তোমার_নেশায়_নেশাক্ত_আমি পার্ট:১৭+১৮

তোমার_নেশায়_নেশাক্ত_আমি
পার্ট:১৭+১৮
#পিচ্চি_লেখিকা

৩ জন ঘুরতে ঘুরতে একটা ফাকা রাস্তার কাছে যায়।একদম নিরব।আইরা আর রিমা গল্প করছে তাতে অবশ্য আরিয়ার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।আরিয়ার চোখ যায় সামনে থাকা একটা ছেলের দিকে।পেছন থেকে একদম আরুশের মতো লাগছে।আরিয়া বুকে চিনচিন ব্যাথা করছে।সত্যি কি এটা আরুশ নাকি তার চোখের ভুল।আরিয়া কিছু না বলেই দৌড়ে ছেলেটার কাছে যায়।আরিয়ার এমন দৌড় দেয়ার কারন রিমার আর আইরার বোধগম্য হলো না তাই তারাও পিছন পিছন গেলো।আরিয়া ছেলেটার সামনে গিয়ে দাড়ায়।না এটা আরুশ না।আরিয়া সরি বলে দূরে সরে আসে।রিমা আর আইরা কাছে এসে জিজ্ঞেস করে কি হয়ছে এমন দৌড়ানোর কারন কি?আরিয়া কিছু না বলে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের মতো হাটতে লাগলো।আইরা বুঝেছে তাই আর কথা বাড়ালো না রিমাকেও কিছু বলতে নিষেধ করলো। ৩ জন ঘুরে ঘুরে সব টা দেখছে।৩ জন বললে ভুল হবে অবশ্য শুধু আইরা আর রিমাই দেখছে আর আরিয়া চুপ করে একটা জায়গায় বসে আছে। চোখ টলমল করছে এই বুঝি গড়িয়ে পড়বে। আইরা অনেক চেষ্টা করেও আরিয়া কে হাসাতে পারছে না। তাই আরিয়াকে একা থাকতে দেয়ার জন্য দুজনই একটু দুরে গিয়ে দাড়ালো। বেশ কিছুক্ষণ পর আরিয়ার কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে পিছনে তাকায়। শান্ত চোখে অপর মানুষটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,,,

“”” আপনি?

শুভ এসেছে। আরিয়ার পাশে বসতে বসতে বললো,,

“” হুম আসলাম।আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড কে মেরে শান্তি পেয়েছো?

আরিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,,

“”শান্তি!

“”একবার যদি সব সত্যিটা জেনে সেদিন স্যুট করতে আজ হয়তো তোমার এই অবস্থায় বসে থাকতে হতো না।

“” আপনার এতো মায়া লাগে কেন?আপনি তো আরুশের শত্রুই ছিলেন।

শুভ রহস্যময় এক হাসি দিয়ে বলে,,

“”কত টুকু জানো আমাদের বিষয়ে?আচ্ছা একটা কথা বলো তো তুমি কি আদৌ স্মৃতির বোন?

শুভর কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে আরিয়া। শুভর দিকে ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলে,,

“”আপনাকে আমি সেই প্রশ্নের আন্সার দিতে বাধ্য নয়। আর হ্যা আরুশ কে যদি মেরে থাকি তাহলে আমি ঠিক করেছি। আমার আপুর সাথে যে অন্যায় করেছে তাকে শাস্তি দিয়েছি। হতে পারে আরুশ আমার হাজবেন্ড কিন্ত সে আমার বড় আপুর খুনিও তাই তাকে মেরেছি। ওর মতো ক্রিমিনালের জন্য আমার কেন কষ্ট হবে? হবে না।

শুভ মুচকি হেসে বলে,,

“” তুমি আর স্মৃতি অনেক আলাদা। স্মৃতি ক্ষমা করতে জানতো। কি ঠিক আর কি ভুল তা বিচার করে শাস্তি দিতো। আর তুমি? কিছু না জেনেই শাস্তি দিয়ে দিলে।

“”সাট আপ। আরুশ আমার আপু কে মার্ডার করছে।

শুভ এবার নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে আরিয়ার গলা চেপে ধরে।

“”খবরদার আর আরুশের বিরুদ্ধে আর একটাও কথা বলবে না। তুমি কি জানো হ্যা? তুমি স্মৃতির বিষয়ে ভালো ভাবে খোজ নিয়েছো? কিন্তু আমি আর আরুশ ২ বছর ধরে স্মৃতির খুনি কে খুজে চলেছি। পেয়েও গেছিলাম কিন্ত শুধুমাত্র তোমার জন্য স্মৃতির খুনিকে শাস্তি দিতে পারলাম না। আরে তুমি তো ঠিকমতো এটাও জানো না স্মৃতি বেচে আছে নাকি মরে গেছে।খুব তো আপুর খুনি কে শাস্তি দিবো শাস্তি দিবো করো। খুজেছো সত্যিটা?জানার চেষ্টা করেছো সত্যিটা?

গলা চেপে ধরায় আরিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।শুভ আরিয়াকে ছেড়ে বলতে শুরু করে।

“” ২ বছর ৮ মাস আগে একদিন আমি আর আরুশ জনসম্মুখে ২ টা ছেলেকে বাজে ভাবে মারছিলাম। মারার কারণ ছিলো ওরা মেয়েদের টিজ করেছে। স্মৃতি ছিলো তোমার মতোই প্রতিবাদি। অনেক সাহসি। যেখানে কেউ কিছু বলছে না সেখানে স্মৃতি একমাত্র আমাদের কাজে বাধা দেয়। আমাদের দুজনকেই ২ টা থাপ্পড় দেয়। আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম। প্রথম দেখায় আমার স্মৃতি কে ভালো লাগে। শুধু ভালো লাগা না অনেক বেশি ভালো লাগা। টানা টানা চোখ বাতাসে খোলা চুল উড়ছিলো। কথা বলা গুলো ও ছিলো ভিষন গোছালো। সেদিন থাপ্পড় খেয়েও আমি আর আরুশ কিছুই বলিনি। পরে অবশ্য স্মৃতি এসেছিলো সরি বলতে। তারপর টুকটাক কথা বলা থেকেই তৈরি হয় বন্ধুত্ব। আমরা এটুকু জানতাম স্মৃতি লন্ডনেই সেটেল্ড ছোট ২ টা বোন আছে। একজন কলেজে পড়ে আরেকজন বাচ্চা প্রায়। বিডিতে বেড়াতে এসেছিলো স্মৃতি। আমি যে স্মৃতি কে ভালোবেসে ফেলেছিলাম এটা আরুশ জানতো। তবে আমার নিয়তি খারাপ ছিল। আমাদের বন্ধত্ব থেকে শুরু হয়ে ত্রিকোণমিতি ভালোবাসা। আমি স্মৃতিকে ভালোবাসতাম আর স্মৃতি আরুশকে।

এতটুকু বলেই শুভ একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো। আরিয়া অবাক হয়ে শুনছে সবটা। এ কেমন ত্রিকোণমিতিক প্রেমের গল্প। কে মেরেছিলো স্মৃতি কে?এত ভালো বন্ধুত্ব কেন হয়েছিলো নষ্ট? সবটা জানার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে আরিয়া।শুভ আবারো বলতে শুরু করে,,

“” আমি ভেবেছিলাম স্মৃতিকে বলে দেবো আমি তাকে ভালোবাসি কিন্তু সেদিনই স্মৃতি কথায় কথায় বলে ফেলে সে আরুশকে ভালোবাসে। প্রথমে বুকে চাপা একটা কষ্ট হলেও পরে আমি খুশি হয়। হ্যা খুশি হয়েছিলাম এটা ভেবে যে আরুশকে আগলে রাখার মতো কেউ তো থাকবে। সুন্দর ভাবে বাচবে আরুশ। আরুশের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে নিজেই ছোট বয়স থেকে বিজনেস সামলায়। আমাদের বন্ধুত্ব থাকায় প্রায়ই আসতো আমাদের বাড়িতে। আমার আম্মু আব্বুও আমার মতোই ভালোবাসতো আরুশকে। অনেকের হিংসা হতো আমাদের এমন সম্পর্ক দেখে। অনেকে আমার বাবা মা’য়ের ভালোবাসা টাও নিয়েও হিংসা করতো আরুশকে। কিন্তু আমার কিছুই মনে হতো না। সেরকমই একদিন আরুশ আমাদের বাড়িতে আসে আমি তখন ওকে বুঝিয়ে বলি স্মৃতির কথা কিন্তু আরুশ মানে না। ওর একটাই কথা ছিলো আমি স্মৃতিকে ভালোবাসি তাই স্মৃতিও আমাকেই ভালোবাসবে। বেশি বুঝানোর ফলে রাগ করে বেড়িয়ে যায়। পরে স্মৃতির সাথে দেখা করে স্মৃতিকে সবটা বলে দেয়। স্মৃতি কিছুদিন আমার সাথে রেগে থাকে। কথায় বলতো না। অনেক ফোন মেসেজ করার পর স্মৃতি আমার সাথে দেখা করবে বলে। ভার্সিটির ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখি আরুশ আর স্মৃতি বসে আছে। আমি মন খারাপ নিয়ে বসে পড়লাম। দুজন জমিয়ে গল্প করছিলো আর আমি চুপচাপ শুনছিলাম তখনই স্মৃতি আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,”কি রে অশুভ এমন মুখের মধ্যে সুপার গ্লু আঠা লাগায়ছিস কেন?
“তোরা গল্প কর আমি শুনি।
“” তুই আসলেও অশুভ। প্রোপোজ কর।

স্মৃতির এমন কথা শুনে চমকে ওর দিকে তাকায়।আরুশ মিটমিট হাসছে।আমি তো হা করে তাকিয়ে আছি দুজনের দিকে।স্মৃতি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,,
“এই বলদ প্রোপোজ করবি নাকি অন্য কোনো ছেলে দেখবো।
তখন আমি লাফ দিয়ে উঠে প্রোপজ করেছিলাম।সেদিন ৩ জন অনেক ঘুরেছি। স্মৃতি হয়তো একপাক্ষিক ভালোবাসা টা বুঝেছিল তাই সেও আমাকে অবহেলা না করে অনেক ভালোবাসতো। স্মৃতি আমি আর আরুশ আগের মতোই ছিলাম। আমি কখনো ওদের নিয়ে সন্দেহ করিনি।ভালোই ভালো কেটে যায় ৫ মাস। একদিন আমি আর আরুশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন স্মৃতির ফোন থেকে একটা কল এসেই কেটে যায়। পরে মেসেজ আসে।” শুভ প্লিজ তাড়াতাড়ি আয়,,বাচা আমাকে”। এটুকুই লিখা ছিল আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি স্মৃতির বাড়ি যায়।সেখানে গিয়ে দেখি স্মৃতির শরীর থেকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

আর কিছু বলতো পারলো না শুভ। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। আরিয়া বুঝতে পারছে শুভ স্মৃতিকে কতটা ভালোবাসে।শুভ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বলে,,

“”” সেদিন ভেঙে পড়েছিলাম অনেক। কিন্তু আরুশ সামলে নিয়েছিলো আমাকে। ওখান থেকে একটা কাগজ পাই। সেখানে আরুশের বিরুদ্ধে লিখা ছিল। আমাকে উদ্দেশ্য করা লিখা ছিল”আরুশকে শাস্তি দিয়ো শুভ” কাগজ দেখেই আমি হতবাক। আরুশ কখনো এমন করবে না তা আমি জানি। হারে হারে টের পাচ্ছিলাম কেউ স্মৃতিকে মেরেছে আমাদের শত্রু বানানোর জন্য। আরুশ কাগজ টা পড়েই আমাকে ধরে শক্ত ভাবে বলেছিলো সে কিছুই করেনি। কান্না করে দিয়েছিলো। আমি আরুশকে কিছু না বলতে দিয়ে উঠে গিয়ে কাবাডের ওখান থেকে ছোট একটা হিডেন ক্যামেরা বের করে আনি। আরুশ অবাক হয়ে গেছিলো ক্যামেরা দেখে। আসলে ক্যামেরাটা একদিন আমি আর স্মৃতি মজা করেই লাগিয়েছিলাম। এভাবে কাজে লেগে যাবে ভাবতে পারিনি। ভিডিও তে ক্লিয়ার দেখা যাচ্ছে একটা লোক মাস্ক পড়ে এসে স্মৃতির মাথায় গান ঠেকিয়ে আমাদের মারার ভয় দেখিয়ে একটা কাগজ লেখায়। সরি সরি ২ টা কাগজ ছিলো। একটা আমরা পেয়েছিলাম আরেকটা কার কাছে জানি না। কেন এমন করেছিলো লোকটা তাও আমরা জানি না। শুধু যাওয়ার সময় স্মৃতিকে স্যুট করে দেয়।

শুভর সব কথা শুনে আরিয়ার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। শুভরও কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।গলা শুকিয়ে গেছে। জিভ দিয়ে ওষ্ঠ গুলো ভিজিয়ে নিয়ে আরিয়া বলে,,

“” কি প্রমান আছে?আপনি তো মিথ্যাও বলতে পারেন?

শুভ মুচকি হেসে বলে,,

“”আমি জানি তুমি বিশ্বাস করবে না।

শুভ প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করলো।

“” এই ফোনে সব আছে দেখো।

শুভর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আরিয়া দেখতে শুরু করলো। সেখানে শুভ আর স্মৃতির অনেক পিক আছে। প্রোপোজ থেকে শুরু করে সব পিক।আরুশও আছে সাথে। সব পিক দেখার পর শুভর দিকে ফোনটা দিতে দিতে বলে,,

“” ওই ভিডিও টা কই? ফুটেজ।

“” আছে।

শুভর ফোনে কপি করে রাখা ছিলো ফুটেজ। সেইটা দেখালো।সবটা দেখে আরিয়া যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে কি বলবে বুঝতে পারছে না। শুভ ফোনটা পকেটে পুড়তে পুড়তে বলে,,

“” এখনো তোমার অনেক কিছু অজানা। সময় হলে সব জানবে। তবে যা করেছো তা ভুল। আর হ্যা আমি কখনোই তোমাকে ভালোবেসে তোমার পিছে ঘুরিনি। তোমাকে প্রথম দেখে মনে হয়েছিলো স্মৃতি পরে আমি আরুশকে বলি তখন থেকেই তোমার উপর নজর রাখার জন্য তোমার পিছে পিছে ঘুরতাম। আমি সেদিনও মন প্রান উজার করে স্মৃতি কে ভালোবেসেছি আজও বাসি ভবিষ্যতেও বাসবো।

কেউ মারা যাওয়ার পরও তাকে এভাবে ভালোবাসা যায় হয়তো আরিয়ার জানা নেই। শুভর চোখে পানি। আরিয়া নিজেও রোবট হয়ে বসে আছে। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে এই ভুল কি আদৌও শুধরানো সম্ভব? কিভাবে সম্ভব? মানুষটা তো নেই। এসব ভেবেই আরিয়া ডুকরে কেদে উঠে। আরিয়ার কান্নার শব্দে শুভ ওর দিকে তাকায়। আরিয়া কান্না করতে করতে হিচকি তুলে ফেলেছে। শুভ আরিয়ার মাথায় হাত দিয়ে বলে,,

“”” কেদো না আরিয়া। যা করেছো তা ভুল। তুমি যদি আরুশের কথা শুনতে আজ হয়তো আরুশ আমাদের সাথে থাকতো।

শুভর কথা শুনে আরিয়ার কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। শুভরও অনেক কষ্ট হচ্ছে। এত গুলো দিনের বেষ্ট ফ্রেন্ড এভাবে ছেড়ে যাবে ভাবতে পারছে না সে। কেন সবাই ছেড়ে যায়? থেকে গেলে কি খুব ক্ষতি হয় সবার? শুভ চোখের বিন্দু বিন্দু জল গুলো মুছে আরিয়ার পাশ থেকে উঠে চলে আসতে লাগে। শুভ দাড়াতেই আরিয়া কিছু বলে উঠে। আরিয়ার কথা শুনে শুভ অবাক হয়ে দাড়িয়ে যায়……

চলবে….

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন 😊❤️

হ্যাপি রিডিং😊

#তোমার_নেশায়_নেশাক্ত_আমি
#পার্ট:১৮
#পিচ্চি_লেখিকা

শুভ উঠে চলে আসতে গিয়ে আরিয়ার কথায় থেমে যায়। আরিয়া কোনো রকম নিজেকে শান্ত করে বলে,,

“” আমি আরুশকে স্যুট করি নি ভাইয়া।

শুভু আরিয়ার কথা শুনে চমকে পিছনে তাকায়। আরিয়া মাথা নিচু করে কেদে যাচ্ছে। কি বলছে এটা? আরিয়া না করলে তবে কে করেছে এই কাজ?

“” সেদিন আমি আরুশকে মারার জন্যই ডেকেছিলাম। কিন্তু আরুশকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কখন?কিভাবে?কেন? কিছুই জানি না। তবে নিজের মনকে শান্ত করে উনাকে মারার জন্যই গিয়েছিলাম। উনি হয়তো জানতো আমি পারবো না স্যুট করতে তাই রহস্যময়ভাবে হাসছিলো। আমি কাপা কাপা হাতে চোখ বন্ধ করে ট্রিগারে হাত দিয়েই আবার সরিয়ে নিয়েছিলাম কিন্তুু হঠাৎ করেই আওয়াজ হয় অনেক জোড়ে আমি নিজেই কেপে উঠেছিলাম। কোনোরকম চোখ মেলে দেখি আরুশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। আমি আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম স্যুট তো আমি করিনি তবে গুলি লাগলো কিভাবে? আশে পাশে তাকিয়েও কাউকে দেখিনি। অনেক ইচ্ছা করছিলো আরুশকে হসপিটাল নিয়ে যেতে কিন্তু আপুর কথা মনে করে আর পারিনি। সেখান থেকে চলে আসি। গাড়ি নিয়ে একটুদুর এসে সব ভুলে সেদিন আমি আবারো গিয়েছিলাম কিন্তু গিয়ে দেখলাম সেখানে একটা লোক পড়ে আছে ঠিক তবে তার মুখ থেতল…

আর কিছু বলতে পারলো না আরিয়া। আবারো ডুকরে কেদে উঠলো। কিছুক্ষন থেমে আরিয়া আবারও বললো,,

“”” আমি জানি না কে ওর মুখ থেতলে দিয়েছিলো। তবে ওই অবস্থা দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম। মুখ বিকৃত খুব বাজে অবস্থা। কোনরকম সরে আসি। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না আমাকে কিন্তু সত্যি বলছি ভাইয়া আর আমি বাড়ি এসেও চেক করেছি। গানে ৬ টা গুলিই ছিলো।

আরিয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে শুভ আরিয়ার মাথায় হাত দিয়ে বলে,,

“”যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আরুশের খুনি কে শাস্তি তো আমি দিবো। তুমি পাশে থাকবে তো আমার?

আরিয়া শুভর মুখের দিকে এক পলক তাকায়। শুভ মৃদু হেসে বলে,,

“” তোমার অজানায় এখনো অনেক কিছু আছে!যা তুমি সময় মতো জানবে। এখন এসব নিয়ে ভেবো না! শক্ত করো নিজেকে! তুমি চাও তো যারা তোমার আপুকে আর আরুশকে কেড়ে নিয়েছে তারা শাস্তি পাক?

আরিয়া মাথা নাড়ালো যার উত্তর “হ্যা”

“”” তাহলে শক্ত হও। আমি আজ আসি। আর হ্যা ভরসা রাখো আল্লাহর উপর।

আরিয়া শুভর কথার মানে না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। শুভ মুচকি হেসে আরিয়ার থেকে দুরে সরে যায়। কিছুটা দুর এসে কাউকে ফোন করে।

এদিকে আরিয়াকে এভাবে কাদতে দেখে রিমা আর আইরা ছুটে আসে। হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,,

“”কি হয়েছে আপু তোমার? বলো কি হয়ছে?

আরিয়া কিছু না বলে কেদেই যাচ্ছে। আইরা আর রিমার কথা যেনো তার কান পর্যন্ত যাচ্ছেই না। আরিয়া কোনো কিছু না দেখেই হিচকি তুলে কাদছে আর আরুশের কথা গুলো মনে করছে। সেদিন যদি তাকে ওভাবে ফেলে না রেখে সাথে নিয়ে আসতো আজ হয়তো আরুশ থাকতো তার সাথে। সব সত্যিটা আরো একটু গভীর ভাবে যদি খোজ করতো আজ হয়তো এত কিছু হতোই না। যদিও সে আরুশকে স্যুট করে নাই তবুও তো এত কিছুর জন্য সে নিজেও দায়ী। আরিয়াকে কোনো রকম শান্ত করে আইরা আর রিমা নিয়ে যায়। রিমাদের বাড়িতে ঢুকেই আরিয়া নিজের রুমে চলে যায়। ওয়াশরুম ঢুকে চিৎকার করে কাদতে থাকে।

আইরা ওর বাবাকে পুরোটা জানায়। আইরা শুভকে দেখেছিলো। আর অনেক কথা শুনেছে। তবে সবটা তার বাবাকে না বলে শুধু এটুকু জানালো আরিয়া আগের থেকেও বেশি কান্না করছে। কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। আরিয়ার বাবাও বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। কি হলো এটা? আরিয়াকে তিনি কিছুতেই বিডিতে পাঠাতে চাননি। কিন্তু আরিয়া জেদ ধরেই গেছিলো। এই বিডির জন্য তিনি তার এক মেয়েকে হারিয়েছেন আবার সেই বিডির জন্যই আরেক মেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে। সালমান শেখের স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনগুলোর কথা। আইরার যখন ৪ বছর বয়স তখন আরিয়ার মা মারা যায়। তখন থেকে স্মৃতিই আরিয়া আর আইরা কে মায়ের ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে। আরিয়া সেবার কলেজে ইন্টার ২য় বর্ষ। তখন স্মৃতি বায়না ধরে বিডিতে যাবে। সালমান শেখ অনেক বারন করা স্বত্ত্বেও সে যাবে বলে জেদ ধরে বসে ছিলো। আরিয়ার কলেজের জন্য সে যেতে পারেনি। আইরা ছোট বলে আরিয়া আইরা কে রাখে আর স্মৃতি একাই যায় বিডিতে। ৮ মাস ভালো কাটছিল সব। হঠাৎ একদিন বিডি থেকে ফোন আসে যে স্মৃতি মারা গেছে।সেদিন আরিয়া আর আইরা অনেক কেদেছিলো। সালমান শেখও নিজের মেয়ের অকাল মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন আরিয়া নিজেকে শক্ত করে সবটা সামলায়। সেইবার সবাই গিয়েছিলো বিডিতে। স্মৃতির দাফন কাফন শেষ করে আরিয়ারা সেখানেই থেকে যায়। কয়েকদিন কোনো রকমে কেটে যায়। হঠাৎ একদিন আরিয়ার কাছে একটা পার্সেল আসে। সেই পার্সেলে একটা ডিভিডি আর একটা চিঠি। আরিয়া চিঠিটা পড়তে শুরু করে। সেখানেই আরিয়া আরুশের বিষয়ে জানতে পারে। আর ভিডিও টাও আরুশের বিরুদ্ধে। আরিয়া পুলিশের কাছে গেলে আরুশকে গ্রেপ্তার করা হয়।তখন কিভাবে যেনো আরুশ মুক্তি পেয়ে যায় আর সেইজন্যই আরিয়া ঠিক করে আরুশকে নিজে হাতে শাস্তি দেবে। আরিয়া ২ বছর পর আবার আসে বিডিতে। (বাকিটা সবার জানা🤐)

সালমান শেখ মেয়েদের এমন করুন পরিস্থিতি সহ্য করতে পারছেন না। কি আর করার আছে? সালমান শেখ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে মন দেয়।

সূর্য ডুবে হালকা অন্ধকার ছেপেছে আরিয়া এইসময় ছাদে দাড়িয়ে এক মনে নিচে তাকিয়ে আছে। তার পাশে কেউ দাড়িয়েছে এতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নিজের মতো থাকতে ব্যাস্ত। পাশ থেকে ইমন গলা খাকাড়ি দিয়ে বলে,,

“” এভাবে নিচে কি দেখছিস রে? লাফ দিবি নাকি?

আরিয়া পলক সড়িয়ে ইমনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়,,

“”” কি রে বোবা ধরছে নাকি তোকে?

আরিয়া এখনো চুপ,,

“”” দেখ শাঁকচুন্নি এভাবে চুপ থাকলে আমার ভয় করে। ভুতে টুতে তোকে ধরছে নাকি?

আরিয়া নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,,

“” কিছুই ধরে নি আমায়। একা থাকতে দিবি একটু?

আরিয়ার এমন গা ছাড়া কথা বার্তা ইমনের মোটেও ভালো লাগছে না। আরিয়া যে অনেকটাই গম্ভীর হয়ে গেছে তা সে বুঝতে পারছে। আরিয়া কে কিছু না বলে ছাদ ত্যাগ করলো। আরিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবারো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আরফান বাড়িতে নেই আগের মতো হৈ হুল্লোর। সবাই আরুশের শোকে শোকাহত। আয়ান আগে থেকেই একটু শান্ত টাইপের আর এখন ওর মুখ থেকে টু শব্দ শোনার জন্যও সবার অধীর আগ্রহে বসে থাকতে হয়। অফিসেও খুব একটা কথা বলে না আয়ান। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। হঠাৎ করেই কেদে উঠে। আরুশের রুমে সুন্দর করে একটা বড় ফ্রেমের হাসি মাখা ছবি রাখা আছে। আয়ান প্রায়ই সেটার সামনে গিয়ে কাদে। আরুশের শার্ট ব্লেজার টি শার্ট সব নিয়ে সমানে কাদে। শুভ সবাইকে নিজের সাধ্যমতো থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আয়ানকে সে দমিয়ে রাখতে পারে না। আরুশের মৃত্যুতে সবাই যেন জিবন্ত লাশ হয়ে গেছে।

কেটে গেছে ১ বছর! পাল্টে গেছে পরিবেশ। আরিয়া এখন আর কাদে না। পুরো একবছর শুধু কেদেই গেছে। সারারাাত না ঘুমিয়ে কান্না করতো। ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুম হয়না একদিনো। আইরা এক মিনিটের জন্যও চোখের আড়াল করে না আরিয়াকে। আরিয়া আগের চেয়ে অনেক পাল্টে গেছে সবার সাথে থাকে ঠিক কিন্তু কথা বলে কম। একদম গম্ভীর টাইপের। নিজেকে আগের থেকে অনেকটা শক্ত করে নিয়েছে তবে ভিতরে ভিতরে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। আগের সেই মুখের উজ্জলতা টা কেটে গেছে।

আয়ানও স্বাভাবিক জিবনে আসার চেষ্টায় আছে। পড়াশোনার পাশাপাশি বিজনেসটাও সামলায়। তানিয়ার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। ফুপি নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে। শুভ নিজের চেষ্টায় আছে। শুধু পাল্টায়নি একটা মানুষ। এখনো শত শত ক্ষত তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কেউ কি রেখেছে সেই খোজ? না তো। সবাই নিজের মতোই তো ব্যাস্ত।

আজ আরিয়া আইরা সাহেদ হোসেনের পুরো পরিবারের সাথে বিডিতে যাচ্ছে। সাহেদ হোসেনের ভাগ্নির বিয়ে। আরিয়া তো প্রায়ই গম্ভীর থাকে তাই তাকেও নিয়ে যাচ্ছে আর আরিয়া যেখানে আইরা সেখানে। সালমান শেখ ইচ্ছা করেই বিডিতে আসেন নি। মেয়েদের ও যেতে দেয়ার ইচ্ছা ছিল না তার। তবুও আরিয়ার কথা ভেবে যেতে দিলো।

এয়ারপোর্ট ছেড়ে সোজা তারা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সাহেদ হোসেনের বোনের বাড়ি সিলেটে। সবাই অনেক এক্সাইটেড বিয়ে নিয়ে। শুধু আরিয়া চুপ করে বাইরের পরিবেশ দেখছে। ইমন রিমা আর আইরা কে জালিয়ে মারছে। আরিয়ার মন খারাপ দেখে ওকেও জালাতে শুরু করেছে। আরিয়া চোখ গরম দিতেই ইমন ভিজে বিড়ালের মতো চুপ করে যায়।

দীর্ঘ একটা জার্নি শেষ করে সবাই পৌছে যায় সাহেদ হোসেনের বোনের বাড়ি। বাড়ির সামনে অনেক মানুষ দাড়িয়ে আছে। বিশাল বড় এক বাড়ি। গাড়ি থেকে নামতেই সবাই তাদের নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। আরিয়া আর আইরার সাথে সবাই পরিচিত হলো। এতদুর জার্নি করার জন্য অনেক ক্লান্ত সবাই। তাই যে যার রুমে চলে যায়। সাহেদ হোসেনের বোনের ২ মেয়ে। বড় মেয়ে মিষ্টি তারই বিয়ে উপলক্ষে আসা। ছোট মেয়ে দিয়া। অনার্স ৩য় বর্ষে আরিয়ার সাথেই পড়ে। অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে।সবার সাথেই মিশুক স্বভাব তার।বোনের দেবরের এক মেয়ে ২ ছেলে। মেয়েটা আরিফা দেখলেই বুঝা যায় কতটা অহংকারী। সেও দিয়ার সাথেই পড়ে। আর ২ ছেলে আশিষ আর আশিক। দুজনেই ছোট। স্কুলে পড়ে।
দিয়া আরিয়াকে দোতলায় নিয়ে গেলো। অনেক বড় বাড়ি। অনেকগুলো রুম। দিয়া আরিয়াকে রুমে রেখে চলে যায়। আরিয়াকে যে রুমে রেখে গেছে তার সাথেই ছোট একটা বারান্দা। আরিয়া বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বারান্দায় দাড়ায়। হঠাৎ ই আরিয়ার কানে আসে সুমধুর এক গিটারের আওয়াজ। গিটারের সাথে সাথে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা কন্ঠে গাওয়া ২ লাইন গান।

“” ডুবে ডুবে ভালোবাসি’
তুমি না বাসলেও আমি বাসি”

এই ২ লাইনই আরিয়ার কানে ভেসে এসেছে। লাইন ২ টা শেষ হতেই গিটারের শব্দও বন্ধ হয়ে গেলো।আরিয়া বুঝলো গান গাওয়া শেষ। সেও বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ক্ষীন স্বরে বলে উঠলো,,

“” ভালোবাসি…..

চলবে…

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ❤️❤️

হ্যাপি রিডিং😊

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here