তৃষ্ণা ” সূচনা পর্ব

0
5066

তৃষ্ণা
সূচনা পর্ব
মিশু মনি

১.
ঘুম ভাঙার পর জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখ গেলো পাহাড়ের উপর। কুয়াশার মত মেঘ উড়ে উড়ে আসছে। চোখ কচলে বিছানার উপর উঠে বসলো অংশী। আজকের সকালটা প্রতিদিনকার চেয়ে একটু বেশিই সুন্দর মনেহচ্ছে। পাখির কিচিরমিচির কানে আসছে, হিমশীতল হাওয়ায় খুব সতেজ লাগছে। বিছানা থেকে নেমে আগে ওড়না কোমরে বেঁধে নিলো। তারপর খালি পায়ে গুটি গুটি পা ফেলে বেড়িয়ে এলো বাঁশের দোচালা ঘরটা থেকে।

আয়না বুলবুল অনেকক্ষণ থেকে হাক পাড়ছে। ওদের দড়ি দুটোর বাঁধন খুলে হাতে নিয়ে বাইরে এসে আম গাছটার সাথে বেঁধে দিলো। আজকে বেলা হলে ওদের গোসল করিয়ে দিতে হবে। গা থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে। গতরাতে নিশ্চিয় প্রস্রাব করে তার উপর গড়াগড়ি খেয়ে শুয়ে ছিলো। ওদেরকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই অংশী’র। সামনের কোরবানীর ঈদে এই ভেড়া দুটোকে বেঁচে দিতে হবে। যত্ন আত্মির কমতি রাখলে তো ভালো দাম আসবে না।

বাড়ির পিছন দিক থেকে মায়ের ডাক কানে আসছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ভাতের হাড়ি নিয়ে বসে যেতে কার ভালো লাগে? মায়েরা এমনই। সারাক্ষণ শুধু কাজের জন্য বকর বকর করেই যাবে। রান্নাঘরে এসে হাড়িটা ধুয়ে কিছু চাল ও পানি ঢেলে দিয়ে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিলো অংশী। তারপর চেঁচিয়ে বললো, ‘ভাত বসাইছি, আগুন দেইখো।’

হাতের তালুতে খানিকটা ছাইয়ের মাজন নিয়ে মধ্যমা আঙুল দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে পাহাড়ের দিকে হাঁটা ধরলো। বাড়িতে কোনো পায়খানা নেই। বাড়ির পাশের জংগলে যেতে হয় কাজ সারার জন্য। বাবাকে বারবার বলেও একটা টয়লেট বসিয়ে নেয়ার সৌভাগ্য হয়নি অংশী’র। মুখটা বিকৃত করে এক জাবড়া থুথু ফেলে দিলো মাটিতে। বড়ই গাছটার নিচে গিয়ে দেখলো মাটিতে লাল সবুজ কত রঙের বড়ই পড়ে পড়ে আছে। এগুলো খাওয়ার কেউ নেই। শত শত বড়ই পঁচে মাটির সাথে মিশে গেছে। তার উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে জংগলে চলে গেলো মেয়েটা।

পাহাড়ের কোলে বড় হওয়া মেয়েটা অনেকটা পাখির মত। শান্ত অথচ দূরন্ত। এখনই চুপচাপ বসে চারদিকে মুগ্ধ নয়নে তাকাবে, এখনই আবার ফুরুৎ করে অন্যকোথাও চলে যাবে। মেয়েটার কথা বলার সাথী হচ্ছে পাহাড়, জংগলের গাছপালা, পাখি ও পোকামাকড়। এভাবেই দিন যায়, নতুন দিন আসে। একইভাবে কাটতে থাকে সুদূর পাহাড়ের একটা উচ্ছল বালিকার দিন।

২.
দুপুর গড়িয়ে এসেছে।

গোসলখানায় গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে অংশী গুনগুন সুরে গান তুলছিলো গলায়। হঠাৎ বাবার গলা শোনা গেলো। বাবার সাথে কেউ বোধহয় এসেছে, তার সাথে কথা বলছেন উনি। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে জাল দিয়ে গা ঘষতে লাগলো ও। হঠাৎ বাঁশের ভাঙা দরজাটা দিয়ে কেউ মাথা উঁকি দিলো। দরজার তুলনায় লোকটা এতটাই লম্বা যে দরজা তার বুক অব্দি ঠেকেছে। সে চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে অংশী’র দিকে। অংশী তখন গা ঘষা শেষ করে গায়ে পানি ঢালছিলো।

গোসলের সময় জামা খুলে একটা লম্বা ওড়না গায়ে শাড়ির মত পেঁচিয়ে গোসলের অভ্যেস অংশী’র। সদ্য তারুণ্যে পা রাখা মেয়েটার ধারালো শরীরে জলের প্রত্যেকটা বিন্দু যেন ঝরনার সৌন্দর্য প্রকাশ করছে। চুলগুলো বিস্তৃত হয়ে আছে কপালে, তার উপরে পানি পড়ে ভিজে কপালের সাথে লেপ্টে গেছে। যুবকের দৃষ্টি আটকে গেছে কিছুক্ষণের জন্য।

শাড়ি গায়ে পেঁচিয়ে সানন্দে বালিকার গায়ে পানি ঢালার দৃশ্য, শাড়ির সাথে আবার ব্লাউজ ও নেই। স্বচক্ষে এরকম দৃশ্য দেখার পর ক্ষণিকের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হলো মাহিব কে। নাক ও গাল বেয়ে টপটপ করে জলের বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ের উপর এমন মায়াময় রূপ দেখতে পাবে কল্পনাও করেনি মাহিব।

অংশী চোখ পিটপিট করছে যুবককে দেখে। এমন লম্বা, ফর্সামতন ছেলে সে খুব কমই দেখেছে। মোবাইলে বাবা যে নাটকগুলো ডাউনলোড করে আনে, তার নায়কের মতন দেখতে ছেলেটা। পুরুষ মানুষও এত সুন্দর হয় নাকি?

অংশী’র বাবার গলা শোনা গেলো। উনি মাহিব কে বললেন, ‘ওদিকে পানি তোলা আছে। হাত মুখ ধুয়ে নেন। দরজা কি লাগানো নাকি?’

মাহিব মুখটা ফিরিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কেউ বোধহয় গোসল করছে।’
– ‘কে গোসল করে? অংশী?’

অংশী গলা খাকিয়ে বললো, ‘হু।’
– ‘একটু তারাতারি গোসল কর মা। মেহমান আসছেন, উনি মুখ হাত ধোবেন।’

অংশী’র কোনো সারাশব্দ পাওয়া গেলো না। বাবা মাহিব কে নিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলেন। শক্ত তক্তার বিছানার উপর বসতে বসতে মাহিব কেবল অংশী’র স্নাত কপাল, গাল আর চোখের কথাই ভাবছিলো। স্নানের সময় নারীরা সত্যিই বর্ণনাতীত অপরূপা হয়ে ওঠে দেখছি!

অংশী’র বাবা মাহিবের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ জমাচ্ছিলেন। ব্যবসায়ীক আলাপ করতে গিয়ে মুহুর্তের জন্য অংশী’র কথা ভূলে গিয়েছিলো মাহিব। যখন বাবা অংশীর নাম ধরে ডাকলেন, তখন অংশীর স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে আরেকবার চমকে উঠলো । এখন মেয়েটা চুলে গামছা বেঁধে একটা কমলা রঙের কামিজ পড়েছে, বুকের উপর ‘ইউ’ আকারে ওড়না নিয়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে। অংশী’র সামনে এসে লজ্জায় মাথাই তুলতে পারছিলো না।

বাবা মেয়েকে বললেন, ‘উনি আমাদের মেহমান। ওনার আসার কথা ছিলো আরো কয়টাদিন পর। হঠাৎ চলে আসছেন। তোর আম্মু কই গ্যাছে? ওরে ডাক আর আমি একটু আসতেছি। ওনাকে মুখ হাত ধোয়ার পানি দেও।’

অংশী’র বাবা উঠে বাইরে চলে গেলেন। মেহমানের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে। শহরের মেহমান, খাতির যত্নে কমতি রাখলে চলবে না।

অংশী মাহিব কে গোসলখানা দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘এইগুলান বৃষ্টির পানি আর এইগুলান নদীর পানি। আপনার যেইটা খুশি সেইটা দিয়া মুখ হাত ধুইবেন।’

লাজুক স্বরে মেয়েটার বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে মুচকি হাসলো মাহিব। বয়স আর কতই বা হবে? বড়জোর সতের/আঠারো। তখনকার ঘটনার পর থেকে নিশ্চয়ই আর স্বাভাবিক হতে পারছে না। লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে। বালতি থেকে বৃষ্টির পানি তুলে হাতমুখ ধুয়ে নিলো মাহিব। তারমানে এখানে টিউবওয়েল নেই। বিশাল বড় ড্রামে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা হয়েছে।

অংশী’র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এতগুলো বৃষ্টির পানিগুলো জমিয়েছে কিভাবে?’

অংশী লাজুক স্বরে অন্যদিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো, ‘চালের উপর থিকা পাইপে কইরা আইসা এই ড্রামে জমায়েত হয়।’

মাহিব চালের উপরের দিকে তাকালো। বাঁশ ও ছনের উপর নীল রঙের প্লাস্টিক চোখে পড়ছে। চালের নিচে পাইপ লাগানো। সব পানি পাইপ দিয়ে এসে এই ড্রামে জমা হয়। বাহ! দারুণ তো।

আবার অংশীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘খাবার পানি পাও কোথায়? বাসায় টিউবওয়েল নেই?’
– ‘কয়টা বাড়ি মিলে একটা আছে। ওইখান থিকা কলসিতে পানি আনতে হয়। আর এই পানি দিয়াই সব কাজ সারতে হয়।’
– ‘ওহ আচ্ছা। আমার একটু ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার ছিলো।’

লজ্জা পেয়ে গেলো অংশী। সামান্য একটা টয়লেট ই নেই এ বাড়িতে। এখন এই শহুরে মেহমানকে কি বলবে সে? লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে ফেললো। কান্না করতে ইচ্ছে করছিলো ওর। বাবাকে কতবার বলেছিলো একটা টয়লেট বসাতে। কিছুতেই গুরুত্ব দেয়নি। এখন কেমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হলো সেটা কি উনি বুঝবেন?

মাহিব ভাবলো মেয়েটা বোধহয় ওয়াশরুম শব্দটা জানেনা। ও বললো, ‘আমি বলছিলাম টয়লেটের কথা।’

আবারও লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করলো অংশী’র। মাথা থেকে গামছা খুলে মাহিবের দিকে এগিয়ে দিলো। মাহিব ভাবলো মেয়েটা নিশ্চয়ই এখনো বোঝেনি টয়লেট কি? তাই লাজলজ্জা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললো, ‘আমি পায়খানায় যাবো। হাগু করতে হবে।’
– ‘আমরা গরীব মানুষ। আমাদের বাড়িতে টয়লেট থাকেনা।’

কথাটা বলেই একটা দৌড় দিয়ে ভেতর ঘরের দিকে চলে গেলো অংশী। থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাহিব। বেশ বুঝতে পারছে মেয়েটি এখন কাঁদছে। কতটা কান্নাভেজা মায়াবী গলায় সে বললো, ‘আমরা গরীব মানুষ…’

বড্ড খারাপ লাগছে ওর। ভেজা গামছা নিয়ে হাত মুছতে মুছতে ভাবলো, ‘একটা ওয়াশরুম ই বসিয়ে দিবো এখানে।’

মুখ মুছতে গিয়ে চুলের অন্যরকম একটা গন্ধ ভেতরে ঢুকতেই কেঁপে উঠলো মাহিব। মেয়েদের ভেজা চুলের গন্ধ আরো বেশি ধারালো দেখছি, ভেতরটা ছিঁড়ে আরো গভীরে চলে যায়!


অংশী ছুটতে ছুটতে বাড়ির পাশের জংগলের ভেতর এসে ঢুকলো। মনটা বড্ড খারাপ লাগছে। এভাবে লজ্জায় পড়তে হবে ঠিক জানতো ও। এইবার যদি বাবার একটা শিক্ষা হয়। কিন্তু মেহমানটা আবার কে? আগে কখনোই তো ওনার কথা বাবার মুখে শোনা যায়নি!

মেহমানের নাম মাহিব আহসান। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ফিল্ম ও নাটক ডিরেক্টর। একটা নাটকের বেশকিছু অংশের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী পাহাড়ে শুট করতে হবে। লোকেশন খুঁজতে এসেছে আজকে। সবসময় লোকেশন খুঁজতে কাউকে সাথে নিয়ে যায়। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা অন্যরকম ছিলো। বড় ভাইয়ের পুলিশি কাজের জন্য এই এলাকায় আসা দরকার ছিলো। এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্য এই সুযোগেই লোকেশন দেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাহিব। স্থানীয় লোক আমির আলীর সাথে এক লোকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিলো। তাকে ফোন করে তারই সাহায্যে আজকে এখানে আসা। আমির আলীর বড় মেয়ে অংশী। কে জানতো মেয়েটা ঘরের পিছন দিকের ওই জায়গাটায় গোসল করছে। অবশ্য না জেনে ভালোই হয়েছে। মুগ্ধ হতে কে না ভালোবাসে!

অংশী জংগলে বসে গাছের সাথে গল্প করে নিজের দুঃখ কমাচ্ছে। গোসলের সময় ওই লোকটা ওরকম নির্লজ্জের মত এসে পড়েছে ভাবলেই শরীর শিউরে উঠে। ছি, কি লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু লোকটার ই বা দোষ কোথায়। যাক ওসব, এখন বাবা খুঁজছে। বাসায় যাওয়াটা জরুরি। কিন্তু মোটেও এখন বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না। এই লোকটার সামনে পড়ার ইচ্ছেটাই হচ্ছেনা আর।

এদিকে মাহিব নাস্তা করতে করতে সমস্ত প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে নিলো। লোকেশন দেখতে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে। বিকেলটা কাজ সেরে আজকে বিকেলেই বেরিয়ে যেতে হবে। জংগলে পায়খানা করার অভ্যেস মাহিব এর নেই। কমোডে বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে কাজটা সারতে শান্তি লাগে ওর। এখানে কোনোভাবে আজকে রাত থেকে গেলে ভয়াবহ সমস্যায় পড়বে সে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here