তৃষ্ণা পর্ব ২০

0
1045

তৃষ্ণা
পর্ব ২০
মিশু মনি
.
প্রীতমের চোখেমুখে রাজ্যের কৌতুহল। মাহিবের সাথে অংশীর সম্পর্কের সূচনা থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে কিছুই বলা বাদ রাখেনি অংশী। সবটা শুনে প্রীতম বিমূঢ় চেহারায় তাকিয়ে রইলো। এরকম কিছু যে ঘটবে সে সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা ছিলো প্রীতমের। অংশীকে প্রথম দিকেই বারণ করে দিয়েছিলো, সতর্ক করে দিয়েছিলো যাতে অংশী প্রীতমের পথে পা না বাড়ায়। তবুও বাঁধা শোনেনি অংশী। কিশোরী মন বড় বিচিত্র। কোনো প্রতিকূলতাকে সে যেমন তোয়াক্কা করে না, তেমনি কোনো বিধিনিষেধ শোনবার সময়ও তার নেই। আপন অভিপ্রায়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠা কিশোরীর বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতি শুনে নির্বাক প্রীতম আফসোস ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না।

অংশীর চোখের মুছে দেয়ার অধিকার তার নেই। অংশীকে ভালোবাসার সুযোগটাও বাকি নেই, অংশী নিজেই নিজেকে ভালোবাসার দ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছে। প্রীতমের এই মুহুর্তে সামান্য সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়াটাই মানবধর্ম।

প্রীতম অনেক বুঝিয়ে অংশীকে তার বাসায় নিয়ে এলো। যদিও শতবার আপত্তি জানিয়েছিলো অংশী। কিন্তু এই দুঃসহ সময়ে একমাত্র প্রীতমকেই আপনজন বলে মনে হচ্ছে অংশীর। যখন পৃথিবী চারিদিক থেকে নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে, অন্ধকার জগতে প্রদীপের আলো ধরার মত কেউ নেই। সেই পৃথিবীতে প্রীতমের সতর্ক করে দেয়া কথাগুলো স্মরণ করে কিছুটা হলেও ভরসা করতে পারছে অংশী।

প্রীতমের বাসায় মা ও ছোট বোন আছে। তারা কৌতুহল দমাতে না পেরে জানতে চাইলো কে এই মেয়ে? জামাকাপড়ের শ্রী দেখে নিতান্ত গরীব ঘরের মেয়ে বলেই বোধগম্য হয়। প্রীতম মাকে বুঝিয়ে বলে মেয়েটি দারুণ অসহায় অবস্থায় তার কাছে এসেছে, এই মুহুর্তে অংশীর পাশে দাঁড়ানো প্রীতমের কর্তব্য। ছেলের কথা শুনে মা আর কোনো দ্বিরুক্তি করে নি।

অংশী জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করছিলো। জীবন কোথা থেকে কোথায় বয়ে নিয়ে চলে! গতকাল ঠিক একই সময়ে সে ছিলো কোথায়, আজ কিছুক্ষণ আগেও তার পায়ের নিচে মাটি ছিলো না। অথচ এই মুহুর্তে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে আশ্রিত। সবই বিধাতার অদ্ভুত খেলা। জগতের এই বিচিত্র নিয়ম, জীবন কাকে কখন কোথায় নিয়ে যায়!

প্রীতম অংশীর ঘরে প্রবেশ করে আলো জ্বালিয়ে দেয়। অংশী চমকে উঠে চোখ মেলে। প্রীতম বলে, ‘ঘর অন্ধকার করে বসে আছো যে?’
– ‘জীবনটাই যখন অন্ধকার হইয়া গ্যাছে..’
– ‘আলো জ্বালিয়ে দিলাম।’

অংশী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রীতম বিছানার কাছে এসে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। অংশী ব্যস্ত হয়ে উঠতে গিয়ে আঃ শব্দ করে ওঠে। প্রীতম বলে, ‘ব্যথা পেলে?’
– ‘আমার আবার ব্যথা!’

আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অংশী। প্রীতম কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়, ‘কি হয়েছে বলো তো?’

অংশী জামার হাতা তুলে বাহুতে মারের কালো দাগগুলো দেখায় প্রীতমকে। দেখে শিউরে ওঠে প্রীতম। ভয়ার্ত গলায় জানতে চায়, ‘কি করে হলো এমন?’
– ‘আমার পাপের দাগ। মায়ে মারছে, পেয়রার ডাল দিয়া। ব্যথা ভালা হইয়া গ্যাছা তাও দাগ যায় নাই।’

শুকনো মুখে হাসার চেষ্টা করলো অংশী। প্রীতম স্বান্তনা দিয়ে বললো, ‘তোমার শরীর অনেক খারাপ অংশী। আমি কিছু মেডিসিন এনে দেবো, নিয়মিত খাবে। আর তোমার এখন খুব সাবধানে চলতে হবে। মনে থাকে যেন।’

অংশী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো প্রীতমের পানে।

প্রীতম অংশীর দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বলে, ‘আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে এসেছি। কথাগুলো তোমাকে রাখতে হবে অংশী।’
– ‘কন।’
– ‘তুমি বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে চাইছো না তাই তো?’
– ‘না। আমার জীবন থাকতে এইটা আমি হইতে দিমু না।’
– ‘তাহলে তোমাকে আরো কঠিন হতে হবে। পারবে?’

অংশী অবাক চোখে তাকায়। কঠিন মানে!

প্রীতম বললো, ‘তোমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। এই অন্যায় হতে দেয়া যাবে না। মাহিবের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিৎ। ওর নামে ধর্ষণের মামলা করো। ওকে জেলের ঘানি টানতে হবে। ওর এতদিনের জমানো খ্যাতি, গৌরব, ক্যারিয়ার সব ধূলায় মিশিয়ে দাও।’

অংশী করুণ মুখে প্রীতমের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাহিবকে এত বড় শাস্তি কি অংশী দিতে পারবে? ভালোবাসার বিনিময়ে জেল। এটা কখনোই পারবে না অংশী। মাহিব তো ধর্ষণ করেনি, অংশীরও তাতে আগ্রহ ছিলো। মাহিবের নামে অযথা কেন দোষারোপ করবে অংশী? এসব ভেবে অংশী তৎক্ষনাৎ বললো, ‘আমি পারবো না।’

প্রীতম বললো, ‘তোমাকে পারতে হবে। এই কাজটা না করলে মাহিব আরো হাজারো মেয়ের সাথে এমন করবে। বুঝতে চেষ্টা করো অংশী।’
– ‘যারে ভালোবাসা যায়, তারে শাস্তি দেওন যায় না প্রীতম ভাই।’

কথাটা প্রীতমের মনে গিয়ে এমনভাবে লাগলো যে অংশীর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো প্রীতমের। ভালোবাসার মানুষটাকে শাস্তি দেয়ার কথা মুখে আনতে চায় না এই মেয়ে। এমন একটা মেয়ের সাথে মাহিব কি করে প্রতারণা করতে পারলো। ধিক্কার মাহিবের প্রতি।

অংশী ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে, ‘এই শহরে আমার তো মাথা গোঁজার ঠাঁই ও নাই। ক্যামনে মামলা করুম। যা জানিনা, যা বুঝিনা তা আমি করতে পারুম না। সবচাইতে বড় কথা, আমি মাহিব সাহেবরে এত বড় আঘাত করতে পারুম না।’
– ‘মহৎ হয়ে যাচ্ছো অংশী। প্রতারকের সাথে এমন করতে হয়।’
– ‘বিচার আল্লাহ করবো। আমি বিচার করার কেউ না।’

প্রীতম যতই অংশীকে বোঝানোর চেষ্টা করলো না কেন অংশী কিছুতেই মাহিবকে আঘাত করতে পারবে না। শেষে বাধ্য হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রাগ সংবরণ করে নিলো প্রীতম। অনেক ভেবে বললো, ‘তুমি মাহিবের বাসায় গিয়ে উঠবে, ওর বাবার কাছে এর সঠিক বিচার চাইবে। তোমার গর্ভে মাহিবের সন্তান। মাহিবের বাবা বাধ্য তোমাকে মেনে নিতে। এটা অন্তত করো।’

অংশী নির্বাক ভঙ্গিতে প্রীতমের দিকে তাকিয়ে থাকে। যে শহরের মানুষ রাতের অন্ধকারে পশু হয়ে ওঠে, পতিতার বুকে সুখ খুঁজতে যায়, সে শহরে আবার ভালোবাসার বিচার হয় নাকি। অংশী নিজের সন্তানকে বুকে আগলে বেঁচে থাকবে, তবুও ওই নরপশুর কাছে আর আর তৃতীয়বারের মত যাবে না। মনেমনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলো অংশী।

প্রীতম অনেক চেষ্টা করেও অংশীকে বোঝাতে সক্ষম হলো না। শেষে বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলো নিজেই যাবে জ্যাঠামশাইয়ের কাছে অর্থাৎ মাহিবের বাবার কাছে। জ্যাঠাকে অনুনয় করে বুঝিয়ে বলতে হবে মাহিবের অনাগত সন্তানকে মেনে নিতে। শেষ চেষ্টা টুকু প্রীতমকে করতেই হবে।

সেই রাতেই প্রীতম মাহিবের বাবার দ্বারে এলো। একাকী ডেকে নিয়ে জ্যাঠাকে বুঝিয়ে বললো মেয়েটার অসহায় পরিণতির কথা। এরকম নিষ্পাপ একটি মেয়েকে রাস্তায় ধুকে ধুকে মরতে দেয়া যায় না। কিন্তু ফলাফল শূন্য। মাহিবের বাবা রেগে গেলেন। মেনে নেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। উল্টো প্রীতমের সহানুভূতিতে তার মনে ক্রোধের সৃষ্টি হলো।

বললেন, ‘তুমি নির্বোধ প্রীতম। ও মেয়েকে আশ্রয় দিয়ে ভুল করেছো। এখুনি বিদায় করে দাও। ওদের ধান্ধাবাজি তোমরা বুঝবে না।’
– ‘ধান্ধাবাজি কেউ করে থাকবে মাহিব ভাইয়া করেছে। আমি নিজে তার প্রমাণ। আপনি কেন ছেলের দোষকে ঢাকতে চাইছেন?’
– ‘বাবার কাজ ছেলের দোষ ঢাকা। কোথাকার কোন আদিবাসী পাহাড়ি জংলী মেয়ে। মাহিবের নখের যোগ্যও সে নয়। মাহিবের সাথে শুতে পেরেছে এটাই তার সৌভাগ্য। ইটস এনাফ।’

জ্যাঠার নিষ্ঠুর উত্তর শুনে প্রীতমের বুকটা বিষাদে ভরে গেলো। অংশী তাহলে ঠিকই বুঝেছে। এ বাড়িতে সন্তানের দাবি নিয়ে এলে জ্যাঠা কোনোদিনও মেনে নেবেন না। ভাগ্যিস অংশী যেচে অপমানিত হতে চায় নি।

প্রীতম জ্যাঠাকে হুমকি দিয়ে বললো, ‘তবে ব্যবস্থা আমি নেবো। আমি অংশীর হয়ে মামলা করবো। তারপর আপনার ছেলের ক্যারিয়ার কিভাবে ধ্বসে পড়ে নিজেই দেখতে পারবেন।’

জ্যাঠা প্রীতমের ক্রোধ দেখে হাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘পাগল তুমি। এরকম কত মামলা জীবনে খেলে এসেছি। কিচ্ছু করতে পারবে না, জাস্ট কিচ্ছু না। তবুও দৌড়াও, যদি কিছু করতে পারো। তবে লাভ নেই প্রীতম। যদি বেশি দয়া হয় তো নিজে ওই মেয়েকে বিয়ে করে নাও না। যত্তসব আসছে দয়া দেখাইতে।’

প্রীতম চোখ বন্ধ করে কথাগুলো নিরবে শুনে গেলো। অংশীকে ভালোবাসার সুযোগ নেই, সে সুযোগের পথ বন্ধ। এ কখনো সম্ভব নয়। জ্যাঠার সাথে লড়াইয়ে জেতার মত শক্তি এখনো ওর হয়নি। লজ্জায়, অপমানে, ঘৃণায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো প্রীতম। রাস্তায় চলতে চলতে নিজের চোখই ভিজে উঠতে লাগলো। কেবলই মনে হচ্ছে, মেয়েটার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। শেষ চেষ্টাটাও ব্যর্থ হলো। মামলা করে কোনো লাভ হবে না। মাহিবের বাবা অনেক বড় শিল্পপতি। তার কাছে এসব মামলা নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। অংশী তাদের মত ক্ষমতাধর ব্যক্তির সাথে পেরে উঠবে না। কি করণীয় এখন?

অনেক ভাবনার পর কোনো সঠিক সমাধান পেলো না প্রীতম। অংশীকে কি তবে নিজের আশ্রয়ে রেখে দেবে? তাতে কি রাজি হবে অংশী?

প্রীতম নিজের মনকে স্থির করলো। অংশীকে বিয়ে করবে সে। এতে ভালো মন্দ যাই ঘটুক অন্তত একটা নিরাপদ আশ্রয় হবে অংশীর। আর কষ্ট পেতে দেবে না অংশীকে, একটুও নয়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here