিছুদূর এগিয়ে এসে দেখলো পথের ধারে ভ্যানের উপর বিশাল হাড়িতে করে এক লোক তার স্ত্রী সহ ভাত বিক্রি করছে। রাস্তায় বসে লোকজন সেই ভাত খাচ্ছে। অংশী ওড়নার আঁচল থেকে টাকা বের করে একটা একশো টাকার নোট নিলো, দোকানিকে গিয়ে বললো ভাত দিবেন?

অংশীর প্রশ্নে অবাক হয়ে তাকালো দোকানী। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো ওনার।

অংশী একশো টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিলো। দোকানী টাকা নিয়ে এক প্লেট ভাত এগিয়ে দিলো অংশীর দিকে, ‘কি দিয়ে খাইবা?’

তরকারি নিয়ে খেতে বসে গেলো অংশী। রাস্তায় বসে ভাত খেতে গিয়ে চোখ ফেটে কান্না আসলো। হায়রে নিষ্ঠুর ভাগ্য। বাবা কত আদর করে ভাত খাওয়াতো। অথচ আজ রাস্তায় বসে ভাত খেতে হচ্ছে। পাশেই ঘেউঘেউ করছে একটা কুকুর। কুকুরের গায়ের কিছু অংশে চামড়া নেই, গরম পানি দিয়ে ঝলসে গেছে। যে শহরের মানুষ সামান্য কুকুরকেও দয়া করে না, সে শহরের কেউ ওকে দয়া করবে না এই ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অংশী।

খাবার খেয়ে অনেক্ষণ রাস্তার পাশেই বসে রইলো। দোকানীর স্ত্রী মহিলাটিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এইখানে আপনেরা কই থাকেন?

মহিলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, ‘ক্যান? শুইনা কি করবা?’
– ‘আমি একটা থাকার জায়গা খুঁজতাছি।’
– ‘ঢাহা শহরে নতুন আইছো নি?’

অংশী মাথা নাড়লো। মহিলা বললো, ‘আমাগো বস্তিতে থাইকবা নি? আমাগো পাশের গর বারা অইবো। বারা পড়বো মাসে পনেরশো টেকা। থাইকবা নি?’

অংশীর চোখ চকচক করে উঠলো। এই মুহুর্তে ওর কাছে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা আছে। আপাতত এই দিয়ে একটা আশ্রয় অন্তত জুটিয়ে নেয়া যাক। পরে নাহয় কাজ জুটিয়ে নেবে।

ও মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হু থাকমু। আমারে নিয়া যান।’
– ‘হ, দোকান ফালাইয়া তোমারে নিয়া যামু না? এইহানে বইয়া থাহো। রাইতে নিয়া যামু।’

অংশী অগত্যা পথের ধারে বসে পড়লো। কুকুরটা অংশীর পাশে এসে জামাকাপড় শুঁকছে। গায়ের ঝলসানো চামড়া দেখে মায়া হলো অংশীর। কুকুরের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললো, ‘আমি আর তোর একই দশা রে। আমার আপনজন আমার শরীর ঝলসায়া দিছে।’ সারা গায়ে মারের দাগ স্মরণ করে আবারও চোখ ভিজে আসতে লাগলো অংশীর।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here