তৃষ্ণা পর্ব ২৩’24

0
1218

তৃষ্ণা
পর্ব ২৩ ও ২৪
মিশু মনি

এখানে অংশীর জীবনকে আরো নতুনভাবে আবিষ্কার করার পালা। নতুন নতুন অজস্র নিয়ম। রুমে ওঠামাত্রই রুমমেট রা অনেক নিয়ম কানুন বলে দিয়েছে। কতকটা অংশীর মনে আছে, কতকটা ভুলে গেছে। কিছু কিছু নিয়ম বুঝতেই পারে নি ও। মেয়েগুলো যেমন কর্কশ তেমনি নিষ্ঠুর। প্রথম দেখেই এইটুকু বুঝতে অসুবিধা হলো না অংশীর।

মুখ ধুতে গিয়ে বাঁধলো আরেক ঝামেলা। বেসিনে হাত মুখ ধুতে হয়, বাইরে জলের বিন্দু যেন না আসে। অংশী বেচারি জানতো না। প্রথমবার মুখ ধুতে গিয়ে বেসিনের চারিদিকে অনেকখানি জায়গা জলে ভিজিয়ে ফেললো। রুমমেটরা দেখেই চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে সময় লাগলো অংশীর। ও শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে।

খালাকে টাকা দিয়ে আসতে হয় খাবারের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে খাবার নিয়ে আসতে হয়। বাকি দুই রুমমেটের দেখাদেখি খাবার নিয়ে আসে অংশী। ভাগ্যিস শহুরে মেয়েরা কারো দিকে তাকায় না। নয়তো ওর দিকে সবাই হা করে তাকিয়ে থাকলে লজ্জায় মুখ তুলতে পারতো না অংশী।

রুমমেট দুজন অংশীকে দেখলে কেমন একটা ভাব করে। ওদের দুজনের মধ্যে বেশ ভাব কিন্তু ওরা অংশীকে পাত্তা দিতে চায় না। নিরীহ অংশী একলা বিছানার উপর বসে থাকে আর মাঝেমাঝে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। মনেমনে ভাবে এ অবস্থায় বাড়িতে ফিরে গেলে কি হবে? বাবা মা কি মাহিবের মত একেবারেই পথে ফেলে দেবে? বাবার কথা জানে না, কিন্তু মা কিছুতেই মেনে নেবে না এ জানে অংশী। বাবা সত্যিটা নিশ্চয় জেনে গেছে এতক্ষণে। হয়তো কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। তারচেয়ে বড় কথা এলাকায় বাবার একটা সম্মান আছে। অংশী বাড়ি থেকে চলে আসায় সেই সম্মান খানিকটা নষ্ট হয়ে গেছে নিশ্চয়। এখন বাবার মুখোমুখি হতেও পারবে না অংশী। তাছাড়া এ অবস্থায় এলাকায় ফিরে গেলে সবাই বাবা মাকে ছিঃ ছিঃ করবে। ভুলেও বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা মাথায় আনা যাবে না।

রাত নেমে এলে বুকের পাথর আরো ক্রমশ ভারী হতে থাকে। মাহিবের সাথে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো চোখে ভেসে ওঠে। মাহিবকে এক পলক না দেখে কিভাবে থাকবে অংশী? পরিস্থিতি এতটাই কঠিন হয়েছে যে মাহিবকে এক পলক দেখার কোনো সুযোগ এখন নেই। কিভাবে পারবে অংশী?

চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। কষ্টেরা পুরো শরীর অবশ করে দিচ্ছে। দূর্বল শরীর আর বুক ভরা কষ্ট নিয়ে বিছানায় ছটফট করতে লাগলো অংশী। কাঁদতে কাঁদতে অবশেষে ভোরের দিকে চোখে ঘুম নেমে এলো।

অংশী কখনো টুথ পেস্ট দিয়ে ব্রাশ করে নি। প্রীতম ওকে ব্রাশ কিনে দিয়েছে। সবার দেখাদেখি সকালবেলা অংশীও ব্রাশ করার জন্য বেসিনে এলো। রুমের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকলে মেয়েরা রেগে যাবে এটাই স্বাভাবিক। পাশের রুমের মেয়েরাও অংশীকে দেখলে বাঁকা চোখে তাকায়। ব্রাশ করার সময় অন্যের পেস্ট ব্যবহার করায় একগাদা কথা শুনিয়েছে অংশীকে। বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো অংশী।

কিভাবে কি করতে হয়, কিভাবে চলাফেরা করতে হয়, কিভাবে ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয়, কিচ্ছু জানে না অংশী। তিনদিনেই হোস্টেল জীবন অসহ্য হয়ে উঠলো। সবাই অংশীকে নিয়ে হাসাহাসি করে। গোসলের জন্য টানা দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ফিরে আসে অংশী। সবাই ওকে ঠেলে ফেলে গোসল করতে যায়। খাবারের সময়ও অংশীকে পিছনে ফেলে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে চলে যায়। সবার শেষে গিয়ে খালারও বকা শোনে অংশী।

রাতে ঘুমাতে গেলে ঘুম আসে না। মাঝরাতে ডুকরে কান্না আসে। কিন্তু কাঁদতেও পারে না রুমমেট দের কারণে। অন্যের সামনে কাঁদতে লজ্জা লাগে অংশীর। শুধু চোখের নোনা জলে বালিশ সিক্ত হয়ে ওঠে। এ যে কি দুঃসহ কষ্ট!

খাবার খাওয়ার সময় কয়েকবার বমি করতে দেখে রুমমেটরা অন্য মেয়েদেরকে জানায়। পুরো হোস্টেলে জানাজানি হয়ে যায় অংশীর ব্যাপারে। সবার চোখ ভরা কৌতুহল। কেউ কেউ আবার পেঁচিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। কারো সাথে কথাও বলতে পারে না অংশী। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। একটা জীবন এমনও ভয়াবহ হতে পারে, তা ভেবে আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। যেখানে কেউ নেই, আপনজন নেই, বাবা মা নেই, পরিচিত একটা জনপ্রাণী নেই। সেখানে কিসের জন্য থাকা? কিন্তু আজ কোথাও ফিরে যাওয়ার পথ নেই অংশীর। এভাবেই চলতে হবে বাকিটা জীবন।

রান্নাঘরের বেসিনে ময়লা ফেলার অপরাধে অংশীকে ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে থেকে বড় আপুদের বয়ান শুনতে হলো। মনমরা হয়ে রুমে ফিরে আসতেই রুমমেটরা শব্দ করে হাসা শুরু করলো।

একজন বললো, ‘এই মেয়ে, তুমি কোনো নিয়ম কানুন জানোনা তাহলে হোস্টেলে থাকো কেন? কোথায় পড়াশোনা করো?’

অংশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। কি জবাব দেবে? ও তো কোথাও পড়াশোনাই করে না।

মেয়েটা বললো, ‘এভাবে বারবার অনিয়ম করলে হোস্টেল সুপার তোমাকে এখানে বেশিদিন থাকতে দেবে না বুঝেছো? সময় থাকতেই সবকিছু শিখে নাও। আর বললে না তো কোথায় পড়ো?’

অংশী এবারও কোনো জবাব দিতে পারলো না। মেয়েটা কাছে এসে কর্কশ কণ্ঠে বললো, ‘তুমি তো চরম বেয়াদব। কথা না বলে চুপ করে আছো কেন? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আনসার দিতে হয়।’

অংশীর আবারও বমি বমি ভাব হচ্ছে। ও দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো বমি করতে। সবকটা ওয়াশরুম বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে বারান্দায় বমি করে দিয়েছে। এর জন্য আজ কপালে কি আছে কে জানে!

বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতেই চোখে ঘুম নেমে এলো। ঘুমের মাঝে কিসব দেখে ঘুমটাও ঠিকমতো হলো না। তারই মাঝে রুমমেট এসে চিৎকার চেঁচামেচি করে ডেকে তুললো অংশীকে। রাগে গজগজ করতে করতে বললো, ‘মেয়ে তোমার বমি আরেকজন পরিষ্কার করে দেবে নাকি? সবাই বলছে তুমি নাকি প্রেগন্যান্ট। তো হোস্টেলে উঠেছো কেন?’

অংশী মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় পানি ঢেলে পরিষ্কার করে দেয়। মনে একটুও সুখ নেই। কষ্টে বুক ছিঁড়ে যায় অংশীর। বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত শহরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে জীবনটা এমন কেন হলো! একটা ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে পুরো জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেলো। এভাবে আরো কতদিন? হোস্টেলের মেয়েরা তো একেবারেই টিকতে দিচ্ছে না এখানে।

অংশী অশ্রুপাত করছিলো আর ভাবছিলো এসব। একটা মেয়ে এসে জানায় ওর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। তখনই প্রীতমের কথা মনে পড়ে যায়। নিশ্চয় প্রীতম এসেছে। এই শহরে প্রীতম ছাড়া আর কেউ নেই অংশীর। এত কষ্টের ভিড়েও কিছুটা আশায় বুক বাঁধে অংশী।

প্রীতমকে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারে না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। জীবনটা এখানে কেমন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তার বর্ণনা শুনে প্রীতম শিউরে ওঠে। অংশী অনুনয় করে বলে, ‘আমারে বিষ আইনা দেন না, খাইয়া মইরা যাই।’

প্রীতম বললো, ‘এমন কথা ভুলেও বলবে না। জিনিসপত্র কিছুই নিতে হবে না, চলো আমার সাথে। এখানে আর এক মুহুর্তও থাকা চলবে না তোমার।’

২৫

প্রীতম অংশীর হাত ধরে বেরিয়ে আসে হোস্টেল থেকে। রাস্তা পেরোবার সময় অংশীর হাত চেপে ধরে। অবাক হয়ে সে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে অংশী। কেমন যেন লাগে, অবাক হয়ে ভাবতে হয়। যে জীবনে সবাই ছেড়ে গেলো, সে জীবনে এ কোন আশার প্রদীপ জ্বেলে প্রীতম এলো।

একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসে দুজনে। খাবার অর্ডার করে প্রীতম অংশীর দিকে তাকায়। চোখমুখ শক্ত করে বলে, ‘তোমাকে এত ভেঙে পড়লে চলবে না। যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছো আমাকে গ্রহণ করবে না, তখন একা বাঁচতে শিখতে হবে। এমন নরম শাখাপ্রশাখা নিয়ে তা সম্ভব না। তেজী হয়ে জ্বলে উঠতে হবে তোমায়। বুঝেছো?’

অংশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। প্রীতম বললো, ‘এভাবে হা করে চেয়ে থাকলে চলবে না। কথায় কথায় এত কাঁদলে হবে না। কান্নাকে চিরতরে বিদায় জানাও। একা বাঁচতে গেলে হাজারো মানুষের হাজারো কটুক্তি শুনতে হবে। সন্তান নিয়েও শুনতে হবে শত অপবাদ। সব সহ্য করে যেতে হবে।’

অংশীর প্রীতমের কথায় ভয় পেয়ে বললো, ‘ক্যামনে বাঁচুম আমি? আমার মরণ হয়না ক্যান?’

প্রীতম রাগত স্বরে বললো, ‘ভুল করেছো তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না? এমন পাগলের প্রলাপ বকো না। এই শহর নিষ্ঠুর নির্মম শহর। কেউ তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে না। তোমার জীবন তোমাকেই বহন করতে হবে। আমি জানি তুমি সেটা পারবে। তোমাকে পারতে হবে।’

প্রীতমের কথায় আশার আলো দেখতে পায় অংশী। চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর। অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘কি করমু আমি?’

প্রীতম উত্তরে বললো, ‘তোমাকে পথ আমি বলে দেবো। তুমি শুধু সেই পথে হাঁটবে। অনেক ঝড় ঝাঁপটা আসবে জীবনে। সব সহ্য করেই সে পথে হাঁটতে হবে। প্রতি পদে পদে কাঁটায় পা পড়বে। পা দিয়ে রক্ত ঝরবে। তবুও থেমে যাওয়া যাবে না।’

অংশী একটা নতুন জীবনের গন্ধ পাচ্ছে। মনে একটা প্রশান্তির ছায়া নেমে এলো। হ্যাঁ, অংশীকে শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। অংশীকে পারতে হবে, পারতেই হবে।

প্রীতম বললো, ‘বাস্তবতা বড় কঠিন। কিন্তু মানুষ বাস্তবতার চেয়েও কঠিন। বাস্তবতা নামক শব্দটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই মানুষ হিসেবে তোমার জন্ম সার্থক। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। যেখানে প্রকৃতি মানুষকে সেরা জীব হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সেখানে মানুষকে ঠেকাতে পারে কে? মানুষ ই সবকিছুকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবে। সেই শক্তি মানুষের মাঝে আছে। শুধু দরকার আত্মবিশ্বাস, মনোবল, শক্তি। নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।’

অংশী হা হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রীতমের দিকে। সরলতার সাথে বললো, ‘আত্মবিশ্বাস কি?’

প্রীতম মুচকি হেসে বললো, ‘আত্মবিশ্বাস হচ্ছে নিজের প্রতি বিশ্বাস। অর্থাৎ, আমি পারবো। আমি জিতবো, এরকম একটা মনোভাব। একটা কাজ করে ভাব্বে আমি এটাতে জয়ী হবো, এটাই আত্মবিশ্বাস।’

– ‘আমি কি পারমু?’

– ‘এটা বললে তো হবে না। এটা বললে বুঝতে হবে আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি আছে। তোমাকে পারতেই হবে। বলো, আমি পারবোই। আমি পাশে আছি তো তাই না?’

অংশী প্রীতমের কথায় সাহস পেলো। চোখ ভিজে আসতে শুরু করেছে। ও প্রীতমের হাত ধরে বললো, ‘আমারে বাঁচতে হইবো। আমার সোনামণিটা দুনিয়ায় আইসা ভালো থাকবো। বাপ নাই তো কি হইছে, ওরে আমি বড় করমু।।’

প্রীতম অংশীর কথায় সন্তুষ্ট হয়ে প্রসন্ন হাসি দিলো। খাবার এসে গেলে অংশীকে পরিচয় করিয়ে দিলো চাইনিজ খাবারটার সাথে। কিভাবে খেতে হয় তাও দেখিয়ে দিলো।

রেস্টুরেন্টে থেকে বেরিয়ে অংশীকে নিয়ে ফুটপাত ধরে হেঁটে চললো প্রীতম। কোন জিনিসটির নাম কি সেটা শিখিয়ে দিলো। অংশীর আজ মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেছে। ও যেটাই দেখছে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছে, ‘এটা কি?’

শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করিয়ে দিলো প্রীতম। জামাকাপড় গুলো অংশী হাতে নিয়ে বললো, ‘আপনের মেলা পয়সা খরচ হইতাছে আমার জন্যি।’

– ‘পরে শোধ দিয়ে দেবে।’

– ‘আইচ্ছা। আমারে একটা কাম জোগাড় কইরা দিবেন না?’

– ‘ওহ, ভালো কথা বলেছো। অবশ্যই দেবো। তবে এই ব্যাকগ্রাউন্ডে তুমি ভালো জব পাবা না। তোমাকে হতে হবে উদ্যোক্তা।’

– ‘উদ্যোক্তা কি?’

প্রীতম হেসে বললো, ‘কোনোকিছুর উদ্যোগ করে যে তাকে বলে উদ্যোক্তা। এইযে বড় বড় কোম্পানিগুলোর মালিককে দেখছো, ওনারা সবাই উদ্যোক্তা। কারো কোম্পানিতে চাকরি করা নয়, তারা নিজেরাই অন্যদের চাকরি দিয়ে থাকে।’

– ‘উদোগ কি?’

– ‘উদোগ নয় পাগলী, উদ্যোগ। একটা পদক্ষেপ।’

– ‘পদক্ষেপ কি?’

হেসে উঠলো প্রীতম। অংশীকে পদক্ষেপ বিষয়টা বোঝাতেই ওর অনেক সময় লেগে গেলো। নতুন নতুন বিষয় জেনে মজা পাচ্ছে অংশী। মনে জমে থাকা চাপা কষ্টের মেঘগুলো কিছুটা সময়ের জন্য সরে গিয়ে সূর্যের আলো ফুটে উঠেছে। প্রীতম একটা কোণ আইসক্রিম নিয়ে অংশীকে শিখিয়ে দিলো কিভাবে খেতে হয়। বেচারা অংশী আইসক্রিম খেতে গিয়ে পুরো মুখে লেপ্টে ফেললো। তাই দেখে হাসি এলো প্রীতমের।

প্রীতমের মা আবারও অংশীকে দেখে কিছুটা হতাশ হলেন। ছেলে আবার এই মেয়েকে কেন এনেছে! এটাই ভাবতে লাগলেন মনে মনে। কিন্তু অংশীর মুখে জমে থাকা মায়াগুলো ক্রমশ ওনার মনে একটা সহানুভূতির জন্ম দিচ্ছিলো বোধহয়। উনি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অংশীকে ভেতরে নিয়ে এলেন।

প্রথমবার এ বাড়িতে এসে অংশীর ভীষণ সংকোচ লাগছিলো। কিন্তু এবার এসে বড্ড পরিচিত ও আপন মনে হলো। প্রীতমের মাকেও আপনজন মনে হলো অংশীর। খাওয়াদাওয়া শেষ করে প্রীতম অংশীর ঘরে এলো। শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলো অংশী। প্রীতমকে দেখে উঠে বসলো। প্রীতম চেয়ার টেনে নিয়ে বসেই কথা বলতে শুরু করে দিলো, ‘তোমাকে একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিবো কাল। সেখানে অনেক ধরণের কাজ শেখায়। তুমি ঘুরে ঘুরে দেখবে কোন কাজটা তোমার ভালো লাগে। যেটা তোমার ইচ্ছা হবে, সেটাই শিখবে। কাজ শিখতে হয়তো তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগবে, এরপর নিজেই উদ্যোক্তা হতে পারবে। বুঝেছো?

অংশী মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘বুজছি।’

– ‘বুজছি নয়, বুঝেছি। বলো বুঝেছি?’

প্রীতমের এই বাক্যটায় অংশীর মাহিবের কথা মনে পড়ে গেলো। আনমনা হয়ে গেলো অংশী। কেমন যেন মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। প্রীতম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো, ‘কি হলো তোমার? মন খারাপ হয়েছে? এই হুটহাট মন খারাপ অভ্যাসটা বদলাতে হবে বুঝেছো?’

অংশী হেসে বললো, ‘বুঝেছি।’

অংশীর হাসিমুখ দেখে হেসে ফেললো প্রীতম নিজেও।

প্রীতম অংশীর সাথে বসে অনেক্ষণ আড্ডা দিলো। মুহুর্তের জন্য অংশী ভুলে গেলো নিজের কষ্টের কথা। মাহিবের ব্যথাটা ক্ষণিকের জন্য চাপা পড়ে গিয়েছিলো। প্রীতম বেরিয়ে যাওয়ার পরও মনটা বেশ কিছুক্ষণ ভালো ছিলো। কিন্তু রাত যত বাড়তে লাগলো, ততই কষ্ট এসে ঘিরে ধরলো। প্রত্যেকটা রাত এত দুঃসহ যন্ত্রণায় কেটে যাচ্ছে। অংশী কি করে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে কে জানে। সবকিছু ভালোর দিকে এগোলেও মাহিবকে হারানোর কষ্টটা কিছুতেই ভুলতে পারে না মেয়েটা। রাতগুলো হয়ে ওঠে সীমাহীন দুঃখময়।

২৬

পরদিন অংশীকে নিয়ে একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এলো প্রীতম। ঘুরেঘুরে সবকিছু দেখার পর ব্লক বাটিকের কাজটাই ভালো লেগে গেলো অংশীর। এই কাজে একটা চমকপ্রদ ও সৃজনশীল ব্যাপার আছে। এমব্রোডারি করা দেখেও ওর মন চাইছিলো এখুনি কাজটা শিখে ফেলতে। প্রীতম আশ্বাস দিয়ে বললো, ‘একসাথে দুটোই শিখবে। সকালে একটা, বিকেলে একটা।’

অংশী মাথা দুলিয়ে বললো, ‘আইচ্ছা।’

– ‘আইচ্ছা নয়, আচ্ছা।’

এবার অংশী অনায়াসেই বলে ফেললো, ‘আচ্ছা।’

এবার আর মাহিবের কথা মনে পড়ে মন খারাপ হলো না অংশীর। এই মন খারাপ না হওয়ায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো অংশী। ওর মনে একটা আনন্দের জোয়ার ভেসে এলো। উৎফুল্ল হয়ে বললো, ‘আমি আইজ থাইকাই শিখুম।’

প্রীতম অংশীর আগ্রহ দেখে ভয়ানক খুশি হলো। প্রধান প্রশিক্ষককে অংশীর ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে আজ থেকেই অংশীকে কাজ শেখার জন্য অনুরোধ করলো প্রীতম। মাসের মাঝামাঝি সময়ে কাউকে নিযুক্ত করার মত নিয়ম নেই। তবুও দুজনের আগ্রহ দেখে মেনে নিলেন প্রশিক্ষক সাহেব। প্রীতম অংশীকে রেখে বেরিয়ে এলো বাসা খুঁজতে। যেভাবেই হোক একটা বাসা খুঁজে বের করতেই হবে। এবার বন্ধুদের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরিচিত বন্ধুদের অনেক বাসা আছে। কারো বাসায় একটা রুম পেয়ে গেলেই হয়। অংশীকে বাসায় রাখলে মায়ের সাথে প্রীতমের একটা দ্বন্দ্ব লেগে যাবে নিশ্চিত। সমাজের মানুষের কথাকে উপেক্ষা করাও যায় না। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সকলেই বাসায় যাতায়াত করে। অংশীকে ভালো রাখতে হলে ওকে নিজস্ব একটা বাসায় রাখতে হবে।

খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না। এক বন্ধুর বাড়িতে একটা রুমের ব্যবস্থা হয়ে গেলো। বন্ধুও অনেক বিশ্বস্ত। অংশীকে নির্দ্বিধায় রাখা যেতে পারে। বন্ধু অয়নের মাকে অনুরোধ করে বুঝিয়ে বলতেই তিনি রাজি হলেন। খুশি মনে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলে গেলো প্রীতম।

অংশী কাজ শিখে ভীষণ আনন্দিত। ওর চোখেমুখে আনন্দের উজ্জ্বলতা ঝিকমিক করছে। নিজের অজান্তেই স্বপ্নরা আসতে শুরু করেছে অংশীর চোখে। নতুন কাজ শিখতে দারুণ আনন্দ। প্রীতমের মনেও আনন্দ। অংশীকে বড় হতে হবে না, অন্তত নিজের জীবনযাপনের খরচটা নিজে উপার্জন করার মত স্বাবলম্বী হলেই হবে। প্রত্যেকটা মেয়ের জন্য স্বনির্ভর হওয়াটা প্রয়োজন, ভীষণ প্রয়োজন।

পরেরদিন প্রশিক্ষণ শেষ করেই নতুন বাসায় উঠে গেলো অংশী। আজকে প্রীতম হাড়ি পাতিল, যাবতীয় থালাবাসন, বাজার সবই এনে দিলো। অংশীর একার একটা সংসার হতে চলেছে। মানুষ সবসময় সংসার সাজায় দুজন মিলে। কত ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে সে সংসার। অংশীও চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে একটা সংসারের আশায় এসেছিলো এ শহরে। আজ সংসার হলো ঠিকই, তবে কোনো সদস্য নেই। একার একটা সংসার। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অংশী।

প্রীতম ঘর গোছাতে সাহায্য করলো অংশীকে। সব কাজ শেষ হয়ে গেলে বললো, ‘আমি তাহলে আসি। আবার তিন চারদিন পর আসবো। কিভাবে কাজে যাবে আজকে তো শিখিয়ে দিয়েছি। প্রতিদিন সময়মত কাজে চলে যাবে, আবার ছুটি হলে ফিরে আসবে। বাসায় এসে প্রাকটিস করবে কি কি শিখেছো। মনে থাকবে?’

অংশী মাথা দুলিয়ে বললো, ‘হু।’

প্রীতম বললো, ‘হু নয়, হুম। আর যেকোনো প্রয়োজনে আন্টির ফোন থেকে আমাকে কল দেবে। দ্বিধা করবে না। এখানে তুমি সম্পূর্ণ সেইফ। কেউ কটুক্তি করবে না, কেউ বাজে ইঙ্গিত দেবে না। তোমাকে কষ্ট দেয়ার মত কেউ নেই এখানে। শুধু নিজে নিজে কষ্ট পেও না প্লিজ।’

অংশীর চোখের কোণা ভিজে এলো। প্রীতম বললো, ‘উহু। আর কাঁদবে না। আমারও কর্মক্ষেত্র আছে। চারদিন পরে এসে আবারও বাইরে নিয়ে যাবো। এই কটা দিন নিজের দিকে খেয়াল রেখো বন্ধু।’

অংশী হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বললো, ‘এই বন্ধুর জন্য আমি জীবন দিয়া দিবো। সারাজীবন আল্লাহর কাছে দোয়া করুম আল্লাহ যেন আপনারে অনেক ভালা রাখে।’

প্রীতম প্রসন্ন হেসে বললো, ‘ওকে বন্ধু। আজ তাহলে আসি। নিজের যত্ন নিও।’

প্রীতম চলে গেলে জানালা খুলে দিয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো অংশী। এটা একদম শহুরে বাড়িগুলোর মত বন্দিত্বদশার মত বাড়ি নয়। বাড়িটা কলোনীর ভিতরে। পরিবেশ ভীষণ গোছানো ও সুন্দর। চারিদিকে অনেক গাছাগাছালি, ঘাট বাঁধানো পুকুর। আসার সময় অংশী দেখেছে পুকুরের দুই ধারে কেউ বসে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ আবার বই পড়ছে। এখন থেকে সময় পেলে অংশীও সেখানে গিয়ে বসে থাকবে। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শান্তির নিশ্বাস ফেললো মেয়েটা। বহুদিন পর একটু শান্তি এসেছে মনে। আজকাল মাহিবকে ভেবেও ততবেশি কষ্ট লাগে না। অংশী জামা তুলে পেটের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। বললো, ‘ওরে আমার সোনা রে, তুমি কেমন আছো?’

অনেকটা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পেরে আরো আনন্দ হলো অংশীর। আজ থেকে একা বাঁচতে হবে। নিজেই নিজের যত্ন করা শিখতে হবে। সামান্যতেই হাল ছেড়ে দিয়ে ভেঙে পড়া যাবে না।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here