তৃষ্ণা পর্ব ২৫

0
1034

তৃষ্ণা
পর্ব ২৫
মিশু মনি

সন্ধ্যার পর পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলো অংশী। অনেকেই চারিদিকে দৌঁড়াচ্ছে। এটাকে বলে ব্যায়াম, প্রীতম ভাই বলেছিলো। ব্যায়াম করলে কি হয় কে জানে। আরেকদিন প্রীতম ভাই এলে জিজ্ঞেস করতে হবে। কয়েকটা কিশোরী ছেলে মেয়ে ঝালমুড়ি কিনে খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে। সে কি হাসাহাসি সবার মধ্যে। অংশীরও ওদের মত হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। মনেমনে বললো, ‘ইস! ওরা যদি আমার বন্ধু হতো! কত্ত মজা হতো।’

অংশী ওদের কাছ ঘেঁষে বসে থাকে। ওদের কথা শোনে। সবাই কত মজার মজার কথা বলে। ওদের হাসি দেখলে অংশীরও হাসি আসে। একটা মেয়ে আছে ভীষণ দুষ্টুমি করে কথা বলে। মেয়েটার নাম ছন্দা। ওদের গল্প শুনতে ভালো লাগছে অংশীর।

ছন্দা বললো, ‘আমাদের স্কুলের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলেটার নিক নেম হাবলু কেন বলোতো?’

একটা ছেলে বললো, ‘ছন্দা তুই কি আমার কথা বলছিস? আমিই তো স্কুলের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম বয়।’

ছন্দা বললো, ‘ঘটি ডোবে না, নামে তালুকদার। হা হা হা।’

সবাই উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। অংশীর দারুণ মজা লাগছে ওদের গল্প শুনতে। ও ছেলে মেয়ে গুলোর খুব কাছে বসে ওদের গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলে ওরা একসাথে হাসাহাসি করতে করতে চলে গেলো। অংশী খুশিমনে ফিরে এলো নিজের ঘরে। আজ পুকুরপাড়ে বসে সতেজ নিশ্বাস নিয়ে ওর মনে হয়েছিলো, ‘জীবনটা একেবারে মন্দ নয়। সবকিছুকে মন ভরে দেখতে জানলে জীবনটা আসলেই সুন্দর হয়ে ওঠে।’ আজ থেকে তাই করবে অংশী। ছোট ছোট বিষয় গুলোতেও সুখ খুঁজে নেবে।

অংশীর রুমে একটা ড্রেসিং টেবিল আছে। পুরনো হলেও আয়নাটা বেশ চকচকে। ভেজা কাপড় দিয়ে মোছার পর সেটা আরো চকচকে হয়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজেকে দেখে অংশী। আপনমনে হেসে ওঠে আর ভাবে, আমি তো দেখতে অনেক মিষ্টি। নিজের একটু যত্ন নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে যত্ন নিতে হয় আমি তো জানি না।

অংশী মনেমনে ঠিক করলো প্রতিদিন যে ছেলেমেয়ে গুলোর পাশে বসে ও ওদের কথা শোনে, আজ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে। ওরা যদি অংশীকে তুচ্ছ করে চলে যায়, যাবে। এতে কষ্ট পাবে না অংশী। অংশীর অনেকদিনের ইচ্ছে ওদের সাথে কথা বলার। আজ সন্ধ্যায় বলবেই।

প্রতিদিনকার মতো আজও ওরা এসেছে আড্ডা দিতে। আজ সবাই ফুচকা খাচ্ছে। অংশী ওদের পাশেই এসে বসেছে। অনেক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অংশী ছন্দাকে বললো, ‘আপনের লগে একটু কথা কই?’

ছন্দা চশমার ফাঁক দিয়ে অংশীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললো, ‘বলেন?’

অংশী সংকোচ করতে করতে বলেই ফেললো, ‘আপনেরা কত সুন্দর। কত গুছাইয়া থাকেন। আমারে একটু কন না ক্যামনে নিজের যত্ন নেয়া লাগে?’

সবাই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। প্রথমদিকে কথাটা শুনে ওদের হাসি এলেও, এর মর্মার্থ বুঝে মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো।

ছন্দা বললো, ‘আপনি নিজের যত্ন নিতে চান?’

– ‘হ। না, হ্যাঁ। নিতে চাই।’

– ‘বাহ, আমি বলে দিচ্ছি।’

ছন্দা বলার আগেই ওদের একটা বন্ধু দুষ্টুমি করে বললো, ‘ প্রতিদিন রাত্রে মুখে মুরগীর পাতলা গু মেখে ঘুমাবেন। সকালে উঠে ধুয়ে ফেলবেন।’

দু তিনজন হেসে উঠলো। ছন্দা ওদেরকে রাগ দেখিয়ে বললো, ‘চুপ করবি তোরা? আপু, আপনি ওদের কথা শুনবেন না। ওরা খুব ফাজিল।’

অংশী বললো, ‘আমি জানি। আমি রোজ আপনেগের পাশে বইসা আপনেগের গল্প শুনি। আমার কি যে ভালো লাগে! আপনেরা সবাই খুব ভালো। আমার সবাইরেই খুব ভাল্লাগে।’

সবাই অবাক হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। রুম্পা নামের একটা মেয়ে বললো, ‘আমিও তাই ভাবছি। প্রতিদিন আপনাকে দেখি আমাদের কাছাকাছি বসে থাকতে। আমি অবশ্য সবাইকে বলতে চেয়েছিলাম..’

ছন্দা অংশীকে বললো, ‘আপনাকেও আমার খুব ভালো লেগেছে। বসুন না আমাদের সাথে। ফুচকা খান।’

ওদের জোড়াজুড়িতে একটা ফুচকা নিয়ে কামড় দিলো অংশী। এই প্রথম এ খাবারটা খাচ্ছে ও। অনুভূতি ভীষণ অন্যরকম। খুব মজা লেগেছে ওর। হেসে বললো, ‘আরেকটা খাই?’

সবাই অংশীর সরলতা দেখে মুগ্ধ। বিশেষ করে ছন্দার খুবই ভালো লেগেছে অংশীকে। ছন্দা বললো, ‘নিজের যত্ন কিভাবে নিতে হবে বলে দিচ্ছি। প্রতিদিন গোসল করতে হবে, তিনদিন পরপর চুলে শ্যাম্পু করতে হবে, চুল আঁচড়িয়ে পরিপাটি করে রাখতে হবে। মুখে ক্রিম মাখতে হবে, লোশন দিতে হবে। হালকা লিপস্টিক দিতে হবে। আর নিজেকে বেশিবেশি ভালোবাসতে হবে।’

ছন্দার কথাগুলো অংশীর এতটাই ভালো লাগলো যে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো ওকে। অংশী উজ্জ্বল হয়ে বললো, ‘আইজ থাইকা করমু।’

– ‘হ্যাঁ। তুমি তো অনেক সুন্দর। কি মিষ্টি দেখতে। মায়াবী!’

অংশী লজ্জা পেয়ে বললো, ‘আপনেরা সবাই অনেক সুন্দর। মায়াবী।’

সবাই মুচকি হাসলো অংশীর কথায়। অংশীকেও ওদের খুব পছন্দ হয়েছে। ছন্দা আরেকটা ফুচকা খাইয়ে দিলো অংশীকে। ধীরেধীরে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হলো অংশীর সাথে সবার।

২৭

মাহিব সিনেমা ইডিটিংয়ের কাজে ভীষণ ব্যস্ত। সিনেমা মুক্তির জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সবমিলিয়ে দারুণ ব্যস্ততায় সময় কাটছে ওর।

সেদিন প্রীতম বাসায় গিয়ে বাবার সাথে কথা বলেছে এ ব্যাপারে বাবা মা মাহিবকে কিছুই জানায় নি। বরং তারা সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে মাহিবকে জিজ্ঞেস করেছিলো মাহিবের কারো সাথে সম্পর্ক আছে কিনা? মাহিব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলো, ‘নেই।’

ধানমণ্ডির বাসায় গিয়ে দরজায় তালা দেখে মাহিব প্রীতমকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে অংশী কোথায়? সেদিন প্রীতম মিথ্যে বলেছিলো মাহিবকে। বলেছিলো, অংশী হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে চলে গেছে। এ ব্যাপারে আর জানার চেষ্টা করেনি মাহিব। আপদ নিজে থেকে বিদায় হয়েছে এই ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলো। আজকাল অংশীর কথা মাহিবের খুব একটা মনে পড়ে না।

ল্যাপটপে মন দিয়ে কাজ করছিলো মাহিব। গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে এক হাতে সিগারেট টানছিলো আর অন্য হাতে কাজ করছিলো। এমন সময় অফিসের পিয়ন এসে বলে, ‘স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছেন।’

মাহিব সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘দুই মিনিট পরে পাঠাও।’

পিয়ন চলে যায়। সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে মাহিব অ্যাস্ট্রেতে ফেলে দেয়। মাথা তুলতেই একটি মেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘মে আই কাম ইন?’

চমকে তাকায় মাহিব। প্রসন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। চোখেমুখে উজ্জ্বল দিপ্তী জ্বলজ্বল করছে। মাহিবের সাথে চোখাচোখি হতেই দাঁত বের করে হাসি দিলো। মাহিব মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘ইয়েস, কাম ইন।’

মেয়েটা ভিতরে ঢুকে অনায়াসে চেয়ারে বসে পড়লো। হাতের ব্যাগটা টেবিলে রেখে বললো, ‘গুড মর্নিং।’

মাহিব প্রসন্ন হেসে উত্তর দেয়, ‘গুড মর্নিং।’

মেয়েটার ব্যাগের সৌন্দর্য আকৃষ্ট করে মাহিবকে। একটা হ্যান্ডব্যাগ ই বলে দিচ্ছে কতটা রুচিশীল একজন মেয়ে। মেয়েটা রূপেও রূপবতী। মাহিব জানতে চাইলো, ‘বলুন?’

মেয়েটি হাসিমুখে বললো, ‘আগে নিজের মুগ্ধতা শেয়ার করি। আপনার কাজ আমাকে অসম্ভব মুগ্ধ করে। এত সুন্দর ফিল্ম কি করে বানান আপনি! একটা শর্টফিল্ম কেন এত সুন্দর হবে? আমি ইমপ্রেসড। কি অভিনব একজন শিল্পী আপনি। অসম্ভব সুন্দর!’

মাহিব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো প্রশংসা শুনে। হাসতে হাসতে বললো, ‘থ্যাংকস। কিন্তু বেশি ইমপ্রেসড হওয়া ভালো না।’

– ‘অবশ্যই ভালো। ভালো কিছু সবসময়ই ভালো। যাইহোক, এবার নিজের পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমি স্মরণিকা আহমেদ। এমবিএ কমপ্লিট করে এখন ঠিক বেকার বলা যায় না, পাত্র খুঁজছি। বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছি।’

বলতে বলতে হো হো করে হাসতে লাগলো স্মরণিকা। মাহিব হেসে বললো, ‘নাইস জোক ইয়ার। বেকার নন সেটা প্রমাণ করার জন্য দারুণ উদাহরণ দিলেন।’

– ‘থ্যাংক্স।’

– ‘অবশ্যই ওয়েলকাম। তো আমার কাছে কেন? আমি তো ঘটক নই, পাত্র নই, বিয়ে পড়াইও না।’

– ‘হা হা, তৃতীয়টা হতে পারবেন না তবে প্রথম দুটো নিশ্চয়ই হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। হা হা। কিন্তু আমি সেজন্য আসিনি।’

মাহিব মুচকি হেসে জবাব দেয়, ‘তবে কিভাবে উপকারে আসতে পারি ম্যাম?’

মেয়েটা ঝলমল করতে করতে বলে, ‘আমার আরেকটা ছোট্ট পরিচয় আছে। আমি টুকটাক লেখালেখি করি। এবারের বইমেলায় আমার একটা বই আসছে। আমি আমার বই নিয়ে একটা ট্রেইলর ভিডিও আর একটা শর্ট ফিল্ম বানাতে চাই। আমার অনেক ইচ্ছা, ইনফ্যাক্ট স্বপ্ন বলতে পারেন যে আমার ভিডিওটা আপনি তৈরি করে দিন।’

মাহিব দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আপনার ভিডিও?’

মেয়েটা হাসতে হাসতে বলে, ‘সরি। আমাকে শর্ট ফিল্ম তৈরি করে দিতে হবে। আপনিও দুষ্টু কম নন।’

– ‘হা হা হা।’

মেয়েটা অনুনয়ের সুরে বললো, ‘আমাকে ফেরাতে পারবেন না। কাজটা আপনাকে করে দিতেই হবে। স্ক্রিপ্ট আপনি চাইলে আপনি তৈরি করতে পারবেন, আর গল্প চাইলে আমিও গল্প দিতে পারি। প্রডিউসার আমার বাবা।’

– ‘বাহ! সবই রেডি দেখছি।’

– ‘সবই রেডি। প্লিজ আপনি রেডি হয়ে যান।’

– ‘ওকে হয়ে গেলাম।’

– ‘সিরিয়াসলি! আমি কি তাহলে আনন্দ উল্লাস করতে পারি?’

মাহিব একটু ভেবে বললো, ‘হুম পারেন। আমার হাতে আপাতত কাজ কম। তাই করে দিতে পারছি। তাছাড়া আপনার উচ্ছলতা, হাসিখুশি একটা আমেজ আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনার কাজ করাই যায়।’

মেয়েটা লাফিয়ে উঠে বললো, ‘উফফ থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে। আচ্ছা আপনি এত সুন্দর ফিল্ম কি করে বানান? কি জাদুতে বানান?’

– ‘যদিও আমি আপনার গল্প পড়িনি। আমিও কিন্তু বলতে পারি, আপনি এত সুন্দর গল্প কি করে লেখেন?’

– ‘দিলেন তো স্টপ করে। এরপর আর কি বা বলার থাকে। তাহলে পেমেন্ট টা?’

মাহিব কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ‘কাজের ধরণ, স্টোরি, ডিউরেশান সবকিছু মিলিয়ে হিসেব করে আমি আপনাকে জানাবো।’

– ‘একটা কার্ড প্লিজ?’

মাহিব একটা কার্ড এগিয়ে দিলো মেয়েটার দিকে। মেয়েটা মাহিবের নাম্বারে কল দিয়ে বললো, ‘এটা আমার নাম্বার। নাম মনে আছে তো? স্মরণিকা আহমেদ।’

মাহিব মুচকি হাসি দিয়ে বলে, ‘ধন্যবাদ।’

– ‘আজ তাহলে আসি?’

– ‘সে কি! এক কাপ কফি না খেয়ে কি করে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন?’

– ‘খাবো। তবে অফিসে নয়, অফিসের বাইরে। সেটা অন্য একদিন।’

মেয়েটা হাসতে হাসতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। মাহিব আবারও ডাক দেয়, ‘এক্সকিউজ মি..’

পিছন ফিরে তাকায় স্মরণিকা। মাহিব বলে, ‘নাইস ব্যাগ।’

আরেকবার প্রাণঢালা হাসি দিয়ে ঝলমল করতে করতে বেরিয়ে যায় স্মরণিকা। ও বেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেক্ষণ ভর ঘরে ওর হাসির শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। স্মরণিকার শরীরের গন্ধটা এখনো ঘরময় দখল করে আছে। সেইসাথে গন্ধটা দখলে রেখেছে মাহিবকেও। মাহিব হেসে স্মরণিকার নাম্বারটা ফোনে সেইভ করে নেয়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here