তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-১৪

0
1311

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৪.
~
হসপিটালের দুতলায় মাহিকে এডমিট করা হয়েছে। মিথি সেখানে ছুটে গিয়েই দেখল তার মা এক কোণে থম মেরে বসে আছে। আর অন্য পাশে তার বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। মিথির বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। সে দৌঁড়ে তার বাবার কাছে গেল। বিচলিত হয়ে বাবাকে জিগ্যেস করলো,

‘বাবা, বাবা মাহি এখন কেমন আছে? ও সুস্থ তো? ডক্টর কি বলেছে? হঠাৎ ও অসুস্থ হয়ে পড়ল কেন? বাবা কি হয়েছে, বলো না?’

আতাউর সাহেব ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছেন। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

‘মাহির অবস্থা ভালো নয়। ডক্টর বলেছে ওকে ইমিডিয়েট কিডনী ডোনেট করতে হবে। ওর দুটো কিডনীই নাকি ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে।’

মিথি এবার কেঁদে ফেলল। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। আজকে সকালেও তো তার ভাই একদম সুস্থ ছিল। হঠাৎ কি হলো তার? মিথি অস্থির হয়ে মাথা চাপড়ে নিচে বসে পড়ল। নেহা এসে মিথিকে ধরে সিটে বসাল। সবাই হতভম্ব। এই মুহুর্তে কারো মস্তিষ্কই যেন কাজ করছে না। নৈরিথ এগিয়ে গিয়ে মিথির বাবার কাছে বসলো। বিনয়ের সুরে বললো,

‘আংকেল, এতদিন না মাহির ডায়লাসিস চলছিল? ও তো সুস্থই ছিল। তাহলে হঠাৎ করেই ওর দুটো কিডনীই কি করে ড্যামেজ হলো?’

আতাউর সাহেব কেঁদে উঠে বললেন,

‘আমিও বুঝতে পারছি না বাবা। কি করে কি হয়ে গেল। ছেলেটার এতদিন একটা কিডনী ড্যামেজ ছিল বলে ডক্টর বলেছিল ডায়লাইসিস করালেই হবে। কিন্তু আজ একটু আগে ও হঠাৎ করেই কোমর ব্যাথায় কাঁদতে থাকে। তাই ডক্টরের কাছে নিয়ে আসি টেস্ট করে দেখার জন্য সব ঠিক আছে কিনা? কিন্তু ডক্টর সবকিছু টেস্ট করেই বললো, ওর নাকি দুটো কিডনীই ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। এখন ইমিডিয়েটলি কিডনী ট্রান্সফার না করলে ওকে বাঁচানো যাবে না।’

মিথি এবার জোরে কেঁদে উঠল। নৈরিথ অসহায় চোখে মিথির দিকে তাকাল। নৈরিথ টের পায় ভাই বোনের এই গভীর ভালোবাসাটাকে। নৈরিথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘মিথি, অস্থির হইও না। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে আসছি।’

নৈরিথ উঠে ডক্টরের কেবিনে গেল। তারপর ডক্টরের কাছে মাহির শারিরীক অবস্থার কথা জানতে চাইল।

‘পেশেন্টের শারিরীক অবস্থা ভালো নয়। আপনারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন কিডনী ডোনারের ব্যবস্থা করুন।’

‘ডক্টর, আপনাদের হসপিটাল থেকে কি ব্যবস্থা করা যায় না?’

‘দেখুন, আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু একটা কিডনী ডোনেট তো আর এত সহজ কথা নয়। অনেক কিছু আমাদের দেখতে হয়। পেশেন্টের ব্লাড গ্রুপ, টিস্যুর স্ট্রাকচার ম্যাচ করতে হয়। কিন্তু আমাদের এখান থেকে এসব ম্যাচ করছে না। এখন আপনারা বাইরে থেকে ট্রাই করুন। কিংবা খোঁজ নিয়ে দেখুন, আপনাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কাউকে পান কিনা? তাহলে দেখা যাবে কি খুব সহজেই ব্লাড আর টিস্যুটা ম্যাচ করছে।’

নৈরিথ চিন্তায় পড়ে গেল। কি করে এত অল্প সময়ের মধ্যে কিডনী ডোনার পাবে সে? ডক্টরের কেবিন থেকে বেরিয়ে মিথির বাবাকে সে সব কিছু খুলে বললো। সবকিছু শুনে মিথির বাবা বললো,

‘তাহলে আমি আমার ছেলেকে আমার কিডনী দিব।’

নৈরিথ বললো,

‘কিন্তু আংকেল আপনার তো ডায়াবেটিস আছে? আপনি কি করে কিডনী ডোনেট করবেন?’

আতাউর সাহেব অসহায় হয়ে পড়লেন। কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। ওদিকে তার ছেলেটার প্রাণ যায় যায়। আর তিনি বাবা হয়ে কিচ্ছু করতে পারছেন না। নিজেকে এখন বড্ড অসহায় লাগছে তার। কোনো দিকে কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। মিথির মা এতক্ষণ নিস্তেজ হয়ে এক কোণে পড়ে ছিলেন। তিনি এখন মিনমিনিয়ে বললেন,

‘আমার রক্তের সাথেও আমার ছেলের রক্ত মিলে না। মিললে তো আমি পারতাম আমার ছেলেটাকে বাঁচাতে। এখন..মিথির বাবা এখন কি আমার ছেলে আর বাঁচবে না? আমার ছেলে আর আমাকে মা বলে ডাকবে না? আর আমার কাছে পায়েস খাওয়ার আবদার করবে না? ও মিথির বাবা, আমার ছেলেটা যে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তুমি ওকে ফিরিয়ে আনো। ঐ যে আমার ছেলে চলে যাচ্ছে। যাও না, বসে আছো কেন? চলে যাচ্ছে তো ও। ওকে আটকাও মিথির বাবা, ওকে আটকাও।’

অবচেতন মনে অনেক কিছুই বলছেন আমিরা বেগম। মিথি বরাবরই কেঁদেই চলছে। নেহা তাকে সান্তনা দিতে ব্যস্ত। নৈরিথ তার কিছু বন্ধুকে কল দিয়েছে কিন্তু তাও কোনো ব্যবস্থা করতে পারলো না।

ডক্টর তখন কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন,

‘আপনারা কি এখনও কোনো কিডনী ডোনার পাননি?’

হঠাৎ মিথির কি হলো। সে কিছু একটা ভেবে হুট করেই উঠে দাঁড়াল। থমথমে কন্ঠে বললো,

‘আমি দিব কিডনী।’

অনেক জোড়া বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি তার উপর গিয়ে পড়ল। মিথির বাবা বললেন,

‘না মা, আমরা কিডনীর ব্যবস্থা করে ফেলবো। তোকে কিডনী দিতে হবে না। আমার এক সন্তানের জন্য আরেক সন্তানের জীবন রিস্কে ফেলতে পারি না।’

মিথি নিজেকে শক্ত করলো। বাবার কাছে গিয়ে বসে বললো,

‘কিসের রিস্ক বাবা? মানুষের একটা কিডনী হলেই চলে। এক কিডনী নিয়েই অনায়াসেই জীবন পার করা যায়। আর আমার কাছে আমার জীবনের চেয়ে আমার ভাইয়ের জীবন বড়। আমাকে আমার ভাইকে বাঁচাতে হবে বাবা। ও না থাকলে আমিও বাঁচতে পারবো না। প্লীজ বাবা, আমাকে আটকিও না।’

আতাউর সাহেব কেঁদে উঠলেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমিরা বেগম নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। হয়তো অনেক কথা বলতে চাইছিলেন। তবে সেগুলো সব গলায় আটকে যাচ্ছিল তার।

মিথিকে ডক্টর নিয়ে গেল টেস্ট করাতে। সব টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসলে তবেই সে কিডনী ডোনেট করতে পারবে। নেহা, নৈরিথ দুজনেই নিশ্চুপ। নেহা থেকে থেকে নাক টানছে। কাঁদছে সে। বান্ধবীর জন্য মায়া হচ্ছে তার। নৈরিথ এক কোণে চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল মিথিকে আটকাবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, সেই অধিকার তার নেই।

কিছুক্ষণের মাঝেই টেস্টের রিপোর্ট বেরিয়ে এল। এবং সমস্ত রিপোর্ট পজিটিভ। মিথি প্রচন্ড খুশি হলেও বাকি মানুষগুলো পড়ে গেছে দুটানায়। তারা না পারছে খুশি হতে না পারছে কষ্ট পেতে।

মিথিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেডি করা হলো। সামান্য ইনজেকশনে যে মেয়েটা ভয়ে আঁতকে উঠে, সেই মেয়েটাই ভাইয়ের জন্য আজ কি অনায়াসেই না এত বড় একটা অপারেশন করে ফেলছে। নিজের শরীরের একটা অঙ্গ দিয়ে ফেলছে। যাওয়ার আগে মিথি মা বাবাকে সালাম করলো। উনারা কেঁদে চলছেন। মিথিরও খুব কান্না পাচ্ছিল কিন্তু সে কাঁদল না। খুব কষ্টে নিজেকে সামলেছে। নেহাও তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদল। যাওয়ার আগে নৈরিথ তার কাছে এসেছিল। তার গালে হাত রেখে বলেছিল,

‘ইউ আর অ্যা ব্রেভ গার্ল মিথি। যাও, ভাইকে নিয়ে এসো। আমরা অপেক্ষা করছি।’

মিথি তখন জবাবে কিছু বলেনি। ফিচেল হেসে নার্সের সাথে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে ঢুকেছিল। সেখানে তার পাশের স্ট্রেচারেই মাহিকে রাখা হয়েছিল। মাহিকে দেখা মাত্রই মিথির গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তার স্যালাইন চলছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো।

মিথিকে একটা বেডে শুইয়ে ডক্টর তাকে কিছু প্রশ্ন করলো। মিথিকে স্বাভাবিক করার জন্যই এই প্রশ্ন। তারপর তাকে একটা ইনজেকশন পুষ করা হয়। আর তারপর ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। সেই মুহুর্তেও নিজের জন্য বিন্দুমাত্র ভয় হচ্ছিল না তার। মনে ছিল তার শুধু একটাই কথা, তার ভাইটা সুস্থ হয়ে উঠুক।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here