তৃষ্ণা
পর্ব ৬
মিশু মনি
.
নিঝুম রাত
অংশীর ঘুম ভেঙে গেছে অনেক্ষণ হলো। চেষ্টা করছে ঘুমানোর কিন্তু আসছে না। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লো। দরজা ঠেলে বাইরে এসে দেখলো বাইরে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। চাঁদের আলোয় অংশীর চিনতে ভুল হলো না, মাহিব। এত রাতে না ঘুমিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেন!
অংশী গুটিগুটি পায়ে মাহিবের কাছে এসে দাঁড়ালো। মাহিব ওকে খেয়াল করে নি। আপনমনে সিগারেট টানছিলো। অংশী যখন বললো, “ঘুমান নাই?”
মাহিব চমকে উঠে অংশীর দিকে তাকালো- “তুমি!”
“হ। আপনে ঘুমান নাই ক্যান?”
“ঘুম আসছিলো না। তোমাদের এখানে নেটওয়ার্ক ও নেই যে অনলাইনে ঢুকবো”।
“কি লাইন? কই ঢুকবেন?”
মাহিব হেসে ফেললো, “আরে বুড়ি অনলাইন। ইন্টারনেট বুঝো?”
“ও.. ফেসবুক?”
”বাব্বাহ, ফেসবুকও বোঝো দেখছি”।
“আমার যে বান্ধবী গুলা সদরে পড়ালেখা করে ওদের ফেসবুক আছে। সবার মোবাইল ও আছে”।
“আহারে, তোমার মোবাইল নাই?”
“না। আব্বার মোবাইলে আমি নাটক দেখছি, ছবি দেখি। আমার মোবাইল কই পামু কন? আমরা তো গরীব মানুষ”।
“শোনো অংশী, নিজেকে এভাবে ছোট করতে নেই। সবসময় ভাব্বে আমরা অনেক ভালো আছি, সুখে আছি। তাহলে দেখবে জগতে তোমার চেয়ে সুখে আর কেউই নেই”।
মাহিবের কথাটা খুব ভালো লেগে গেলো অংশীর। খুব সুন্দর করে কথা বলে মাহিব। প্রত্যেকটা বাক্যই যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অংশী বিমোহিত হয়ে মাহিবের দিকে তাকিয়ে রইলো। ভরা চাঁদের আলোয় মাহিবের সৌন্দর্য দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। যতই দেখছে ততই মোহে পড়ে যাচ্ছে অংশী।
মাহিব বললো, “তুমি ঘুমাওনি কেন?”
“ঘুমাইছিলাম তো। ভাইঙা গ্যাছে”।
“আমার জন্যই ভেঙেছে। আমি একা একা দাঁড়িয়ে আছি তো তাই”।
“আসেন টংয়ের উপ্রে গিয়া বসি”।
অংশী দূরে গাছের নিচে টংয়ের উপরে গিয়ে বসলো। বেশ শীত শীত লাগছে। মাহিবের গায়ে একটা হাফ হাতা গেঞ্জি। লোকটার কি শীত করে না নাকি!
মাহিব এসে টংয়ের উপর বসতেই অংশী জিজ্ঞেস করলো, “আপনে সিগ্রেট খান ক্যান?”
মাহিব হেসে বললো, “অভ্যাস”।
“এইটা খাওয়ান ভালা না। আমার আব্বাও খায়। আব্বারে মানা করলেও শোনে না”।
“আমিও শুনবো না”।
“আমি আপনারে মানা করমু ও না। যত ইচ্ছা খান আর তারাতাড়ি মইরা যান”।
“হা হা, সিগারেট খেলে মানুষ তারাতাড়ি মরে এই তথ্য কে দিয়েছে তোমাকে?”
“শুনছি”।
মাহিব কোনো উত্তর না দিয়ে আবার সিগারেটে টান দিলো। কি অদ্ভুত একটা লোক! একটা মেয়ে সামনে বসে আছে তাও নির্লজ্জের মত সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। অংশী মাথাটা দুদিকে নাড়ালো। এখন রীতিমতো বেশি ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। কিন্তু উঠে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না অংশীর। ও বললো, “আইজ খুব ঠান্ডা পরছে”।
“হুম। শীত করে না তোমার? যাও একটা শোয়েটার গায়ে দিয়ে আসো”।
“আপনে লোকটা অতটাও খারাপ না, ভালোই”।
হেসে একটা ছুট দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো অংশী। মাহিব হাসতে লাগলো, পাগলী মেয়ে একটা।
অংশীর স্বভাবে দূরন্তপনা সব’চে বেশি৷ মেয়েটা সারাক্ষণ ছোটাছুটি করবে। যেখানেই যাবে দৌড় দিয়ে যাবে। আর চঞ্চলও ভীষণ। মাঝেমাঝে গম্ভীর হয়ে যায়। তখন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আকাশ দেখে।
অংশী কম্বল গায়ে জড়িয়ে এসে টংয়ের উপর বসলো। মাহিব অবাক হয়ে বললো, “একি! কম্বল গায়ে দিয়েছো কেন?”
“আমার ছোইটার ছিইড়া গ্যাছে। আর ওইটা গায়ে দেওন যাইবো না”।
মাহিব চুপচাপ শুনলো। অংশী বললো, “আপনের বিড়ি খাওন শ্যাষ?”
“হুম শেষ। চারিদিক কত নিস্তব্ধ তাই না অংশী?”
অংশী মনেমনে বললো, “কাম সারছে। এখন আবার কবিতা শুরু করে দেবে”। কিন্তু চারিদিক আসলেই অনেক বেশি স্তব্ধ। কোথাও বিন্দুমাত্র সারাশব্দ নেই। এতটাই স্তব্ধ যে দূরের জংগল থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। দুজনে টংয়ের উপর বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। একজনের গায়ে কম্বল।
মাহিব বললো, “তোমার বাবা মা কেউ এত রাতে এখানে বসে থাকতে দেখলে তোমাকে বকাঝকা করবে। তুমি বরং রুমে যাও”।
“যাইতে মন চাইতেছে না”।
“কেন?”
“কি জানি!”
অংশীর এই “কি জানি” উত্তরে কি যে মিশে ছিলো। মাহিব কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে বললো, “না। দিনের বেলা বসে থাকা আর রাতের বেলা বসে থাকা এক না। যাও রুমে যাও”।
“যাইতেই হইবো? রাত্তিরে আব্বা আম্মা কারো ঘুম ভাঙে না”।
“না ভাংলেও যাও। সবকিছু বুঝতে শেখো, তুমি এখন বড় হয়েছো”।
অংশীর মন খারাপ হয়ে গেলো। মাহিবের সঙ্গ ছেড়ে উঠে যাওয়ার ইচ্ছে একেবারেই করছে না সেটা কি মাহিব বুঝতে পারছে না? তবুও জোর করে ঘরে পাঠাতে চাইছে। অংশী উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনে ভালা না। একটুও ভালা না”।
অংশীর অভিমানে হাসি পেলো মাহিবের। ও অংশীর গাল টেনে দিয়ে বললো, “পাগলী একটা”।
ঝনঝন করে উঠলো অংশীর শরীর। ও আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলো না। একটা দৌড় দিয়ে সোজা ঘরের ভিতর চলে গেলো।
৬
আজ সকালের দিকে একদল লোকজন চলে এলো অংশীদের বাড়িতে। সব মাহিবের টিমের লোক। অংশী এদের মধ্যে নায়ক নায়িকাকে খুঁজছে কিন্তু কাউকেই নায়ক মনে হচ্ছে না। কোনো মেয়েও আসে নি। অংশী দূরে দাঁড়িয়ে মানুষ গুলোকে দেখছিলো। সবাই মিলে এক গাদা জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। সেসব টানাটানি করছিলো। দুপুরেই মিস্ত্রি চলে এলো বাড়িতে। উঠানে বিশাল আকারের একটা ছনের ঘর তৈরি করা হলো। অংশী দূরে দাঁড়িয়েই দেখছিলো সেসব। মাহিব আজ ভীষণ ব্যস্ত। একবার অংশীর দিকে তাকানোর সময়ও পায় নি। অংশী খেয়াল করছে আর ভাবছে, নায়ক নাইকা কই?
ঘরের কাজ শেষ হলো বিকেলে। একটা বিশাল আকারের সোলার প্যানেল ও নিয়ে আসা হয়েছে। আশেপাশের বাড়ির লোকজন আর কিছু আদিবাসী এসব কর্মকাণ্ড দেখতে এসে দাঁড়িয়ে আছে। মাহিব ছবি তুলছে আদিবাসী বাচ্চা কাচ্চাদের।
সন্ধ্যায় ঝলমল করে আলো জ্বলে উঠলো উঠোনে। অংশী ছুটে এলো দেখতে। বাইরে অসংখ্য লাইট জ্বলছে, ঘরটাকে এখন আকর্ষণীয় লাগছে অনেক। কৌতুহল বশত ঘরের ভিতরের দিকে উঁকি দিলো অংশী। মাহিব দেখতে পেয়ে বললো, “আরে অংশী, আসো ভিতরে আসো”।
অংশী মনেমনে বললো, “তাও ভালো আমারে চিনতে পারছেন”।
ভিতরে ঢুকেই চোখ ধাঁধিয়ে গেলো ওর। ছনের ঘরের ভিতরে পার্টিশন দিয়ে চারটা রুম আলাদা করা হয়েছে। মেঝেতে বিছানো হয়েছে রঙিন প্লাস্টিক, তার উপর ঘাসের গালিচা। মাহিবের ঘরে ঢুকে আরো অবাক অংশী! দেয়ালে সবুজ স্টিকার লাগানো, স্টিকারের উপরে ফুলের ছবি আঁকা, প্রজাপতির স্টিকার। ছোট একটা টেবিলের উপর ল্যাপটপ, একদিকে ফুলদানি। মেঝেতে সুন্দর কার্পেট বিছানো হয়েছে। তারই এক কোণায় একটা জাজিম বিছিয়ে বিছানা বানানো হয়েছে। অংশী মুগ্ধ! এই ছন আর বাঁশের ঘরের ভিতরেও এত সুন্দর করে সাজানো যায় ভাবতেই পারে নি অংশী!
মাহিব বললো, “কেমন লাগছে আমার ঘরবাড়ি?”
অংশী মুগ্ধতার চোটে কথাই বলতে পারলো না। মাহিব বললো, “আমার টিম এগুলো ঢাকা থেকে এনেছে। আনতে একটু কষ্ট হলেও পুরো কাজের সময়টা যেন আরামে থাকতে পারি”।
অংশী এখনো নির্বাক। মুখে কোনো কথা ফুটছে না ওর। কাছে এগিয়ে গিয়ে একটা লাইটে হাত দিয়ে আবার ভয়ে ভয়ে সরিয়ে নিলো। মাহিব হেসে বললো, “এগুলো জেনারেটর দিয়ে জ্বলছে। জংগলের ভিতরে জেনারেটর বসানো হয়েছে”।
জেনারেটর কি সেটা না বুঝলেও আলোয় চারিদিক ঝলমল করার কারণ যে এটাই সেটা বুঝতে পেরেছে অংশী। ও মুগ্ধ হয়ে শুধু এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মাহিব বললো, “বসো। কফি খাও”।
মাহিব টেবিলের উপর থেকে ফ্লাক্স নিয়ে এক মগ কফি ঢেলে অংশীর দিকে এগিয়ে দিলো। অংশী এর আগে কখনো কফি খায় নি। গরম গরম মুখে দিয়ে মুখ বিকৃত করে ফেললো। মাহিব বললো, ‘আস্তে। একটু পরে খাও”।
তারপর নিজেও একটা মগে কফি ঢেলে নিলো। এমন সময় একটা সুদর্শন যুবক মাহিবের দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, “ভাইয়া আসবো?”
অংশী ফিরে তাকালো ছেলেটার দিকে। ছেলেটা অংশীর চোখে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো। এমন স্নিগ্ধ মায়াবী চেহারা বহুদিন দেখেনি সে। চোখে যেন অজস্র কাব্য রটে। কে এই মেয়ে!
চলবে..