তৃষ্ণা ” পর্ব-৮

0
1204

তৃষ্ণা
পর্ব ৮
মিশু মনি
.
মাহিবকে দেখে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো অংশী। কিন্তু মাহিব জোরে গলায় বললো, ‘এই অংশী, দাঁড়াও।’
মাহিবের ডাক উপেক্ষা করতে পারলো না অংশী। ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাহিব নদীর তীরে ভেজা বালিতে খালি পায়ে হাঁটছে। এই কুয়াশাভেজা সকালে খালি পায়ে হাঁটার কারণ বুঝতে পারছে না অংশী। মাহিব কাছে এসে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছিলে?’
– ‘ঘরে। আপনে খালি পায় হাঁটতেছেন ক্যান? শীত লাগবো না?’
– ‘তোমাকে শোয়েটারে দারুণ মানিয়েছে।’
– ‘আমি কই কি, আমার সারিন্দা কয় কি?’
– ‘খালি পায়ে হাঁটতে ভালো লাগছে মেয়ে। তাই হাঁটছি। দুপুর পর্যন্ত আমি ফ্রি আছি। ঘুরতে নিয়ে যাবা?’
– ‘কই যাইবেন?’
– ‘পাহাড়ে কিংবা অরণ্যে যেখানে তোমার ইচ্ছে হয়।’
অংশী খানিকক্ষণ ভাবলো। তারপর বললো, ‘আচ্ছা চলেন।’
মাহিব অংশীর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘তুমি কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে আছো?’
– ‘না তো।’
– ‘কেউ রাগ করলে আমি বুঝতে পারি।’
– ‘আপনের উপ্রে রাগ করোনের বুজি মেলা মানুষ?’
মাহিব অংশীর দিকে অবাক হয়ে তাকালো। হঠাৎ বড়দের মত কথা বলছে অংশী। ও হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘আরে নাহ। কিন্তু আপনজন তো আছে ই তাই না। তারা যখন রাগ করে আমি টের পাই।’
– ‘আমি কি আপনের আপনজন?’
মাহিব এই প্রশ্নের উত্তরে ধাঁধায় পড়ে গেলো। আবারও অবাক হয়ে তাকালো অংশীর দিকে। চোখের পলক ফেলতে পারলো না মাহিব। অংশী বললো, ‘এমন কইরা তাকায়া আছেন ক্যান?’
মাহিব দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললো, ‘তুমি অনেক চালাক।’
অংশী ফিক করে হেসে ফেললো। অংশীর খুব প্রিয় একটা জায়গা আছে বনে। খুব মন খারাপ থাকলে কিংবা খুব মন ভালো থাকলে অংশী সেখানে গিয়ে বসে থাকে। আজকে মাহিবকে সেখানে নিয়ে যাবে ও। নালার উপরে হাঁটুপানি পেরিয়ে যেতে হবে। অংশী নালার কাছে এসে পায়জামা টেনে হাঁটু পর্যন্ত তুলে ফেললো। খানিক্ষণ ড্যাবড্যাব করে অংশীর পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো মাহিব।
নালা পেরিয়ে এসে অংশী পায়জামা নিচে নামিয়ে দিচ্ছিলো এমন সময় মাহিব বাঁধা দিয়ে বললো, ‘উহু নামিয়ো না, থাক না এরকমই।’
অংশী ফ্যালফ্যাল করে মাহিবের দিকে তাকালো, ‘ক্যান?’
– ‘দেখতে ভালো লাগছে।’
লজ্জায় ডুবে গেলো অংশী। কোথায় মুখ লুকোবে ভেবেই পাচ্ছে না। ও তারাহুরো করে নিচু হয়ে পায়াজামা নামিয়ে দিতে লাগলো। মাহিব কাছে এসে অংশীর হাত টেনে ধরে বললো, ‘বললাম না নামিয়ো না। কথা শুনছো না কেন?’
অংশী লাজুক চোখে মাহিবের দিকে তাকালো। মাহিব আশেপাশে তাকিয়ে একটা দূর্বাঘাস ছিড়তে বসে গেলো। থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো অংশী। মাহিব দূর্বাঘাস পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একটা গোল রিং বানিয়ে অংশীর পায়ে পড়িয়ে দেয়ার জন্য এগিয়ে এলো। অংশী নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো শুধু। মাহিব অংশীর পা নিজের হাঁটুর উপর তুলে খুব যত্নে পায়ে দূর্বাঘাসের নূপুর পরিয়ে দিলো। পা কাঁপতে শুরু করেছে অংশীর। নিশ্বাস ঘন হতে আরম্ভ করেছে।
মাহিব দাঁড়ানো মাত্রই আচমকা মাহিবকে জাপটে ধরলো অংশী। মাহিবের জ্যাকেটের বুকের অংশটায় একহাতে খামচে ধরে রইলো। মাহিব মৃদু হেসে অংশীকে বুকের সাথে টেনে নিলো। অংশী কাঁপতে কাঁপতে হাতের বাঁধন শক্ত করে খুব জোরে টেনে ধরে রইলো মাহিবের জ্যাকেট।
মাহিব বললো, ‘কি হলো?’
অংশী কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘আপনে আমারে রাইতে ঘুমাইতে দেন না ক্যান?’
– ‘আমি!’
– ‘হু আপনে। চক্ষু বন্ধ করলেই আপনারে দেখি। ঘরে থাকতে পারি না ক্যান? বাইরে বাইর হইলেও দেখি আপনে খাড়ায়া আছেন। আমারে এমন জ্বালাতনে ফেলছেন ক্যান কন তো?’
মাহিব মুচকি হাসলো। অংশী মাহিবের বুকের ঠিক মাঝ বরাবর নিজের নাক ঘষে বললো, ‘আপনের শরীল থাইকা একটা মিষ্টি সুগন্ধি বাইর হয়। আমার কেমন কেমন জানি লাগে!’
মাহিবের গলার স্বর আবেগঘন হয়ে উঠলো, ‘কেমন লাগে পরি?’
– ‘বুজি না। বুকের মধ্যে একটা বাজনা বাজে। কাইল সারাডা রাইত আমি দু চক্ষের পাতা এক করতে পারি নাই।’
– ‘আমি পেরেছি?’
– ‘আপনে পারেন নাই!’
অংশীর কণ্ঠে বিস্ময়! মাহিব অংশীর মুখখানা দুহাতে তুলে বললো, ‘আমিও পারি নি রে পরি। বারবার ইচ্ছে করে তোমার সাথে অজানায় হারিয়ে যাই। এমন কোথাও বেড়িয়ে পড়ি যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বারবার তোমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য মন আনচান করে।’
অংশী আবারও কেঁপে উঠলো। মাহিব শক্ত করে চেপে ধরলো ওকে। অংশী বললো, ‘এমন হইতেছে ক্যান?’
– ‘জানি না। বোধয় আমরা দুজন…’
– ‘দুইজন কি?’
– ‘ আমাদের মধ্যে বোধহয় কিছু একটা.. কিছু একটা…’
খপ করে মাহিবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো অংশী। লজ্জামাখা মুখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে ছুটে চললো গহীন বনের দিকে। মাহিব বারবার ডাকতে লাগলো অংশীর নাম ধরে। কিন্তু অংশী একবারও পিছন ফিরে তাকালো না। ছুটছে তো ছুটছে ই। মাহিবও অংশীর পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে গহীন জংগলের ভিতরে ঢুকে গেলো। অনেক্ষণ দৌড়ানোর পর হাফিয়ে গিয়ে অংশী একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। মাহিব কাছে এসে খপ করে অংশীর হাত ধরে ফেললো। তারপর বুকের কাছে হেচকা টান দিয়ে বললো, ‘পালাচ্ছিলি কোথায় ?’
– ‘আপনে কি আমারে পাগল কইরা দিবেন নাকি?’
– ‘তুমি তো সেটাই চাইছো।’
– ‘ছিহ, কি কন এইগুলান? আমি কখন চাইছি?’
– ‘তোমার চোখ তো তাই চাইছে।’
চমকে উঠলো অংশী। অন্য হাতে নিজের চোখ ঢেকে বললো, ‘আমার চোখ কিচ্ছু চায় নাই, কিচ্ছু না। আপনে আমারে ছাইড়া দেন। আমার কেমন জানি লাগতেছে।’
– ‘লাগুক। তোমার হাত ছাড়ছি না। ছাড়লেই শুধু ফুড়ুৎ করে উড়ে যাও।’
– ‘আপনেও আমার সাথে উড়বেন। উড়বার পারেন না?’
– ‘হাতে হাত রেখে উড়ি?’
অংশীর বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করে উঠলো। কোনোমতে মাহিবের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও পারলো না। মাহিব খুব শক্ত করে ধরে রইলো। অংশী লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলো।
মাহিব হাতটা আলগা করতেই অংশী হাত ছেড়ে আবার শুরু করলো দৌড়। মাহিব হাসতে লাগলো। এই মেয়ে বোধহয় ছুটতে ভীষণ ভালোবাসে। ও দৌড় প্রতিযোগিতায় সবসময় প্রথম হবে। হাসতে হাসতে মাহিবও অংশীকে তাড়া করলো।
অংশী এসে দাঁড়ালো একটা বৃত্তের মাঝখানে। চারিদিকে গাছ, মাঝখানে একটা গোল বৃত্তাংশের মত জায়গায় ফাঁকা অংশ। সেখানে একটা শুকনা গাছের গুড়ি মাটিতে পড়ে আছে। অংশী গিয়ে সেখানে চুপটি মেরে বসে আছে। মাহিব পাশে বসে হাফাতে হাফাতে বললো, ‘আজ আর ছুটোছুটি খেলতে চাই না।’
– ‘আচ্ছা আর দৌড়ামু না।’
কথাটা বলেই ফিক করে হেসে ফেললো অংশী। মাহিব হাসতে হাসতে আশেপাশে তাকালো। জায়গাটা ভীষণ আকৃষ্ট করেছে ওকে। মুগ্ধ হয়ে বললো, ‘বাহ! অদ্ভুত সুন্দর একটা জায়গা তো!’
– ‘হু। আমার পছন্দের একখান জায়গা এইটা। আমি মন খারাপ হইলেই এইখানে আইসা বইসা থাকি।’
– ‘তোমার আবার মন খারাপও হয়?’
– ‘বারে, হইবে না? আপনে চলে যাওয়ার পর কি যে কষ্ট হইতেছিলো। এইখানে আইসা বইসা ছিলাম।’
মাহিব বেশ অবাক হলো। অংশীর মুখটা দুহাতে ধরে বললো, ‘কি বলো অংশী! আমি চলে যাওয়ায় তোমার কষ্ট হয়েছে?’
অংশী হাসলো। লাজুক মুখে মাহিবের চোখের দিকে চেয়ে রইলো অনেক্ষণ। চোখে চোখে হাজারো রূপকথার গল্প জানাজানি হয়ে চলেছে যেন। মাহিব অংশীর চোখে ক্রমশ নিজেকে আবিষ্কার করছে একজন অন্যরকম মানুষ হিসেবে। যে মানুষটা নিষ্পাপ, অংশী তার প্রতি আস্তে আস্তে দূর্বল হতে শুরু করেছে। মাহিব বুঝেও বুঝতে চাইছে না। ও অংশীর মুখ ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো। মনেমনে ভাবলো, ‘অংশীর চোখে আমার জন্য গভীর মায়া দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এ তো কোনোদিনো সম্ভব না। তবে এখানেই কি সবকিছু থামিয়ে দেয়া উচিত?’
অংশী ছেলেমানুষী সুরে বললো, ‘এইবার কিন্তু আর যাইতে দিমু না। বাইন্ধা রাখমু বইলা রাখলাম।’
মাহিব সহজ হওয়ার জন্য হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু তবুও সহজ হতে পারছে না। অংশী মাহিবের হাত ধরলো অনায়াসে। যেন এই হাত ধরার একচ্ছত্র অধিকার ওকে দেয়া হয়েছে। মাহিব মাথা ঝেড়ে ভাবলো, ‘ধুর যা হবার হবে। এখন ওসব ভেবে এই সুন্দর মুহুর্ত টাকে নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।’
অংশী মাহিবের চোখের দিকে চাতক পাখির মত চেয়ে আছে। যেন মাহিবের কথা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে ওর চোখ মুখ। মাহিব বললো, ‘জায়গাটা সুন্দর। একটা শট এখানে করা যেতেই পারে। কি বলো?’
অংশী ব্যাপারটা না বুঝলেও বললো, ‘হু।’
মাহিবের গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অংশীর হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু লজ্জার কারণে নিজেকে সংযত করে নিলো অংশী। বললো, ‘এই জায়গায় একটা গান করলে খুব সুন্দর হইবো।’
– ‘হুম করবো ‘
– ‘আপনে আমারে আরেকবার পরি বইলা ডাক দিবেন?’
মাহিব অবাক হয়ে অংশীর দিকে তাকালো। হাসিহাসি মুখে বেশ নরম গলায় বললো, ‘পরি..’

অংশীদের ঘরের আশেপাশে উঁকি মেরে অংশীকে খোঁজার চেষ্টা করছে প্রীতম। মেয়েটাকে কাল সারাদিনে একবারও দেখা যায় নি। গেলো কোথায় সে?
প্রীতমের চোখ চাতকের মত অংশীকে খুঁজছে। যেন অংশীকে দেখার অনন্ত তৃষ্ণা ওর চোখে। একবার দর্শন করেই সে তৃষ্ণা মিটবে। কিন্তু কোথায় অংশী?
এমন সময় অংশী পিছন থেকে বললো, ‘কি খুঁজতাছেন?’
প্রীতম লাফিয়ে উঠে অংশীর দিকে তাকালো। অংশীকে দেখেই যেন মনের ভেতর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিলো, তা হঠাৎ করেই পূরণ হয়ে গেলো। ও হাসিমুখে বললো, ‘আরে তোমাকেই খুঁজছিলাম তো।’
অংশী অবাক হয়ে বললো, ‘আমারে! ক্যান?’
কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না প্রীতম। থতমত খেয়ে ভ্যাবলা কান্তের মত চেয়ে রইলো। অংশী ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘এইভাবে কি দেখতেছেন?’
– ‘না মানে একটা কথা বলার ছিলো তোমাকে।’
– ‘কি কথা কন?’
– ‘এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?’
– ‘এইডা আপনের কথা?’
প্রীতম আমতা আমতা করতে লাগলো। কি যে বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললো, ‘তুমি একটু সারাক্ষণ আমাদের ঘরের সামনে ঘোরাঘুরি করতে পারো না?’
কথাটা বলেই একটা ভোঁ দৌড় দিলো প্রীতম। দৌড়ে আড়াল হয়ে গেলো। অংশী কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষণেই আবার হেসে ফেললো। অংশীর মনে আজ আনন্দ, একটা অন্যরকম আনন্দ।
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here