তৃষ্ণা
পর্ব ৪
মিশু মনি
.
অংশীর চোখের পাপড়ি ঘন ঘন কাঁপছে। চোখেমুখে উচ্ছলতা নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। কিন্তু কোথাও যেন সামান্য অভিমানের স্পর্শ লেগে আছে। মাহিব মুচকি হেসে বললো, ‘তুমি ছাড়া গেলে যে আমার ভালো লাগবে না।’
– ‘কেন ভালো লাগবে না?’
– ‘তুমি পাশে থাকলে মাথায় কবিতা আসে।’
– ‘কি আসে?’
অংশীর কৌতুহল ভরা চোখের দিকে চেয়ে কি বলবে বুঝতে পারলো না মাহিব। ফিক করে হেসে ফেললো। অংশী দুই পা সামনে এগিয়ে পিছন ফিরে বললো, ‘আসেন।’
মাহিব পথ ধরলো অংশীর পাশাপাশি। অংশীর চোখ দুটো এখন অন্যরকম লাগছে। অবশ্য মেয়েটাকে একেক সময় একেক রকম লাগে মাহিবের। যাকে এক কথায় ‘অনন্যা’ বলা যায়। চোখ দুটো আরেকবার দেখতে ইচ্ছে করছে।
মাহিব বললো, ‘আমার চোখের দিকে তাকাও তো।’
পিছন ফিরে তাকালো অংশী। মাহিব কিসের দিকে তাকাতে বলেছে বুঝতে পারে নি ও। পিছন ফিরতেই দেখলো মাহিব এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো অংশীর। মাহিবের সুক্ষ্ম দৃষ্টির দিকে তাকানো যায় না। ভয় ভয় লাগে।
মাহিব বললো, ‘একসাথে যাই, আমাকে পিছনে ফেলে যাচ্ছো কেন?’
অংশী কোনো উত্তর দিলো না। মাহিব ওর সাথে সাথে চলতে শুরু করে দিয়ে বললো, ‘তুমি কবিতা বোঝো?’
– ‘বইয়ের কবিতা?’
– ‘হ্যাঁ। বোঝো?’
– ‘বুঝবো না কেন? স্কুলে কত কবিতা পড়েছি। কেন?’
– ‘তখন যে ওভাবে বললে.. যাইহোক, তোমাকে দেখলেই আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। বুঝেছো আমি কি বলছি?’
অংশী অবাক হয়ে মাহিবের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনি কবিতা লিখতে পারেন?’
– ‘ছোট খাটো দু চারটা লাইন বানাতে পারি। তোমাকে দেখলেই আমার মাথায় কবিতা এসে ঘুরপাক খায়।’
খিলখিল করে হেসে উঠলো অংশী। হাসতে হাসতেই দুজনে জংগলের ভেতরে প্রবেশ করলো। মাহিব কবিতার সুরে বলে উঠলো, ‘গহীন অরণ্যে রূপবতীর লাজ হয়েছে পায়, সে হাঁটতে নাহি চায়।’
অংশী বললো, ‘এইটার মানে কি?’
– ‘মানে গভীর জংগলের ভিতরে রূপবতীর পায়ে লজ্জা হয়েছে তাই সে হাঁটতে চাইছে না। রূপবতীকে হাতির পিঠে নিতে হবে নয়তো কোলে নিতে হবে।’
লজ্জা পেয়ে অংশী মুখ ঘুরিয়ে বললো, ‘আপনার মুখে কিচ্চু থামে না। যাই মনে আসে, সব বইলা দেন। এমন ক্যান আপনে?’
মাহিব হাসতে হাসতে বললো, ‘আমি এমনই। তোমার কবিতা ভালো লাগে নি?’
– ‘হ লাগছে। আরো শুনান দেখি?’
– ‘রূপবতীর অন্ধকার চুলে সুবাস ছড়ায় ভারি, যেথায় মুখ ডুবিয়ে ঘুম এসে যায় দুচোখ জুরায় আমারই।’
কবিতার লাইন গুলো দ্রুত বলাতে কিছুই বুঝলো না অংশী। কিন্তু ছন্দের মত শোনাচ্ছে বলে শুনতে বেশ ভালো লাগছে। ও আরো বলার জন্য অনুরোধ করলো। মাহিব অংশীর দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন লাইন বানিয়ে চলেছে আর শুনাচ্ছে অংশীকে। পুলকিত হয়ে খিলখিল করে হেসে উঠছে অংশী। মাহিব অংশীর হাসির শব্দে মুচকি হাসছে। মেয়েটার হাসি ঝুনঝুনির মত কানে বেজে ওঠে। ভালোই লাগে বেশ।
জংগল পেরিয়ে এসে একটা ফাঁকা জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে মাহিব বললো, ‘এই জায়গাটা কেমন লাগছে অংশী?’
অংশী চারিদিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভারি সুন্দর। কেন?’
– ‘এখানে একটা শট নিলে কেমন হবে?’
– ‘শট কি?’
হো হো করে হেসে উঠলো মাহিব। হাসি থামিয়ে বললো, ‘মানে এখানে যদি সিনেমার শুটিং হয় কেমন হবে?’
অংশী পুলকিত হয়ে বললো, ‘সত্যি! এখানে নায়ক নায়িকা আসবেন? কি যে মজা হইবো…’
অংশীর আনন্দ দেখে মাহিব বললো, ‘হুম। অনেক নায়ক আসবে, নায়িকা আসবে। আচ্ছা অংশী, তুমি সিনেমা দেখো?’
– ‘দেখি তো। আব্বার ফোনে ডাউনলোড কইরা আনলে দেখি।’
– ‘আমার ল্যাপটপ আছে। বাসায় গিয়ে ল্যাপটপে মুভি দেখাবো। মনে করিয়ে দিও কেমন?’
– ‘আইচ্ছা।’
অংশী ঘুরে ঘুরে জংগলে হাঁটছে। লোকেশন দেখতে মনোযোগ দিলেও বারবার আড়চোখে অংশীর দিকে তাকাচ্ছে মাহিব। অংশী আপন মনে নাচছে, গুণগুণ করছে। অংশীকে অবাক করে দিয়ে গান গেয়ে উঠলো মাহিব। গানের সুর শুনেই চমকে উঠলো অংশী। চমৎকার কন্ঠ মাহিবের! গানের সাথে সাথে ঘুরে ঘুরে উল্লাস করছিলো অংশী। মাহিব একটা গাছ থেকে ফুল ছিড়ে গুঁজে দিলো অংশীর চুলে। অংশী কখনো দৌড়াচ্ছে, কখনো গাছ ধরে ঘুরছে। মাহিব এসব দৃশ্য দেখে নিজেকে সিনেমার নায়ক ভাবতে শুরু করেছে। সামনে ঘটে যাওয়া সমস্ত দৃশ্য ওর কাছে সিনেমার মত লাগছে। মাহিব মুচকি হাসছিলো শুধু।
চারটা জায়গা পছন্দ করে অংশীকে নিয়ে বাসায় ফিরলো মাহিব। আজ মনটা বেশ ফুরফুরে। কোনো দুশ্চিন্তা নেই, কাজের চাপ নেই। কোথায় যেন আনন্দমাখা একটা রেশ লেগে আছে। যার স্পর্শ টের পাচ্ছে মাহিব। অংশীর মায়ায় ভরা হাসিমুখ দেখে মনে হলো সেই আনন্দের রেশ অংশীর চোখেমুখে ফুলের রেণুর মত লেগে আছে। যে আনন্দ স্পর্শ করেছে মাহিব কেও।
খাওয়া দাওয়া করে চলে যাওয়ার জন্য বের হলো মাহিব। ঘর থেকে বেরিয়েই অংশীর সাথে দেখা হয়ে গেলো। ছুটতে ছুটতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে এক রাজ্য মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো, ‘চইলা যাইতেছেন?
খুব মিষ্টি শোনালো প্রশ্নটা। মাহিব মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ যাচ্ছি। আবার আসবো এক সপ্তাহ পর। সেবার এসে অনেকদিন থাকবো।’
অংশী উত্তরে মৃদু হাসলো। মাহিব চলে যাওয়ার সময় একবার ও পিছন ফিরে তাকালো না। কিন্তু মাহিবের দিকে চেয়েই রইলো অংশী। মাত্র দুদিনেই মাহিবের প্রতি একটা টান অনুভব করছে অংশী। চলে যাচ্ছে বলে মনটা বিষন্ন হয়ে যাচ্ছে। মা এসে অংশীকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘নদী থিকা পানি আন যা। ড্রামে পানি নাই।’
মায়ের কথায় হুশ ফিরে পায় অংশী। নদীর তীরে গিয়ে স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে মাহিবের কথা। গতকাল সন্ধ্যাটা স্বপ্নের মত ছিলো অংশীর কাছে। এখনো একটা ঘোরের মাঝেই অবস্থান করছে অংশী। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখে মাত্র ঘুম থেকে উঠলো।
রাতে ভালো ঘুম হলো না অংশীর। কেন হলো না নিজেও বুঝলো না। বারবার ঘুম ভেঙে উঠে বসলো। বাইরে এসে চাঁদের পানে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু বড্ড ছটফট করছে মনটা। কেন যে এমন হচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না মেয়েটা।
৪
অবশেষে প্রতিক্ষীত দিনটি চলে এলো। আজ মাহিব আসবে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বাসা পরিষ্কার করার কাজে লেগে গেছে অংশী। দুটো ড্রাম ভর্তি করে পানি জমিয়ে রেখেছে, ঘরের মেঝে নতুন করে লেপ দিয়েছে, সব কিছু পরিষ্কার পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছে একেবারে। মাহিব এসে যেন কোথাও এতটুকু ময়লা দেখতে না পায়।
আজ খুব সকাল সকাল গোসল সেরে নিলো অংশী। গোসলের সময় মাহিবের সেদিন ওভাবে চলে আসার কথা মনে পড়তেই লজ্জা লজ্জা লাগছিলো। মনটা অস্থির হয়ে আছে যেন। কখন আসবে সেই লোকটা?
উঠোনে রশিতে কাপড় শুকাতে দিচ্ছিলো অংশী। এমন সময় বাবার সাথে মাহিবকে কথা বলতে বলতে আসতে দেখা গেলো। কাপড় রেখেই এক দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো অংশী। শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগলো ওর। সেই মানুষটা এসেছে!
মাহিব ঘরে ঢুকেই আগে জিজ্ঞেস করলো, ‘অংশী কোথায় গেলো? আমাকে দেখে লজ্জা পেয়েছে বোধহয়।’
আমির আলী হাসতে হাসতে বললেন, ‘হ্যাঁ, লজ্জা পাইছে। আপনি বসেন, আমি ওকে আসতে বলতেছি।’
বাঁশের বেড়া হওয়ায় পাশের রুম থেকে সব শুনতে পাচ্ছিলো অংশী। অংশীর বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে শুরু করেছে। এখন মাহিবের সামনে যেতে হবে! উফফ!
দ্রুত চোখে কাজল দিয়ে নিলো অংশী। ছোট্ট করে একটা টিপ এঁকে নিলো কপালে। তারপর ওড়নাটা ভালো করে দিয়ে পাশের ঘরে এসে ঢুকলো। মাহিব ওকে দেখে বললো, ‘কি অবস্থা অংশী?’
অংশী মৃদু স্বরে বললো, ‘ভালো।’
মাহিব উঠে এসে আলতো করে একটা আঙুল ছোঁয়ালো অংশীর চোখের কোণে। শিউরে উঠলো অংশী। মাহিব বললো, ‘কাজল বাঁকা পড়েছো।’
– ‘আপনে তো দেখি আয়না।’
হাঁফাতে হাঁফাতে কথাটা বলেই এক ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো অংশী।
চলবে..