তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-১৫

0
1245

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৫.
~
দু ঘন্টা পর দুজনকে কেবিনে দেওয়া হলো। এখনও কারোর জ্ঞান ফেরেনি। বাইরের মানুষগুলো অস্থির হয়ে কেবিনের দরজার সামনে ঘোরাফেরা করছে। জ্ঞান ফিরলে তবেই ভেতরে যেতে পারবে তারা। কিছুক্ষণ পরেই মাহির জ্ঞান ফিরল। সে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাল। প্রথমেই কিছু বুঝে উঠতে পারল না। আস্তে করে মাথাটা ঘুরিয়ে যখন সে তার পাশের বেডে তার বোনকে চোখ বুজা অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখল তখন যেন সে অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠল। বাচ্চাদের মতো বুবু বুবু বলে ডাকতে লাগল। গলার স্বর ভীষণ ক্ষীণ তার। ডক্টর তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,

‘তোমার বুবু একদম সুস্থ আছে বাবু। এত অস্থির হইও না।’

মাহি কিছু না বলে কাঁদো কাঁদো চোখে বুবুর দিকে তাকিয়ে রইল। ডক্টর বাইরে গিয়ে মাহির জ্ঞান ফেরার খবরটা সকলকে দিলেন। সাথে সাথেই তখন নৈরিথ বললো,

‘মিথির জ্ঞান ফেরেনি?’

‘না। তবে চিন্তা করবেন না, খুব শীঘ্রই উনারও জ্ঞান ফিরবে।
আর এখন আপনারা মাহির সঙ্গে দেখা করতে পারেন।’

মাহির মা বাবা দ্রুত কেবিনের ভেতর প্রবেশ করলো। আমিনা বেগম মাহিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আতাউর সাহেবও চোখের পানি আটকাতে পারলেন না। তিনি মাহিকে খানিক আদর করে মিথির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মিথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

‘মা রে উঠ। দেখ, তোর ভাই সুস্থ হয়ে গিয়েছে। তোকে ডাকছে মা। চোখ খুলে তাকা। এই ভাবে চোখ বুজে শুয়ে থাকলে ভাইকে কিভাবে দেখবি? উঠ না মা আমার।’

মাহি ভেজা চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। আমিরা বেগম মাহিকে জড়িয়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মনের ভেতর অস্থিরতা এখনও তার কমেনি। তার মেয়ে যে চোখ খুলছে না। এক সন্তানের মায়ায় আরেক সন্তানকে বলি দিতে পারবেন না তিনি। দুই সন্তানই যে তার প্রাণ।

কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেহা আর নৈরিথ। নেহার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ফর্সা গালগুলোও রক্তিম। মিথিকে এমন ভাবে দেখে কষ্ট হচ্ছে তার। কান্না পাচ্ছে খুব। নেহা এগিয়ে যায় মিথির কাছে। তার পাশে গিয়ে বসে। মিথির স্যালাইন চলছে। নেহা আস্তে করে তার হাতের উপর হাত রাখে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,

‘দোস্ত, আমার আর তোকে এইভাবে দেখতে ভালো লাগছে না। এবার উঠে পর। প্লীজ দোস্ত, তাকা একবার। আমার কষ্ট হচ্ছে তো।’

নেহার গাল বেয়ে মায়া অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ল। নৈরিথ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে। তার নিরব স্তব্ধ দৃষ্টি মিথির উপর। কঠিন এই মানব মনের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। এক ভয়ানক কষ্ট যেন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। নৈরিথ তার মনকে প্রশ্ন করলো, কিসের ভিত্তিতে সে এত কষ্ট পাচ্ছে? মিথির প্রতি তারা মায়া আছে ঠিকই; কিন্তু তাই বলে কি শুধু এই মায়ার টানেই সে এত কষ্ট পাচ্ছে? নাকি তার এই টান আরো গভীর? নৈরিথ কোনো উত্তর পেলো না। তার মন তার প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো। তবে এইটুকু আন্দাজ করতে পারলো, মিথি নামের মেয়েটার কিছু হলে সে ঠিক মেনে নিতে পারবে না। তার আজ হঠাৎই মনে হচ্ছে, মেয়েটা যেন তার আত্মার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সে চোখে বুজে মেয়েটার অনুপস্থিতি কল্পনা করলেই কেঁপে উঠে। ভয়ে গলা শুকিয়ে উঠে তার। তার মন তাকে এইটুকু বলেছে যে, তার বেঁচে থাকার জন্য এই মেয়েটাকে প্রয়োজন। হ্যাঁ, প্রয়োজন। ভীষণ ভাবে প্রয়োজন।

নৈরিথ ছোট্ট একটা ঢোক গিলে। মনে মনে ঠিক করে, মিথি সুস্থ হয়ে উঠলেই সে এই কথাগুলো মিথিকে বলবে।
.
.
দুপুরে অপারেশন হলেও মিথির জ্ঞান ফিরল বিকেলে। তার মধ্যে মাহিকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। ছেলেটার পেটের সেলাইয়ের মধ্যে ব্যথা হচ্ছিল, তাই। মিথি চোখ খুলে দেখল, তার পরিচিত প্রিয় মুখগুলো কেমন চুপসে গেছে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে তাদের। মিথির ঠোঁটগুলো প্রচন্ড শুকিয়ে আছে। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে ক্ষীণ সুরে বললো,

‘ভাই কেমন আছে বাবা?’

আতাউর সাহেব এবার দম ফেললেন। মিথির মুখে বাবা ডাক শুনে মনের শান্তি ফিরে পেয়েছেন তিনি। মিথির কপালে চুমু খেয়ে তিনি বললেন,

‘মাহি একদম সুস্থ মা। ওর জ্ঞান তো অনেক আগেই ফিরেছে। এখন আবার ঘুমাচ্ছে। জ্ঞান ফিরেই তোকে এইভাবে দেখে ভয় পেয়ে গেছিল। পরে ডক্টর ওকে বুঝিয়ে বলাতে বুঝেছে।’

মিথি ঢোক গিলে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর তার মা বাবার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে মৃদু সুরে বললো,

‘আমার একটা কথা রাখবে তোমরা?’

আমিরা বেগম বললেন,

‘হ্যাঁ মা, বল কি কথা?’

মিথি আবারও নিশ্বাস ফেলল। বললো,

‘মাহিকে তোমরা কোনোদিন, কোনো কারণে এটা বলবে না যে আমি ওকে কিডনী দিয়েছি বলেই ও বেঁচে আছে। ওর যেন কোনোদিন এটা মনে না হয় যে ও আমার একটা কিডনীর জন্যই বেঁচে আছে। ও বেঁচে আছে শুধু আল্লাহর দয়ায়। ওর বেঁচে থাকার পেছনে আমার কোনো হাত নেই। তাই অনুরোধ করছি তোমাদের কাছে, ওকে এই ব্যাপারে কিছু বলবে না। আর ও যদি আমার অসুস্থতার কারণ জিগ্যেস করে, তাহলে বলবে যে ওর শরীর খারাপের কথা শুনে আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। এর বেশি আর কিছু বলো না। প্রমিস করো, বলবে না?’

মিথির মা বাবা স্তম্ভিত। তাদের এইটুকু মেয়েটা তার ভাইকে নিয়ে এত ভাবে? আমিরা বেগম কেঁদে ফেললেন। তার মনে হচ্ছে যেন তার কোনো পুণ্যের গুণেই খোদা তাকে এই কন্যা সন্তানের জননী করেছে। তিনি মেয়ের চোখে মুখে আদর দিয়ে ভরিয়ে দিলেন। মিথি হেসে ফেলল। বললো,

‘কি ব্যাপার মা? আজ এত আদর করছো? আমাকে আদর টাদর দিয়ে কিছু করিয়ে ফেলার জন্য কোনো ফন্দি টন্দি আঁটছো নাকি?’

আমিরা বেগম নাক ফুলিয়ে বললেন,

‘মার খাবি কিন্তু ফাজিল। এই অবস্থাতেও তোর দুষ্টুমি গেল না।’

মিথি দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে বলে,

‘আমি অলওয়েজই এমন।’

সঙ্গে সঙ্গে তার পেটে টান লাগতেই সে ‘উহহ’ শব্দ করে উঠে। মিথির মা বাবা অস্থির হয়ে বললেন,

‘হয়েছে হয়েছে আমরা বুঝেছি। আর এত হাত পা নড়াতে হবে না।’

মিথি সোজা হলো। তার মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি। নেহার দিকে মাত্রই তাকাল। ব্রু কুঁচকে ফেলল মিথি। বললো,

‘কিরে মেয়ে, পুরো মুখে কি ব্লাশন মেখে এসেছিস নাকি? চোখ মুখ এত লাল হয়ে আছে কেন?’

মিথির মা জবাবে বললো,

‘তোর জন্য কেঁদে কেটে এই অবস্থা করেছে।’

মিথি অবাক হওয়ার ভান করে বললো,

‘তুই আমার জন্য কেঁদেছিস? সিরিয়াসলি?’

নেহা কপাল কুঁচকে বিরক্তির সুরে বললো,

‘না কাঁদিনি। কেন কাঁদবো? আমার চোখের পানি কি এতই সস্তা নাকি যে তোর মতো একটা গরুর জন্য আমি কেঁদে কেটে চোখের পানি নষ্ট করবো? ইম্পসিবল।’

মিথি মুচকি হেসে বললো,

‘আর আজ যদি আমি মরে যেতাম?’

নেহার চোখগুলো আবারও ভিজে উঠল। মিথির জ্ঞান ফিরছিল না বলে সেই কি ভয়ই না পেয়েছিল সে। কিছুক্ষণের জন্য তারও মনে হয়েছিল, মিথি বোধহয়…! ভাবলে এখনও নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার।

নেহা নাক টেনে বললো,

‘তাহলে চল্লিশা খেতাম।’

মিথি মুচকি হেসে বলে,

‘আই লাভ ইউ নেহু।’

নেহা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,

‘আই হেইট ইউ।’

মিথি তার প্রতিউত্তরে প্রাণখোলে হাসে।

নৈরিথ কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে মিথির সেই হাসি দেখে। হৃদ কম্পন অল্প বিস্তর বেড়ে যায় তার। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে। সে তাকিয়ে থাকে এক ধ্যানে। মন বলে উঠে, এই মেয়েটাকে বাঁচতে হবে, হাসতে হবে আর…আর তাকে প্রাণ ভরে ভালোও বাসতে হবে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here