তৃষ্ণা
পর্ব ৩০
মিশু মনি
.
অংশী প্রীতমকে বললো, ‘আমি আজ তোমার সাথে শপিংয়ে যেতে এসেছি। ফ্রি হবে কখন?’
প্রীতম হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘হুটহাট এসে শপিংয়ে নিয়ে যাওয়ার মত মেয়ে তুমি নও। আসার আগে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারতে আমি ফ্রি আছি কিনা?’
– ‘তুমি ব্যস্ত ছিলে বুঝি? আচ্ছা ব্যস্ত থাকলে আমি চলে যাই। আরেকদিন যাবো।’
– ‘অংশী, তোমাকে আমার চেয়ে ভালো কেউ বোঝে না। আমাকে বোকা বানিও না। আমি জানি তুমি কেন এসেছো। কি লাভ অংশী এসব করে?’
অংশী ক্ষণিক পলক মাথা নিচু করে থেকে বললো, ‘লাভ হয়তো নেই। বুকের জ্বালাটা মেটানো আরকি।’
প্রীতম আচমকা অংশীর বাহু চেপে ধরে বললো, ‘জ্বালা মেটানো তা এখন কেন? আমাকে ভালোবাসলে কি ক্ষতি হয়ে যেত তোমার শুনি?’
– ‘ভালোবাসাটা সবার জন্য আসে না প্রীতম ভাই। ভুল করে যাকে একবার ভালোবেসেছি, তাকে ভুলে আরেকজনকে কিভাবে ভালোবাসি বলেন?’
– ‘সে চরম প্রতারণা করার পরও ভালোবাসার নাম মুখে আনছো?’
– ‘ওর বোঝার ভুল ছিলো। মাঝেমাঝে মনেহয় মাহিব ভালো হয়ে যাবে। আমি আল্লাহর কাছে তাই প্রার্থনা করি।’
– ‘মাহিব এই এক বছরে তিনজনের সাথে সম্পর্কে গেছে। দ্রুত ব্রেকাপ ও হয়ে গেছে। আগামী পাঁচ বছরে আরো কতগুলো মেয়ের জীবন শেষ করবে তারপর কাকে বিয়ে করবে কে জানে। তার শুধরানোর সময় আছে?’
অংশী চুপ থেকে বললো, ‘তুমি কি চাও? আমি ওকে কখনো না খুঁজি?’
– ‘আমার চাওয়ায় কিচ্ছু যায় আসে না অংশী। হাজার বললেও তুমি শুনবে না এ আমার জানা আছে।’
– ‘প্রীতম ভাই, আজকাল মন মানে না। ভালোবাসার কাঙাল হয়ে গেছে মনটা।’
প্রীতম একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘সবই নিয়তি। সে যাই হোক, আমি ভাইয়াকে বলে এসে তোমার সাথে বেরোচ্ছি। একটু ওয়েইট করো।’
মাহিবের চেম্বারে ঢুকতেই প্রীতমের মনে হলো মাহিবকে কেমন এলোমেলো দেখাচ্ছে। উদভ্রান্তের মত পথের দিকেই চেয়ে আছে এমন একটা ভাব। প্রীতম মনেমনে হাসলো। মাহিবকে বাইরে যাওয়ার কথা বলে এক মুহুর্তে দেরি না করে প্রীতম বেরিয়ে আসে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে মাহিব আহসান। অংশী কি মাহিবকে দেখানোর জন্যই প্রীতমকে ফাঁদে ফেলেছে? যদি তাই হয়ে থাকে তবে অংশী বোকা। এই ভেবে একদন্ড হেসে মনে শান্তির ভাব আনার চেষ্টা করলো মাহিব।
অংশী প্রীতমের বাহুতে হাত রেখে মার্কেটে ঘুরে ঘুরে জামাকাপড় কেনাকাটা করলো। সাজগোজের জিনিসপত্রও কিনলো বেশ কতক। প্রীতম অংশীকে কেনাকাটায় ধারণা দিতে লাগলো। অংশীর হাস্যোজ্বল মুখ মনে একটা আলাদা রস এনে দিলো প্রীতমের। ও বারবার বিভিন্ন ব্যাপারে রসিকতা করতে লাগলো। অংশীও রসিকতায় তাল মিলিয়ে শব্দ করে হাসছিলো।
এভাবে একটা দিনের অর্ধেকটা সময় সুন্দরভাবে কাটিয়ে বাসায় ফিরলো অংশী। মনেমনে অপেক্ষা করতে লাগলো কখনো মাহিবের থেকে ডাক আসে। সারাটা রাত এসব এলোমেলো ভাবনাতেই কেটে গেলো। প্রীতমকে ফোন দেয়ার ইচ্ছে জাগলেও ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে বাধ্য হলো অংশী। প্রীতমের এখন বউ আছে। যখন তখন ওকে জ্বালানো ঠিক হবে না।
এই অস্থির রকম যন্ত্রণা নিয়েই সময় কাটতে লাগলো অংশীর। মনে কোনো শান্তি নেই। তবুও জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে দিব্যি সুখী মানুষের মত চলাচল। বাচ্চাকে সামলে কাজ করা, সময়মত শাড়ি ডেলিভারি দেয়া, টাকা নিয়ে জমিয়ে রাখা সবই চলছে সমান গতিতে। শুধু মনের ভেতর একটা চাপা যন্ত্রণা থেকে থেকে জ্বলে উঠে কিছুক্ষণ জ্বলতে জ্বলতে আবার দপ করে নিভে যায়।
মাহিবের কৌতুহল দমেনি। প্রীতমকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো অংশীর সাথে ওর যোগাযোগ কিভাবে হলো? প্রীতম কিছুটা নিশ্চুপ থেকে বললো, ‘ আমাদের যোগাযোগ শুরু থেকেই ছিলো।’
মাহিব অবাক হয়ে বললো, ‘মানে? কি বলতে চাস তুই?’
– ‘আমাদের যোগাযোগ সবসময়ই ছিলো ভাইয়া। এরবেশি কিছু আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না।’
– ‘অংশী কোথায় থাকে? ওর ঠিকানা আমাকে দে।’
– ‘কেন দেবো? আবার ওর লাইফটা ছিন্নভিন্ন করে দেবে সেজন্য?’
– ‘প্রীতম, মুখের উপর কথা বলবি না। অংশীর ঠিকানা দে, ওর সাথে আমার কথা আছে।’
– ‘বাহ। যখন দেখলে অংশী অনেকটা চেঞ্জ হয়ে গেছে তখন তোমার মনে প্রেম উথলে উঠলো নাকি?’
– ‘বেশি কথা বলা আমার পছন্দ নয়। ঠিকানা দে, ওর সাথে আমার ভীষণ দরকার আছে।’
প্রীতম অংশীর ঠিকানা মাহিবকে বলে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। মনেমনে স্থির করে ফেলে এরপর আর অংশীর কোনোরকম খোঁজ ও নেবে না। মাহিব এখন অংশীর কাছে গিয়ে সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করবে, যদি তাই করে তবে ওরা ভালো থাকুক। প্রীতম আর ভুল করেও ওদের মাঝে এসে দাঁড়াবে না।
মাহিব গাড়ি নিয়ে সোজা অংশীর দোকানে চলে এলো। অংশী দোকানে বসে শাড়ি গুছিয়ে রাখছিলো। মাহিবকে দেখে চমকে উঠলো ও। যদিও মাহিবের অপেক্ষাতেই ছিলো। মাহিব পুরো দোকানের এদিক ওদিক ভালোভাবে দেখে বলে, ‘বাহ, অনেক দূর এগিয়েছো তো।’
– ‘মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার কথা ছিলো নাকি মাহিব সাহেব?’
– ‘আমি জানি তুমি মুখ থুবড়ে পড়বে না।’
– ‘তাই বুঝি পথে ফেল গিয়েছিলেন?’
– ‘হয়ত বা। তোমার সাজসজ্জা দেখে অবাক হচ্ছি। কাক কেমন চড়ুই পাখির মত হয়ে গেছো।’
– ‘আমি কখনোই কাক ছিলাম না। চড়ুই পাখিই ছিলাম। শুধু ডানার রংটা ভিন্ন ছিলো হয়ত।’
– ‘তাই? দোকান কবে দিয়েছো?’
– ‘যখনই দেই, জেনে কি করবেন?’
– ‘বাচ্চাটাকে কি করেছো?’
– ‘কোন বাচ্চা?’
– ‘তোমার বাচ্চা।’
অংশী হেসে বললো, ‘আমার বাচ্চা? নাকি তোমার সন্তান? নিজের সন্তানকে পথে ফেলে দিয়েছো, আবার জিজ্ঞেস করছো বাচ্চাটাকে কি করেছো?’
– ‘ওয়েট। আমার বাচ্চা যখন, তখন আমি যা ইচ্ছে করতে পারবো।’
– ‘তোমার পেটে তো আর ধরোনি। আমার পেটে দিয়েছিলে কেন? বেঈমান কাপুরুষ কোথাকার।’
– ‘কি বললে?’
– ‘বেঈমান। আমার সরল মন নিয়ে খেলেছিলে তুমি। নিজের সন্তানকে নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছিলে।’
মাহিব চুপ করে রইলো। অংশী মাহিবের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি একটা কাপুরুষ। এইযে এত পুরুষত্ব ফলাও না, এগুলো আসলে তোমার কাপুরুষতা প্রমাণ করে।’
– ‘অংশী, তোমার দ্বারে এসেছি বলে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারো না।’
– ‘আমি যা ইচ্ছে তাই বলবো মাহিব সাহেব। বলার অধিকার আমার আছে। শুনতে ভালো না লাগলে চলে যান।’
– ‘ওকে চলে যাচ্ছি। এসেছিলাম তোমার খোঁজ খবর নিতে। কিভাবে আছো, কেমন জীবনযাপন করছো তাই দেখতে। এত দেমাগ দেখাবে কল্পনাও করিনি।’
অংশী হাসতে হাসতে বললো, ‘দেমাগ কোথায় দেখালাম? এক বছর পর এসে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলে দু চারটা কথা শুনতেই হবে সেটা কি মাথায় আসেনি আপনার?’
– ‘কোন অধিকার বলে কথা শুনাবে তুমি আমাকে?’
– ‘যে অধিকার বলে আজকে নিঃসংকোচে আমার ঘরে এসেছেন।’
মাহিব অংশীর কাছে এগিয়ে এসে বললো, ‘হ্যাঁ, তোমার ওপর আমার অধিকার সবসময় আছে, সবসময় থাকবে।’
অংশী মাহিবের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তাই? কিসের অধিকার শুনি? দায়িত্ব নেই,শুধু অধিকার আছে বুঝি?’
মাহিব চুপ করে রইলো। অংশী বললো, ‘পথে ফেলে রেখে চলে গিয়ে আবার এসেছে অধিকার খাটাতে। অদ্ভুত নিয়ম তোমাদের শহরের।’
– ‘অংশী, তোমার বাচ্চাকে কি করেছো বলো?’
– ‘যদি বলি বেঁচে আছে তবে কি নিয়ে যাবে?’
– ‘হা হা, নিয়ে যাবো কেন? আমি জানতে চাইছি।’
– ‘তাহলে জানতে চেয়ো না। ওর বাবার পরিচয় দিতে পারলে তবেই এসো।’
মাহিব হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘তুমি কি ভেবেছো আমি তোমাদেরকে মেনে নিতে এসেছি? ভুল ভাবছো। শুধু দেখতে এসেছি কি অবস্থায় আছো।’
– ‘দেখলেন তো। এবার চলে যান। আর কখনো আসবেন না।’
– ‘যাচ্ছি। তবে আজকের আচরণটা তুমি ঠিক করলে না।’
মাহিব চলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে আসতে উদ্যত হলো। অংশী কয়েক পা এগিয়ে এসে বললো, ‘একটা কথা মনে রাখবেন মাহিব সাহেব। জগতের সবাই আপনার পাপ ভুলে যাবে। কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক আপনার পাপ কখনো ভুলবে না। আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে যে শাস্তি দেবে, তা আর কেউ দিতে পারবে না। শুধু সময়ের অপেক্ষা।’
চলবে..