তৃষ্ণা
পর্ব ২১
মিশু মনি
.
২১
অংশী বিয়ের কথা শুনে বিস্ময়ে কথা বলতে পারলো না। এতটা কঠিন মুহুর্তে একজন পাশে এসে দাঁড়াতে চাইবে এও যেন স্বপ্নের মত। অংশী অপলক ভঙ্গিতে প্রীতমের চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইলো।
প্রীতম ভয়ে ভয়ে অংশীর হাত ধরে বললো, ‘আমাকে বিশ্বাস করতে পারো অংশী। চারিদিক থেকে সব দরজা তোমার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় নিজেকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? যদিও এটা সত্যি যে, প্রিয়জন অন্যের হয়ে গেলে তাকে ভালোবাসতে দ্বিধা হয়। আমি সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে কেবল তোমাকেই গ্রহণ করলাম অংশী।’
অংশী কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। প্রীতম আবারও বললো, ‘আমি তোমাকে একটি নিরাপদ আশ্রয় দিতে চাই। তোমার সন্তানের দায়িত্ব নিতে চাই অংশী। তুমি কি সে অধিকার আমায় দেবে?’
অংশী ঝট করেই কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কি করবে কিছুতেই বুঝতে পারছে না ও। এই মুহুর্তে প্রীতমকে বিয়ে করে নেয়াটাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই করা উচিৎ?
অংশীকে ভাবার অবকাশ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে প্রীতম। হতবাক অংশী ভাবতে থাকে এই প্রস্তাব কতখানি যৌক্তিক? এই মুহুর্তে অংশীর আশ্রয় নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, খাবার নেই, কর্ম নেই। সবচেয়ে বড় যা, অংশীর সন্তানের কোনো পরিচয় নেই। একজন ব্যক্তি ভালোবেসে অংশীকে পরিচয় দিতে চাইছে এও তো সুখের কথা। কিন্তু অংশী মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। নিজের ভালোর জন্য আরেকজন ব্যক্তিকে ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলাটা মোটেই উচিৎ হবে না। মনের যে অংশে ভালোবাসা নামক প্রিয়জনের স্থান, সে জায়গাটা কেবল মাহিবই দখল করে নিয়েছে। সে অংশ প্রীতমের নামে লিখে দিতে পারবে না অংশী। প্রীতমকে স্বামী হিসেবে মেনে নেয়া যে সম্ভব নয় অংশীর পক্ষে। প্রীতম নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে, মাহিবের চেয়েও অনেক ভালো রাখবে অংশীকে। তবুও অংশী মন থেকে কোনো উত্তর পাচ্ছে না। মনের কথা না শুনে দ্বিতীয়বার ভুল করতে পারবে না অংশী।
সারারাত ভাবনাতেই কেটে গেলো। অংশী কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে নি। ছটফটানি, বিরহ আর বেদনায় রাতের একেকটা মুহুর্ত দীর্ঘ হয়ে ধরা দিচ্ছিলো। এ জীবনে যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নেই, সেথায় ভালোবাসার স্থান কি করে হবে?
পরেরদিন যখন প্রীতম উত্তরের আশায় অংশীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বিয়ে করবে আমায়?’
অংশী খানিকটা সময় চুপ থেকে স্পষ্ট করে জবাব দিলো, ‘না।’
অংশীর কাছে এমন উত্তর আশা করে নি প্রীতম। প্রীতম ধরেই নিয়েছিলো অংশীকে সে পেয়ে গেছে। এই নির্মম পরিস্থিতিতে প্রীতমকে ভালো না বেসে অংশী যাবেই বা কোথায়। যতটা কঠিন জীবনের মুখোমুখি সে হয়েছে, এর থেকে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই, উত্তরণের কোনো পথও নেই। অংশী নিশ্চয় বিয়েতে রাজি হবে। কিন্তু প্রীতমকে অবাক করে দিয়ে অংশী বললো, ‘আমি আপনেরে বিয়া করতে পারুম না।’
নির্বাক প্রীতম নিজের কোনো ত্রুটি খুঁজে পেলো না। অংশী নিজে থেকেই বললো, ‘আমি যারে একবার দেহমন সব দিয়া দিছি, তারে ভুইলা আরেকজনরে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব হইবো না। আমি যে ওনারেই ধ্যান জ্ঞান সব ভাইবা নিছি। মনের দখল একবারই হয় প্রীতম ভাই, দুইবার হয় না।’
প্রীতম অংশীর উত্তরে আশ্চর্য হয়ে গেলো। বলার মত কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না। মাহিবের প্রতি এখনো অংশীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ সবই অবাক করছে প্রীতমকে। এই মুহুর্তে প্রীতমের রেগে যাওয়া উচিৎ নাকি চুপ করে থাকা উচিৎ বুঝতে পারছে না প্রীতম।
অংশী বললো, ‘আমার পেটে আরেকজনের সন্তান। এই পাপের ভাগ আমি আপনেরে ক্যান দিমু? আপনে মহান। আমি এই কলঙ্কের বোঝা আপনের ঘাড়ে দিবার পারুম না। আমার দুর্ভাগ্য, আমার কলঙ্ক আমারই থাউক। আপনে আর এই কথা মুখে আইনেন না।’
অংশী এতটা মহৎ চিন্তা করতে পারে তা কল্পনার অতীত ছিলো প্রীতমের। কতটা মহানুভব হলে একজন মেয়ে এভাবে ভাবতে পারে! কতটা উঁচু মনের হলে ফিরিয়ে দিতে পারে প্রীতমের ভালোবাসা?
তবুও আমতা আমতা করে প্রীতম বললো, ‘আমি তোমাকে যথাযথ সম্মানে রাখবো অংশী। কে কি বললো তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।’
অংশী করুণ চোখে চেয়ে বললো, ‘আমি যে আপনারে মন থিকা গ্রহণ করবার পারতাছি না প্রীতম ভাই। আমারে মাফ করেন।’
প্রীতম চুপ করে রইলো।
অংশী বললো, ‘মাহিব সাহেব আমারে যে বেদনা দিছে, তা নিয়া আমি বাঁইচা থাকুম। আমার আর ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য জানি না হয়।’
– ‘তোমার সন্তানের পরিচয় কি হবে অংশী?’
অংশী বললো, ‘আমি সারারাত ভাইবা দেখছি। আমার মন কইতাছে আপনে আমার লগে সুখী হইবার পারবেন না। আর বাচ্চা নিয়া চিন্তা নাই। আমার সন্তানের পরিচয় আমি। আমিই ওরে আমার পরিচয়ে বড় করমু। ওর কোনো বাপ লাগবো না।’
এরচেয়ে বড় কোনো জবাব হয়তো হয় না। প্রীতম আর জোর করতে চাইলো না। প্রীতমের নিজেরও ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিলো মাহিবকে শাস্তি দিয়ে নয়, যোগ্যতা দিয়ে ছাড়িয়ে যেতে হবে। অংশীকে শক্তিশালী হয়ে জেগে উঠতে হবে। অংশীর দৃঢ়তা দেখে মনে হয় সেই শক্তি অংশীর আছে। শুধুমাত্র একটি দিক নির্দেশনা দরকার। বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটাও নিঃসন্দেহে উত্তম।
খানিকটা সময় নিশ্চুপ থেকে প্রীতম উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, ‘স্যালুট জানাই হে নারী, তোমায় হাজারো সালাম। তুমি এত মহান করে ভাবতে পেরেছো যা আমাকে মুগ্ধ করেছে।’
অংশী বললো, ‘জীবন বড় কঠিন গো প্রীতম ভাই। আমি এই কঠিনরেই গ্রহণ করলাম। আপনে শুধু আমারে একটু মাথা গোঁজার মত একটা আশ্রয় দেন। আমি আজীবন আপনের সেবা কইরা যামু।’
প্রীতম অংশীর হাত ধরে বলে, ‘তোমার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাই। তুমি আপন শক্তিতে জেগে ওঠো। আমি তোমার পাশে আছি, একজন বন্ধুর মত। ছায়ার মত। সবসময় আমাকে পাশে পাবে হে বন্ধু।’
এক রাশ হতাশা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে প্রীতম। সারারাত স্বপ্নে বিভোর ছিলো অংশীকে নিয়ে। ভেবেছিলো অংশীকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখাবে, নতুন একটা পৃথিবী সাজিয়ে দেবে। মা মেনে না নিলে অংশীকে নিয়ে আলাদা বাসায় গিয়ে উঠবে। কিন্তু তা আর হলো না। সিদ্ধান্তটা সঠিক হলেও মনটা নিমেষেই বিষন্ন হয়ে গেছে প্রীতমের।
প্রীতমের মায়ের আচরণ সন্তোষজনক নয়। উনি আপদ বিদায় করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। প্রীতম মাকে বুঝাতে গেলেই মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে অংশী প্রীতমকে জোর করলো যাতে ওকে আবারও বস্তিতে রেখে আসে। প্রীতম কিছুতেই রাজি হলো না। কিন্তু অংশীও নাছোরবান্দা। এ বাড়িতে থাকলে প্রীতমের সমস্যা হবে, বাকিদের সমস্যা হবে। তারচেয়ে বরং ওই বস্তিতে গিয়ে একা পড়ে থাকাও অনেক ভালো।
অনেক জোর করে প্রীতমকে নিয়ে ও বস্তিতে চলে আসে। অনেকটা বাধ্য হয়েই এই নোংরা বস্তিতে অংশীকে রেখে যেতে হলো। যাওয়ার সময় প্রীতম অংশীকে কথা দিয়ে গেলো খুব দ্রুত একটা ভালো থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে অংশীকে নিয়ে যাবে সেখানে।
২২
ঘরের বাইরে বিষন্ন মনে বসে এই নতুন জায়গা দেখছিলো অংশী। কয়েকটা ছেলে খালি গায়ে মার্বেল খেলছে। অংশীর বয়সী একটা মেয়ের কোলে কয়েক মাসের বাচ্চা। বাচ্চাটা ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। মেয়েটা কিছুতেই বাচ্চার কান্না থামাতে না পেরে উল্টো দুটো মার বসিয়ে দিলো। মার খেয়ে আরো জোরে কেঁদে উঠলো বাচ্চাটা। অংশীর খুব মায়া হলো। ইচ্ছে করলো নিজে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করে দেয়। পরক্ষণেই নিজের বাচ্চার কথা ভেবে কষ্ট হতে লাগলো অংশীর। একটা বাচ্চাকে কিভাবে সামলাতে হয় জানে না অংশী। জন্ম দিতেও অনেক কষ্ট, বড় করতেও অনেক যন্ত্রণা। এতকিছু কি করে সইবে ও! সেসব ভেবে অস্থির হয়ে উঠলো। কিন্তু আনন্দের কথা এই যে, অংশীর এখন নিজেকে একা মনে হয় না। বরং মনেহচ্ছে একজন আছে ওর সাথে। পৃথিবীর সবাই নিষ্ঠুর। নিষ্ঠুর এই দুনিয়ায় কেউ নেই অংশীর। একমাত্র পেটের এই সন্তানই ওর আপনজন।
অংশী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই সন্তানকে এত আপন মনে হয় কেন কে জানে। এরই মধ্যে এক মহিলা এসে ভাব জমানোর চেষ্টা করলো ওর সাথে। নাম, পরিচয়, দেশের বাড়ি সব জিজ্ঞেস করে কোনো আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে হতাশ হয়ে কর্মক্ষেত্রের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো। মেয়েটার নাম লিমা। সে এই বস্তিতেই পাশের এক ঘরে থাকে। নিজে থেকেই পরিচিত হতে চাইলো। অংশী লিমার আন্তরিকতা দেখে ওর সাথে দু একটা আলাপন শুরু করলো। দুজনাতে বেশ ভাব হয়ে গেলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
সকালের খাবার খেয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে জীবনকে নিয়ে ভেবে সময় কেটে গেলো অংশীর। মাহিবকে ভেবে কখনো ডুকরে কাঁদে, কখনো মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁদে, আবার কখনো মেঝেতে শুয়ে গলাকাটা পশুর মত ছটফট করে। কি নিদারুণ কষ্ট। শরীরের ব্যথা এতটুকুও কমছে না, এই পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতেও পারছে না অংশী। শোকে, দুঃখে, যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো।
রাতে শরীরে নামলো ভীষণ জ্বর। জ্বরের ঘোরে ম্যালেরিয়া কালীন মাহিবের সেবাযত্নের কথা স্মরণ করে অংশীর কষ্টে বুক ফাটছিলো। কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে গেলো, কখনো চোখে ঘুম নেমে আসে, আবার কখনো কেঁদেকেটে রাত পার হলো অংশীর।
চলবে..