তৃষ্ণা ” পর্ব-৯

0
1216

তৃষ্ণা
পর্ব ৯
মিশু মনি
.
পাশের চাকমা পাড়ায় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, সেখানে নাচ দেখার জন্য যেতে ইচ্ছে করছে অংশীর। কিন্তু রাত্রিবেলা মাকে বলারও সাহস পাচ্ছে না। চাকমা মেয়েরা যেরকম স্বাধীনতা পায়, বাঙালীরা তেমন পায় না। কেন এই নিষ্ঠুরতা বোঝে না অংশী। অবশ্য বাবা অনেক ভালো মনের মানুষ। বাবাকে একবার কথাটা বলতে হবে। কিন্তু এখনো বাসায় ফেরেননি উনি।

অংশী বাইরে এসে টংয়ের উপর বসলো। গায়ে মাহিবের দেয়া শোয়েটার। ও অপেক্ষা করছে বাবার জন্য। বাবা কখন যে আসবে?

এমন সময় মাহিব এসে পাশে বসলো। অংশী অকারণেই মুখ টিপে হাসলো। কেন জানি আজ খুব ফুরফুরে লাগছে। মাহিব বললো, ‘এই শীতে এখানে বসে আছো যে?’
– ‘আব্বার জন্যে। আব্বারে খুব দরকার।’
– ‘খুব দরকার?
– ‘হু। চাকমা পাড়ায় নাচ হইতেছে, নাচ দেইখবার যামু। আব্বা আসতেছে না। ওনারে না কইয়া যাইলে আম্মা আমারে কাইটা ফেলবো।’

মাহিব হাসতে হাসতে বললো, ‘কি যে বলো। আমি তোমার মাকে বলে পারমিশন নিচ্ছি দাঁড়াও।’

অংশীর মা শুরুতে আপত্তি জানালেও মাহিবের অনুরোধে আর না করতে পারলেন না। অনুমতি পেয়ে অংশী আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। চোখ পাকিয়ে তাকালেন মা। মাকে ভীষণ ভয় পায় অংশী। বাবার সাথে যতটা সহজ, মায়ের সাথে ওর ততটাই কঠিন সম্পর্ক। মা মানুষটা কেমন জানি। কথায় কথায় রেগে যান, মাঝেমাঝে রেগে গিয়ে অংশীকে মারধোর ও করেন। আজকে অনুমতি পেয়ে অংশীর কি যে আনন্দ হচ্ছে। তার উপর মাহিবও ওর সাথে যাবে শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলো অংশী। মা বলে দিলেন বাড়িতে যেন তারাতাড়ি ফেরা হয়।

যাওয়ার পথে অংশী একটা লাফ দিয়ে মাহিবের হাত ধরে বললো, ‘আপনে এত্ত ভালা ক্যান?’
অংশীর খুশিতে ভরা গলা শুনে মাহিব বললো, ‘তোমার সাথে থাকতে যে আমারও ভালো লাগে। তাই..’

অংশী লজ্জা পেয়ে মুখ সরিয়ে নিলো কিন্তু হাত ছাড়লো না। অন্ধকারে দুজনে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যেতে লাগলো। অংশীর মুহুর্তের জন্যও সংকোচ হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে এই হাত ধরার অধিকার কেবল ওরই। মাহিব অজান্তেই সেই অধিকার ওকে দিয়ে দিয়েছে।

পথে হাঁটতে হাঁটতে মাহিব অংশীকে আরো কাছে টেনে নিলো। দুজনের মনেই আজ আনন্দ, একটা অন্যরকম আনন্দ।

চাকমা পাড়ায় ঢুকে মাহিব অবাক। এই গ্রামে অংশী কখনো নিয়ে আসেনি ওকে। চারিদিক মশালের আলোয় আলোকিত। অসংখ্য লোকজন তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সেজেছে আর কিছু মেয়ে হাত ধরাধরি করে নাচছে। মাহিব দেখে অবাক হয়ে বললো, ‘বাহ! আমি জানতাম না এত সুন্দর একটা প্রোগ্রাম দেখতে পারবো।’

অংশী মাহিবকে দাঁড় করিয়ে রেখে একটা মেয়েকে খুঁজতে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর তিন চারটা চাকমা মেয়ে সহ হাসাহাসি করতে করতে ফিরে এলো। মাহিবকে দেখে তারা অবাক হয়ে বললো, ‘সিনেমার হিরো!’

তাদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেলো আবারও। একটা মেয়ে এসে মাহিবকে টেনে নিয়ে গেলো ঘরের দিকে। হাতে পিঠা ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘খান। আমরা অংশীরে লইয়া যাই।’

মাহিব জিজ্ঞেস করতে যাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তার সময় পেলো না। মুহুর্তেই দৌড়ে আড়াল হয়ে গেলো মেয়েগুলি। মাহিব চাকমা দের বানানো পিঠা খেতে খেতে মাচার উপর বসে রইলো। দূর থেকে দেখতে লাগলো মেয়েদের নাচ।

আচমকা খিলখিল হাসির কলকাকলী শুনে চমকে পিছন ফিরে তাকালো মাহিব। মশাল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে অংশী। অংশীর সাজ পুরোটাই বদলে গেছে। সেও চাকমাদের পিনন হাদি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে লাল টিপ, গায়ের লাল ব্লাউজ একেবারে মানিয়ে গেছে ওকে। গলায় পয়সার মালা দেখে মাহিব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অংশী মশাল হাতেই বসে পড়লো মাহিবের সামনে। বললো, ‘আমারে কেমন লাগতাছে?’

মাহিব মুগ্ধতার সুরেই বললো, ‘অসম্ভব সুন্দর! সত্যিই পরীর মত লাগছে অংশী।’
– ‘হি হি হি। আইসেন নাচ দেইখবেন।’
– ‘আমার তো এখন নাচ দেখতে ইচ্ছে করছে না। মন চাইছে শুধু তোমাকেই দেখি, মুগ্ধ নয়নে শুধু তাকিয়েই থাকি।’

অংশী আবারও খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়লো। হাসি থামিয়ে বললো, ‘আসেন তো।’
মাহিব দাঁড়িয়ে পড়লো। অংশী মাহিবের মুখের কাছে মুখ এনে পা উঁচু করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বললো, ‘আমারে আপনের মতন কইরা শুদ্ধ কথা কওন শিখাইবেন?’
– ‘হুম শেখাবো। আর কি শিখতে চাও বলো?’
– ‘হি হি হি, আর কি শিখাইতে চান?’
– ‘প্রেম?’

শিউরে উঠলো অংশী। মনের ভিতর আবারও সেই অন্যরকম বাজনা বাজতে শুরু করে দিয়েছে। ও পিছিয়ে এসে বললো, ‘কি কন এইগুলা!’
– ‘শিখবে নাকি?’
– ‘নাহ!’

মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো অংশী। মাহিব অংশীর এক হাত টেনে ধরে বললো, ‘লাজবরণ মুখে কন্যার রূপ যে উথলে ওঠে, আমার বুকের ভেতর সমুদ্রের নোনা জল ছলকে ওঠে। কাছে টেনে নাও হে প্রিয়, কাছে টেনে নাও। অমর করো আমায়।’

অংশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মাহিবের দিকে। মাহিব আবারও বললো, ‘দু চোখে স্বপ্নের বিষ নিয়ে বসে আছো। যতবার তাকাও আমার পানে, নিক্ষেপ করে দাও সেই বিষ। আমার সমস্ত শরীর জুরে সে বিষের ঝাঁঝ ছড়িয়ে পড়ে। আমি উন্মাদ হয়ে যাই, ব্যকুল হয়ে যাই।’

অংশী কাছে এগিয়ে এসে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো মাহিবের দিকে। মাহিব কবিতার ঘোরে ডুবে গেছে। বললো, ‘উন্মাদের চোখে বিষ ঢেলে কি তৃপ্তি পেয়েছো প্রিয়? যদি পেয়েই থাকো, তবে আমারেও তৃপ্ত করো। সব বিষ শুষে নাও, নিয়ে নাও, আমারে ধন্য করো।’

অংশী খেই হারিয়ে ফেলেছে। কেবলই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মাহিবের দিকে। বলার মত কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। মাহিব অংশীকে আরো কাছে টেনে নিতে নিতে বললো, ‘পরম সুখের উষ্ণ আবেশে মাতাল করিলো মোরে, এ চোখের বিষ শুষে নিয়ে লুট করো, লুট করো হে প্রিয়া।’

পিছনে কয়েকটা মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দ শুনে চমকে উঠে অংশীর হাত ছেড়ে দিলো মাহিব। তাকিয়ে দেখলো কয়েকটা চাকমা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর হাসছে। কেউ কেউ মুখে হাত দিয়ে খিলখিল শব্দে হাসছে। মাহিব হেসে বললো, ‘কি নাম তোমাদের?’

সবাই তাদের নাম শোনালো। মাহিব বললো, ‘তোমরাও নাচবে?’

একটা মেয়ে স্পষ্ট ভাষায় বললো, ‘আমরাও নাচবো। আপনি নাচবেন?’

খিলখিল শব্দে হেসে উঠলো বাকি মেয়েরা। অংশী দৌড়ে চাকমা মেয়েদের দলে ঢুকে গেলো। তারপর লাইন করে মেয়েরা চলে গেলো উঠোনের দিকে। যাওয়ার সময় অংশী বারবার তাকাচ্ছিলো মাহিবের দিকে। মাহিবের মুখে একটা অন্যরকম হাসি।

চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ হচ্ছে। মাহিব মুগ্ধ হয়ে দেখছে। অংশী এসে বসলো মাহিবের পাশে। বললো, ‘আপনের কেমন লাগতেছে?’
– ‘অসম্ভব, অসম্ভব সুন্দর। ভীষণ ভালো লাগছে অংশী। থ্যাংক ইউ সো মাচ।’
– ‘হি হি, পিঠা ক্যামন লাগছে খাইতে?’
– ‘হুম মজা ছিলো। তুমি নাচলে না?’
– ‘ধুর, আমি কি নাচবার পারি? ওরা সবাই আমার বান্ধুবি।’
– ‘তোমার বান্ধবীরাও খুব সুন্দর। পরীর মত।’

অভিমান হলো অংশীর। গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। মাহিবের সেদিকে খেয়াল নেই। কিন্তু অংশী কেবলই মনে মনে বলতে লাগলো, আমি ছাড়া আর কাউরে পরী কইবার পারবেন না আপনে। আমার রাগ লাগে।

রাত বাড়তে শুরু করলে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ওরা। পথে দুজনে খুব কাছাকাছি ঘেঁষে রইলো। অংশী পিনন হাদি পড়েই বাসায় ফিরছে। মাহিব গুণগুণ করে গান গাইছিলো। অংশী পথে একটাও কথা বলে নি।

বাসায় ফিরে অংশীকে মায়ের ভীষণ বকা শুনতে হলো। মা মাহিবের সামনে কিছু বলতে পারেন নি তাই বলে অংশীও সেখানে যাওয়ার জন্য লাফালাফি করবে এটা নিয়ে প্রচুর কথা শোনালেন অংশীকে। অংশী ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলো। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর, খুব অভিমান জমছে। ওর কান্নার শব্দ শুনে মায়ের বকুনি থেমে গেলো।

১০
আজ নায়ক চলে এসেছে। আশেপাশের এলাকার লোকজনরা জড়ো হয়েছে নায়ককে দেখার জন্য। সবার মাঝে অংশীকে খুঁজছে প্রীতমের চোখ। কিন্তু অংশীকে দেখতে পাচ্ছে না। ও ভাবছে, কোথায় গেলো অংশী? এই মেয়েটা ঘর থেকে বেরই হতে চায় না।

রাতে মায়ের বকা খেয়ে আজ আর ঘর থেকে বের হয়নি অংশী। দুপুরে গোসল করতে বের হয়েই চোখাচোখি হলো প্রীতমের সাথে। প্রীতম এতক্ষণ চাতক পাখির মত চেয়ে ছিলো অংশীকে দেখার জন্য। এক পলক দেখেই যেন বুকের ভেতর শান্তি অনুভব করলো। অংশীর মুখটা মলিন। ও অবাক হয়ে ইশারায় বললো, ‘কি?’

প্রীতম হেসে মাথাটা দুদিকে নেড়ে বোঝালো, ‘কিছু না।’

অংশী গোসলখানায় ঢুকে গেলো। গোসল করতে করতে মাথার উপরের গাছগুলোর দিকে বারবার তাকাচ্ছিলো অংশী। কোথাও আবার লোকটা বসে নেই তো? কিভাবে যে তাকায়!

প্রীতম ল্যাপটপ টিপছে আর আনমনে ভাবছে অংশীর কথা। মেয়েটা পুরোপুরি প্রাকৃতিক, সামান্য কৃত্তিমতা মেশানো নেই ওর মাঝে। কি যে অনন্য লাগে, তবে সত্যিই বোধহয় অংশীর প্রেমে পড়ে গেছে প্রীতম। কথাটা ভেবেই আপনমনে হাসলো ও।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here