তৃষ্ণা ” পর্ব-৭

0
1210

তৃষ্ণা
পর্ব ৭
মিশু মনি
.
ছেলেটার নাম প্রীতম। লম্বা, কোঁকড়ানো চুল, সবমিলিয়ে বেশ সুদর্শন। অংশীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে ঘরে ঢুকতেই ভুলে গেছে। অংশী ভেবেছে এই বুঝি সিনেমার নায়ক। ও নিজেও ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে আছে।

মাহিব বললো, ‘তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন প্রীতম? ভেতরে আসো।’

চমকে উঠে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে উষ্ঠা খেয়ে পড়লো প্রীতম। অংশী পাখির মত উড়ে এসে প্রীতমকে তোলার চেষ্টা করে বললো, ‘আরে ব্যথা পাইছেন?’
প্রীতম দাঁত বের করে বললো, ‘নাহ পাইনি। আপনাকে ধন্যবাদ ম্যাম।’

অংশী প্রীতমের হাত ছেড়ে দিয়ে মাহিবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাহিব প্রীতমকে বসতে বললে প্রীতম অংশীর বসার জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। দাঁড়িয়ে রইলো অংশী। মাহিব প্রীতমকে বললো, ‘তারপর বলো? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’
‘না। রাস্তাটা এত্ত সুন্দর ভাইয়া। আমি দারুণ এনজয় করেছি, অসম্ভব সুন্দর।’

তারপর মাহিবের কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘মেয়েটাও কিন্তু দারুণ সুন্দর।’

মাহিব হাসতে হাসতে বললো, ‘এসেই শুরু করে দিলি তোরা? মানুষ হবি না? ফাজিল।’

প্রীতম বললো, ‘কো আর্টিস্ট, মেহেদী ভাই সবাই কালকেই এসে হাজির হবে। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা, থাকা খাওয়া কষ্ট। সাথে হাগারও কষ্ট। সবাই চেষ্টা করবো খুব দ্রুত কাজ শেষ করার।’

মাহিব প্রীতমের পিঠে একটা কিল বসিয়ে বললো, ‘তোদের জন্য স্পেশাল বাথরুম বসিয়েছি ভাই। ডোন্ট বি ওরিড।’
– ‘মেয়েটা কে ভাইয়া?’
– ‘এটা ওদেরই বাসা। আমির আলীর মেয়ে অংশী।’
– ‘অংশী, বংশী। বাহ, কিউট নাম তো। হাই অংশী, আমি প্রীতম।’

অংশীর দিকে তাকিয়ে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা চালালো প্রীতম। অংশী সংকুচিত হয়ে গেলো। মাহিব বললো, ‘আরে তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন মেয়ে? বসো। এ হচ্ছে প্রীতম, আমাদের টিমেরই একজন মেম্বার। এরা সবাই আমারই ভাই ব্রাদার, তুমি একদম আনইজি ফিল করবা না বুঝছো?’

অংশী মাথা নাড়ালো যেন সব বুঝেছে। তারপর বললো, ‘আমি এখন যাই?’
‘দাঁড়াও, আমিও বাইরে যাবো একটু।’

প্রীতমকে ভেতরে রেখে অংশীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মাহিব। বাসার সামনে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে বাজারের দিকে। রাস্তার দুধারে গাছপালা ও জংগল। মাহিব হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘আসো অংশী।’

অংশী এতক্ষণে স্বাভাবিক হলো। মাহিবকে একান্তভাবে পেলে নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনেহয় ওর। মাহিবের কাছাকাছি হাঁটছে আর নানান কথা ভাবছে অংশী। কিভাবে সিনেমা হয়, কিভাবে শুটিং হয়, নায়ক নায়িকা কেমন হবে, সবকিছু ভেবে উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগলো।

মাহিব বললো, ‘তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে আমার বুঝেছো? উনি তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবেন।’
-‘স্কুলে ভর্তি হইয়া কি করুম আবার?’
– ‘সরি, কলেজে। আমরা থাকা অবস্থায়ই ভর্তি করিয়ে দিয়ে যাবো। নিয়মিত ক্লাস করবে, ঠিকমতো পড়াশোনা শিখবে। মনে থাকবে?’

মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক উত্তর জানালো অংশী। রাত নেমেছে ইতিমধ্যেই। ঝিঁঝি পোকার ডাকে চারিদিক মুখর হয়ে আছে। রাস্তায় ঘন অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছে অংশী ও মাহিব। দুজনে খুবই কাছাকাছি, মাঝখানে এক হাত দূরত্ব। মাহিব এতক্ষণ ফোন চাপছিলো আর হাঁটছিলো। এবার ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললো, ‘শহরে গিয়েছিলে কখনো? ‘
– ‘চিটাগাং গেছিলাম মেলা আগে। মনেই নাই কিছু।’
– ‘ঢাকায় যাওনি কখনো?’
– ‘নাহ।’
– ‘আচ্ছা আমরা চলে গেলে একবার তোমার বাবার সাথে যেও কেমন?’
– ‘সত্য! আমি ঢাকা শহর দেখমু! কি যে আনন্দ হইতাছে শুইন্যা!’

মাহিব হেসে বললো, ‘হ্যাঁ সত্যি সত্যি দেখবে। তোমার সাজতে কেমন লাগে অংশী?’
অংশীর বুঝতে সময় লাগলো মাহিব ঠিক কি বোঝাতে চাইছে। মাহিব আরেকবার বুঝিয়ে দেয়ার পর ও বললো, ‘ভালো লাগে। চোখে কাজল দিলে আমার নিজেরে দেখতে কি যে ভালো লাগে!’

মাহিব হেসে বললো, ‘পাগলী। পরশুদিন নায়িকা চলে আসবে। ওকে যখন সাজাবে তখন দেখে নিও কিভাবে সাজতে হয়।’
-‘নাইকা আপা কি মেলা সুন্দরী?’
-‘তোমার মত নয়।’
-‘মানে?’

বিষম খেলো মাহিব। হুট করে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে কথাটা। ও হাসির ছলে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আরে দুষ্টুমি করে বললাম। তুমি কি বাজারে যাবা?’
-‘না। আব্বায় রাগ করবো।’
– আচ্ছা তবে তুমি বাড়ি যাও, আমার বাজারে কিছু কাজ আছে।’

অংশীকে বিদায় দিয়ে বাজারের দিকে পথ ধরলো মাহিব। পথটা যেন রাতের অন্ধকারে আরো বেশি রহস্যময় হয়ে উঠেছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অংশীর মনে আনন্দের জোয়ার বইছিলো। এ আনন্দের উৎস কি নিজেও জানেনা অংশী। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে, মাহিব আসার পর থেকে সবকিছুই ভালো লাগে অংশীর। সারাক্ষণ মনে এক ধরণের আনন্দ খেলা করে। পাহাড়, নদী, অরণ্য, সবকিছুকে রঙিন মনে হয়। আহা কি সুখ বইছে হৃদয় জুরে!


রাতে তারাতারি ঘুমিয়ে পড়েছিলো অংশী। আজকে মাহিব ও তার দল নিজেরাই রান্নার ব্যবস্থা করেছে, ওদের সংসার এখন আলাদা। অংশী ঘুমের ঘোরে হাবিজাবি স্বপ্নের জাল বুনছিলো, এমন সময় ওর বাবা ঘুম ভাঙিয়ে দিলো।

কূপির আলোয় অংশী দেখলো মাহিব দাঁড়িয়ে। ও চোখ কচলে আবার তাকালো। তারপর উঠে বসলো বিছানার উপর।
মাহিব হেসে বললো, ‘কি গো রাজকুমারী, ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?’
– ‘হু।’
আমির আলী বললেন, ‘মা দ্যাখো সাহেব তোমার জন্য কি নিয়া আসছে।’

একটা লাল রঙের প্যাকেট এগিয়ে দিলো মাহিব। অংশী প্যাকেট খুলতেই একটা নীল শোয়েটার কূপির আলোয় ঝিকমিক করে উঠলো। খুশিতে চকচক করে উঠলো অংশীর চোখ। ও চোখেমুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে বললো, ‘এইটা আমার জন্যে!’

মাহিব মুচকি হাসলো। অংশীর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো খুশিতে চোখে জল চলে এসেছে। অন্ধকারে সে জল লুকাতে চাইছে অংশী। মাহিব আর বেশিক্ষণ থাকতে চাইলো না। অংশীকে এখন একা এই আনন্দ উপভোগ করতে দেয়া উচিৎ।

মাহিব বেরিয়ে যাওয়ার পর বাবাও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মাহিব শোয়েটার এনেছে এটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না অংশীর। অনেক্ষণ বিছানার উপর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ও। মাহিবকে কিছু না বলে মোটেও ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। মাহিবের সাথে দেখা করতে হবে।

বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে পা টিপে টিপে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো অংশী। উঠোনে এসে দেখলো এখনো শোরগোল চলছে ছনের ঘরটিতে। আলোয় চারিদিক জ্বলজ্বল করছে আর মাহিব ও কয়েকজন ছেলে টংয়ের উপর বসে সিগারেট ফুঁকছে।

দূর থেকে অংশীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো প্রীতম। এই মেয়েটাকে দেখলেই মনের ভেতর একটা অচেনা বাজনা বাজতে থাকে। বিধাতা অপরূপ সৌন্দর্যে সৃষ্টি করেছেন এই মেয়েকে। ছিমছাম গড়নে টানা টানা ভ্রু, কাজল রাঙা দুটো আঁখি। দেখলে আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। প্রীতমকে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে মাহিব ওর দৃষ্টি বরাবর তাকালো। মাহিবের সাথে চোখাচোখি হতেই হাত ইশারা করে কাছে ডাকলো অংশী। হাতের সিগারেট টা আরেকজনকে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মাহিব।

অংশীর মুখে হাসি লেগে আছে। মাহিব এই প্রথম ওকে এত আনন্দিত দেখছে। কাছে যেতেই অংশীর ইচ্ছে করলো মাহিবকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিতে। কিন্তু সেটা করতে পারলো না। ও রীতিমতো লাফালাফি শুরু করে দিলো। মাহিব হেসে ফেললো ওর কান্ড দেখে।
অংশী বললো, ‘এত্ত সুন্দর একখান ছুইটার আমার জন্যে! ক্যান আনলেন?’
– ‘ক্যান তুমি ঠান্ডায় খালি গায়ে থাকো?’
– ‘ছিহ, আমি কখন খালি গায়ে থাকছি আপনের সামনে?’

কথাটা বলেই অংশী লজ্জায় পড়ে গেলো। এত লজ্জায় যে, একেবারে মিইয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু দৃষ্টি নামাতে পারলো না। মাহিব এমনভাবে অংশীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো যে অংশী খেই হারিয়ে ফেললো। এ চোখ থেকে চোখ সরানোটাই রীতিমতো একটা যুদ্ধ। অংশী মাহিবের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। মাহিবের ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি। ও অংশীর কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো, ‘তা দেখিনি। তবে ভেজা শরীরে তোমাকে কিন্তু অপূর্ব লাগে।’

শিউরে উঠলো অংশী। কি বলে এই লোকটা! লাজ লজ্জার বিন্দুমাত্র বালাই পর্যন্ত নেই দেখছি। অংশী দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো।

মাহিব বললো, ‘যাও রুমে যাও এখন। ছেলেপেলেরা মাইন্ড করবে।’

অংশীকে রেখে আবার টংয়ের দিকে হাঁটা ধরলো মাহিব। কিন্তু অংশী না নড়তে পারে, না চলতে পারে। স্থির হয়ে বিদ্যুতের খুঁটির মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে। একটুও লজ্জা নেই ওনার, একটুও না। ছুটে ঘরে চলে গেলো অংশী। ওর ছুটে যাওয়া দেখে মুচকি হাসলো মাহিব।


আজ সারাদিন অংশী ঘর থেকে বের হয় নি। দুপুরে মা আয়না বুলবুলকে পানি দিতে বলেছিলো, অংশী তাও দেয় নি। মিস্ত্রিরা অংশীদের গোসলখানাটাও ভালোমতো টিন দিয়ে ঘিরে দিয়েছে, একটা দরজাও বানিয়ে দিয়েছে। অংশী গোসলখানা দেখতেও বের হয় নি।
রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলো শুধু। এভাবে একটা দিন কেটে গেলো কিন্তু মাহিবের সামনে যায় নি অংশী।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here