তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-১২

0
1196

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১২.
~
বিকেলের দিকে রাদিত এল। মিথি আগের থেকেই মুখ কালো করে চেয়ারে বসে ছিল। রাদিত চেয়ার টেনে বসতেই মিথি ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো,

‘আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।’

রাদিত অবাক হয়ে তাকাল। হুট করে বিয়ের কথা এসেছে কই থেকে। ব্রু কুঁচকালো সে। সপ্রতিভ কন্ঠে বললো,

‘বিয়ের কথা কোথ থেকে উঠছে? আমি কি বিয়ে নিয়ে কথা বলতে এখানে এসেছি। এসেছি পড়াতে তাই পড়া বের করো।’

মিথি রেগে গেল। ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে সে বললো,

‘বিয়ের কথা আমি বলছি না। আমার মা বলছে। আমার মা চায় আপনার সাথে আমার বিয়ে হোক। আপনিও সেটা জানেন নিশ্চয়ই। আপনারা সবাই’ই আগে থেকে সবকিছু জানেন। জানি না শুধু আমি। হুট করেই মা এসে বলে আপনাকে বিয়ে করতে হবে? এটা কেমন কথা? বললেই বিয়ে করে ফেলা যায় নাকি? আর আপনাকেই কেন বিয়ে করতে হবে? আমারও পছন্দ অপছন্দ বলে একটা জিনিস আছে। আমি বিয়ে করবো না আপনাকে। মাকে বলে দিবেন, আমি এই বিয়েতে রাজি না।’

দম ফেলল মিথি। এক নিশ্বাসে অনেক কিছু বলে ফেলেছে সে। তার সামনে থাকা মানুষটা অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। মিথির কাছ থেকে এত কিছু সে আশা করেনি। রাদিত কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। তারপর গলা ঝেড়ে বললো,

‘তোমার কাকে পছন্দ?’

মিথি ডানে বামে কিছু না ভেবে বলে দেয়,

‘নৈরিথকে।’

রাদিত অবাক হলো না। সে স্বাভাবিক গলায়ই বললো,

‘নৈরিথও কি তোমাকে পছন্দ করে?’

‘হয়তো।’

রাদিত এবার থামল। কিছু একটা ভেবে বললো,

‘তাহলে তুমি আমায় বিয়ে করতে চাও না তাই তো?’

মিথি মাথা তুলে তাকাল রাদিতের দিকে। বললো,

‘না।’

রাদিত চোখ বুজে তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করলো। বললো,

‘ঠিক আছে। সমস্যা নেই। তুমি বিয়ে করতে না চাইলে কেউ তোমাকে জোর করবে না। বিয়ের চিন্তা আপাদত মাথা থেকে দূর করে পড়ায় মনোযোগ দাও, সামনে এক্সাম।’

‘কিন্তু মা..?’

‘আন্টির সাথে আমি কথা বলবো।’

মিথির মন খুশিতে লাফিয়ে উঠল। বুক চিরে বেরিয়ে এল স্বস্তির নিঃশ্বাস। রাদিত যে এত সহজেই সবকিছু মেনে নিবে সেটা সে ভাবতেই পারেনি। এখন রাদিতের মতো তার মাও সবটা মেনে নিলেই হয়।

রাদিত পড়িয়ে চলে যাওয়ার পর পরই আমিরা বেগম তড়িঘড়ি করে মিথির রুমে এলেন। এসেই তিনি মিথি গালে সশব্দে এক চড় দিয়ে বসলেন। মিথি হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। চোখে পানি তার টলমল করছে। সে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,

‘আ-আমাকে মারলে কেন মা?’

আমিরা বেগম তেতিয় উঠে বললেন,

‘তুই রাদিতকে কি বলেছিস? তুই ওকে বিয়ে করবি না? নৈরিথকে তোর পছন্দ? এই জন্যই তুই রাদিতকে বিয়ে করবি না তাই না? তুই নৈরিথকে বিয়ে করবি? কেন নৈরিথ কি রাদিতের চেয়েও সুন্দর? পৃথিবীতে কি ঐ একটাই সুন্দর ছেলে আছে? আর বাকি ছেলেগুলো কি বাণের জলে ভেসে এসেছে নাকি? কি হলো চুপ করে আছিস কেন, বল?’

মিথি কাঁদতে লাগল। মা কে বোঝানোর মতো কোনো ভাষা তার জানা নেই। কি বলবে? কিভাবে বলবে মাকে যে, বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়েই কেবল ভালোবাসা হয় না। আর ভালোবাসতে গেলে কোনো কারণের প্রয়োজন হয় নাকি? এটাতো হুট করেই হয়ে যায়।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে মাহি সবকিছু দেখেছে। বোনকে কাঁদতে দেখে সে দৌঁড়ে তার মায়ের রুমে গিয়ে তার মার মোবাইলটা হাতে নেয়। তারপর তার বাবা নাম্বারে কল লাগায়। আতাউর সাহেব কল রিসিভ করতেই মাহি কেঁদে কেঁদে সবকিছু তাকে বলে। আতাউর সাহেব ছেলের কথা শুনে অস্থির হয়ে পড়েন। অফিস থেকে দ্রুত বেরিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলেন।

আমিরা বেগমের মুখে লাগাম ছাড়া কথা বের হচ্ছে। যা মুখে আসছে তাই তিনি মিথিকে বলছেন। যেন তার হাতের সোনার হরিণটা হাত ফসকে বেরিয়ে গেল শুধুমাত্র মিথির জন্য। মিথির গাল বেয়ে অনর্গল পানি গড়িয়েই পড়ছে। না পারছে মায়ের কথাগুলো সহ্য করতে, না পারছে মাকে থামাতে।

আতাউর সাহেব এসেই ধমক দিয়ে বসলেন আমিরা বেগমকে। তাকে দেখে আমিরা বেগম থেমে গেলেন। আতাউর সাহেব এগিয়ে এলেন মিথির দিকে। মিথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করলেন,

‘কি হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন?’

মিথি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে লাগল সে। আমিরা বেগম থেমে থেমে দম ফেলছেন। এত চিৎকার চেঁচামেচি তে গলা ধরে এসেছে তার। তিনি নিজেকে শান্ত করলেন। তারপর আতাউর সাহেবের কাছে সবকিছু খুলে বললেন। সবকিছু শুনে আতাউর সাহেব রেগে গেলেন। আমিরা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘মিথি যখন বলেছেই ও নৈরিথকে পছন্দ করে তাহলে তুমি কেন ওকে রাদিতের সাথে বিয়ে দিতে চাইছো? ওর মত নেই জেনেও কোন অধিকারে তুমি ওকে জোর করছো?’

আমিরা বেগম কপাল কুঁচকে বিচলিত কন্ঠে বললেন,

‘কোন অধিকারে জোর করছি মানে? আমি ওর মা, ওর ভালো মন্দ আমি না বুঝলে অন্য কে বুঝবে?’

আতাউর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘এই তোমার ভালো মন্দ বোঝা? মেয়েকে মেরে ধরে একজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ, মেয়ের মত থাক বা না থাক সেসবে তোমার কিচ্ছু যায় আসে না। দুদিন পর যদি সেই কষ্টে আমাদের মেয়ে উল্টা পাল্টা কিছু করে বসে, তাহলে? তাহলে সেই দায় ভার কে নিবে? নিবে তুমি?’

থমকে গেলেন আমিরা বেগম। তার স্বামী যে এইভাবে তার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াবে সেটা তিনি কখনও কল্পনাও করেননি। আতাউর সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

‘মিথির বিয়ে নৈরিথের সাথেই হবে। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের বিয়ে দিব, যদি নৈরিথ আর তার পরিবারের কোনো আপত্তি না থাকে।’

মিথি আপ্লুত চোখে বাবার দিকে তাকায়। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে রাগে তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। মিথি জানে মা এই বিয়েটা কোনো মতেই হতে দিবে না। কিন্তু, বাবা তো তার পাশে আছে এটাতেই তার শান্তি।

রাতে বাসায় কিছু রান্না হলো না। রুমে দোর দিয়ে বসে আছেন আমিরা বেগম। বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য তার বিরুদ্ধে। তার ছোট্ট ছেলে মাহিও পর্যন্ত তার বোনের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে। কার জন্য তিনি সারাদিন এত খাটেন। দিনশেষে তার কথার গুরুত্ব কেউই দেয় না। বড্ড অভিমান আর ক্ষোভ জমেছে তার মনে। এইভাবেই দোর দিয়ে বসে থাকবে সে। দোর খুলবে না, কিছু রান্নাও করবে না। এই পরিবারের জন্য, এই পরিবারের মানুষগুলোর জন্য রাতদিন এত খেঁটেও যখন সে সবার চোখে খারাপ তাহলে থাক, আর কিছু করবে না সে। এইভাবেই বসে থাকবে, দেখবে তাকে ছাড়া বাবা, মেয়ে, ছেলে কিভাবে চলে?

মিথি কাঁদো কাঁদো মুখে বললো,

‘বাবা, মা তো দরজা খুলছে না। অনেকবার ধাক্কালাম। কোনো সাড়া শব্দও করছে না।’

আতাউর সাহেব ডিম ফাটাতে ফাটাতে বললেন,

‘আরে চিন্তা করিস না। রাগ পড়লে এমনিতেই রুম থেকে বেরিয়ে আসবে। এখন বল তো, রাতে শুধু ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খেতে পারবি?’

মিথি হেসে জবাব দিল,

‘হ্যাঁ, পারবো।’

‘আচ্ছা, তবে আজ আমিই তোদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করি। তোর মা বরং আজকে একটু রেস্ট নেক। কি বলিস?’

মিথি খুশি হয়ে বললো,

‘ঠিক আছে।’

আতাউর সাহেব টুকিটাকি রান্নাবান্না করলেন। মিথি আর মাহি বাবাকে হাতে হাতে সাহায্য করলো। মাহির জন্য সুপটাও তিনি বানালেন। সবকিছু শেষে তিনি ফ্রেশ হয়ে মিথির কাছে গেলেন। বললেন,

‘তোর মায়ের রাগ কিভাবে ভাঙানো যায় বলতো?’

মিথি ফট করেই বললো,

‘গান গেয়ে।’

আতাউর সাহেব হেসে বললেন,

‘দারুণ আইডিয়া।’

তিনি আমিরা বেগমের রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর হালকা কেশে গলা ছেড়ে গাইতে লাগলেন,

‘সুন্দরীগো দোহাই দোহাই
মান করোনা
আজ নিশিথে কাছে থাকো
না বলো না

অনেক শিখা পুড়ে তবে
এমন প্রদীপ জ্বলে
অনেক কথার মরণ হলে
হৃদয় কথা বলে
না না
চন্দ্রহারে কাজলধোঁয়া
জল ফেলোনা

একেই তো এই জীবন ভরে
কাজের বোঝাই জমে
আজ পৃথিবীর ভালোবাসার
সময় গেছে কমে
একটু ফাগুন আগুন দিয়ে
না জ্বেলোনা’

ভেতর থেকে হঠাৎই আমিরা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন,

‘লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সামনে রং ঢং শুরু করেছে।’

মিথি আর মাহি হাসতে হাসতে কুটি কুটি। আতাউর সাহেবও হেসে উঠলেন। মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেই দীর্ঘশ্বাসে মিশে আছে একরাশ প্রশান্তি। এই ভালোবাসাটা পবিত্র। সেও চায় তার জীবনেও এই পবিত্র ভালোবাসাটা আসুক। এক অফুরন্ত সুখে ভরে উঠুক তার জীবন।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here