তৃষ্ণা ” পর্ব-৩

0
1484

তৃষ্ণা
পর্ব ৩
মিশু মনি
.
দুজন যুবক যুবতী পাশাপাশি থাকা মানেই সমূহ বিপদের লক্ষণ। কিন্তু অংশীর কোনো ভয়ই করছে না। বরং উত্তেজনা বোধ করছে। মাহিব খুব সুন্দর করে কথা বলে। মাহিবের কণ্ঠ নিঃসৃত শব্দ শোনার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে ও।

মাহিব অনেক্ষণ কোনো কথা বললো না। যেন এই রাত্রিবেলাতেও সে লোকেশন পছন্দ করছে। অংশী কি বলবে বুঝতে পারে না। চুপচাপ মাহিব এর পাশাপাশি হাঁটছে।

কুয়াশা পড়তে আরম্ভ করেছে। শীত শীত ভাব হচ্ছে এখন থেকেই। মাহিব বললো, ‘চাঁদ ভালো লাগে তোমার?’
অংশী চমকে উঠলো। প্রশ্নটা আরেকবার জানতে চাইলো ও। মাহিব আবারও বললো, ‘চাঁদ ভালো লাগে?’

অদ্ভুত প্রশ্ন তো। এরকম কথা কোনোদিনও কাউকে বলতে শোনেনি অংশী। কিন্তু প্রশ্নটা সুন্দর । অংশীর চাঁদ খুব ভালো লাগে, চাঁদের সাথে কথা বলতেও ভালো লাগে। ও লাজুক স্বরে বললো, ‘হু ভাল্লাগে।’
– ‘আজ বোধহয় পূর্ণিমা। বেশ বড় করে চাঁদ উঠেছে দেখেছো?’

অংশী আকাশের দিকে তাকালো। কেবল চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু তাই দেখেও কোনো মানুষ এমন পুলকিত হয় তা অংশীর জানা ছিলো না। ও বললো, ‘খুব সুন্দর।’
– ‘চাঁদ টাকে ধরে এনে যদি তোমার হাতে দেই?’
– ‘এইটা আবার সম্ভব নাকি?’
– ‘অবশ্যই সম্ভব। চাঁদের আলো মুঠো করে তোমায় দিলে তুমি দুহাত পেতে সেই আলো নেবে।’
– ‘আপনে খুব অদ্ভুত মানুষ!’

অংশীর কথা শুনে হাসলো মাহিব। চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে এক মুঠো আলো এনে অংশীকে দিয়ে বললো, ‘নাও নাও ধরো ধরো।’

অংশী কি করবে বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইলো। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় মানুষ টাকে দেখতে খুব মায়াবী লাগছে। পুরুষ মানুষ আবার এত মায়াবী হয় নাকি! ইনি বোধহয় পুরুষ না, রূপকথার রাজকুমার। অংশী ঘোরের মাঝে চলে গেছে। হাত পেতে বাড়িয়ে দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলো। মাহিব ওর হাতে চাঁদের আলো তুলে দিয়ে হাত দুটো মুঠো করে দিয়ে বললো, ‘রাখো।’

এমন কান্ড কেউ বাস্তবে করতে পারে সে কল্পনাও অংশী কখনো করেনি। খুব অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছে ওর। যেন কল্পলোকের রাজ্যে চলে এসেছে। চাঁদের আলো ও নদীর জলের ধোয়া মিলে এক ধরণের ভ্রম সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে।

মাহিব অংশীর হাত ছেড়ে দিলো না। অংশীর হাতের মুঠো থেকে কিছু একটা নিয়ে নিজের পকেটে রাখলো এমন ভাব করে বললো, ‘পকেটে রেখে দিলাম তোমার আলো। বাসায় গিয়ে ফেরত দিবো।’

অংশী হাত ছাড়িয়ে নিতে পারলো না। মাহিব ওর হাত ধরে রেখেছে। কি এক ভালোলাগা তৈরি হয়েছে এখন! অংশী ঠিক বুঝতে পারছে না কি ঘটছে। মাহিব ওর হাত ধরে হাঁটছে! সবকিছু স্বপ্নের মত ঘটে চলেছে। বাস্তবে খেই হারিয়ে ফেলেছে অংশী। শুধু খেলনা পুতুলের মত মাহিবের সাথে সাথে হাঁটছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে মাহিবের দিকে।
মাহিব নিজের গা থেকে জ্যাকেট খুলে অংশীকে পড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘তোমার জামাকাপড় ভেজা। আমার জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না?’

অংশীর কাছে এই প্রশ্নটাও স্বপ্নের মত মনে হলো। ওর খুব কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এই লোকটা এমন কেন! কোথ থেকে উড়ে এসে এমন স্বপ্নের রাজ্যে প্রবেশ করিয়ে দিলো অংশীকে। এখন যা ঘটছে সবই স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। মনে হচ্ছে এই লোকটা যা বলবে তাই করবে অংশী। এমন কেন হচ্ছে!

মাহিব অংশীর খুব কাছাকাছি হাঁটছে। অংশী আবেগে মৃদু মৃদু কাঁপছিলো। মাহিবের নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পারছে ও। খুব দ্রুত গতিতে হাঁটছে দুজনে। তারপরও অংশীর মনে হচ্ছে, এই পথ যদি অনন্তকাল ধরে চলতো..

কিন্তু পথ খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেলো। বাকি পথ মাহিব গুণগুণ করে গান শুনিয়েছে। কিন্তু অংশীর ঘোর এতে কমেনি বরং আরো তীব্র হয়েছে। কেবলই মনে হচ্ছে নদীর ধার দিয়ে এই কুয়াশাভেজা রাতে হেঁটে এসেও তা স্বপ্নের মত লাগছে। যেন পুরো পথটাই স্বপ্ন ছিলো!


বাসায় ঢুকে মাহিব আমির আলীর ঘরে গিয়ে ঢুকলো। অংশী নিজের ঘরে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে ঝিম মেরে বসে রইলো অনেক্ষণ। একটু আগে যেন স্বর্গ থেকে ফিরে এসেছে এমন লাগছে। কি এক অদ্ভুত ঘোর, অদ্ভুত ভালো লাগা! সমস্ত শরীর জুরে একটা কিছু আন্দোলিত করছে। তীব্রভাবে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আর শিউরে উঠছে অংশী।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় অংশীকে বারবার ডাকলেও ও খেতে আসতে সংকোচ করছিলো। মাহিব সহ সবাই মিলে মাটিতে বসে খাবার খাচ্ছে। অংশীর লজ্জা করছিলো ভীষণ। মাথা নিচু করে কেবল দু একবার মুখে দিলো খাবার। আর খেতেই পারলো না। মাহিব খেতে খেতে আমির আলীর সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো আর হাসাহাসি করছিলো। মাহিবের হাসির শব্দ কানে রিনিঝিনি বাজনার মত বাজছিলো অংশীর। ও কেবল একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো।

অংশী কোনোমত খাওয়া শেষ করে উঠেই বাইরে এলো অংশী। হাত মুখ ধুয়ে গোসলখানা থেকে বেরিয়ে ঘরে যাবে এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ালো মাহিব। অংশীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার চাঁদের আলো..’

তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে আলো ধরে এনেছে এমন ভাব করে আলোগুলো হাত মুঠো করে অংশীর দিকে এগিয়ে দিলো মাহিব। অংশী ঘোরের মাঝে হাত পেতে সে আলো গ্রহণ করলো। তারপর ছুটে চলে গেলো নিজের ঘরে।

সৌরবিদ্যুতের আলো জ্বলছে ঘরে। আলো নিভিয়ে দিয়ে কাথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো ও। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে অংশীর। অনেক্ষণ শুয়ে থেকেও ভ্রম কাটছে না। রাতে ঘুমের ঘোরে কত কিছু দেখছে অংশী। সবটাই মাহিবকে কেন্দ্র করে। বারবার ঘুম ভেঙে যায় আর এপাশ ওপাশ করে অংশী। অর্ধেক রাত পর্যন্ত এভাবেই কাটলো।

মাঝরাতে ঘুম এসেছিলো অংশীর। সকালে মায়ের ডাকে ঘুম থেকে ওঠার পর বুঝলো রাতের ভ্রম কেটে গেছে। গতরাতের সন্ধ্যাটা এখন কেবলই স্বপ্নের মত লাগছে। যেন এ সুখরাজ্যের একটা স্বপ্ন ছাড়া কিছুই ছিলো না।

অংশী যথারীতি আয়না বুলবুলকে নিয়ে এসে গাছের সাথে বেঁধে দিলো। তারপর ওদের সাথে কথা বলতে শুরু করে দিলো, ‘দেখ আয়না, ঠিকমতো থাকবি৷ একদম জ্বালাবি না আমারে।’

মাহিবের গলা শোনা গেলো, ‘কে জ্বালাচ্ছে তোমাকে?’
– ‘এই যে আয়না।’
– ‘আয়না কে?’
– ‘আমার ভেড়ার নাম আয়না।’
– ‘ওহ হো। সুইট নেইম। তোমার ভেড়াটাও সুইট।’

খিলখিল করে হেসে উঠলো অংশী। মাহিব বললো, ‘তোমাদের এখানে সকাল গুলো বড্ড সুন্দর। আমার তো আর যেতেই ইচ্ছে করছে না।’

অংশী মুচকি হেসে বললো, ‘আসেন পাহাড় থিকা ঘুইরা আসি। পাহাড়ের ওপর থিকা সূয্যো ওঠা দেখবেন।’
– ‘সত্যি! এক্ষুণি চলো তাহলে।’
– ‘আসেন আমার সাথে।’
– ‘দাঁড়াও আগে একবার ওয়াশরুম করে নেই। তোমার বদনার পানিগুলো শেষ হয়ে গেছে। আরেক বদনা পানি এনে দাও না?’

অংশী লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছিলো। দ্রুত দৌড়ে গিয়ে বদনা নিয়ে নদী থেকে পানি তুলে এনে দিলো। নদীটা জংগল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। পানির বদনা ওর সদ্য বানানো টয়লেটে রেখেই আবার দৌড় দিলো অংশী। দৌড়ে জংগলের আড়ালে চলে গেলো।

মাহিব বাইরে এসে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো অংশীর জন্য। কিন্তু অংশীর দেখা মিললো না। ওর চোখ গেলো সোজা পাহাড়ের উপর। দূরে পাহাড়ের উপর মেঘের মত সাদা সাদা ধোয়া উড়ছে। কি ভীষণ সুন্দর! অংশী কোথ থেকে ছুটে এসে পিছনে দাঁড়ালো- ‘চলেন।’

মাহিব দুষ্টুমি করে বললো, ‘তুমি গরুর বাছুরের মত সারাদিন শুধু ছুটাছুটি করো।’
-‘কিহ!’

হা হয়ে গেলো অংশী। মুখ বেঁকিয়ে বললো, ‘আপনি আমারে গরুর বাছুর কইলেন?’
– ‘আরে আরে রাগ করছো কেন? আমি তো মজা করলাম।’
– ‘এইটা মজা হইলো? আমি গরুর বাছুর?’
– ‘অংশী, বংশী বাজাইয়ো না। আমি জাস্ট ফান করেছি ইয়ার।’
অংশী মুখ কালো করে দুই পা পিছিয়ে গেলো। তারপর অভিমানের সুরে বললো, ‘বাছুরের সাথে আপনার যাইতে হইবো না।’

যাক বাবা। দারুণ মুশকিলে পড়া গেলো! মাহিব শুধু মজার ছলে একটা উপমা দিয়েছে মাত্র। মেয়েটা তো দুষ্টুমি টাও ধরতে পারে নি। রেগে আগুন হয়ে গেছে। অভিমানে গাল ফুলিয়ে ফেলেছে। কি করবে এখন!

অংশী পিছন দিকে ভোঁ দৌড় দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। মনেমনে ক্ষেপে রইলো মাহিব এর উপর।

সকালের খাওয়া দাওয়ার সময়ও মাহিবের সামনে এলো না অংশী। মা অংশীর ঘরে খাবার দিয়ে এলো। খাওয়ার পরপর আমীর আলী অংশীকে ডেকে বললেন, ‘মা অংশী, সাহেবরে নিয়া আইজও বেড়াইতে যাও মা। সাহেব তোমার উপর বড়ই খুশি হয়েছে। ওনার সাথে যাও মা।’

অংশী বাবার মুখের উপর না করতে পারলো না। মাথা একদিকে বাঁকা করে বললো, ‘আচ্ছা আব্বা।’

ঘরের বাঁশের চাটাইয়ের দেয়ালে ছোট আয়না আটকানো। সেই আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো অংশী। চোখে কাজল দিলো, গালে দিলো পাউডার। তারপর চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ালো। বের হওয়ার সময় আরেকবার দেখে নিলো নিজেকে। কি যেন নেই মনে হচ্ছে। ওহ হো, একটা টিপ। অংশী একটা কাঠি কাজলে ডুবিয়ে কপালে ছোট্ট করে টিপ দিলো। তারপর চুলগুলো বেণী করে সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

মাহিবের হাতে একটা যন্ত্র। তা দিয়ে ফট ফট করে আয়না বুলবুলের কি যেন করছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলো মাহিব ওদের ছবি তুলছে। আর হাতের ওটা ক্যামেরা। চমকে উঠলো অংশী। মাহিবের কাছে এগিয়ে এসে বললো, ‘আজকে বাবার সাথে না গিয়া আমারে ডাকলেন ক্যান?’

মাহিব পিছন ফিরে অংশীর চোখের দিকে তাকালো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here