তোমায় ঘিরে #শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব- ১২

#তোমায় ঘিরে
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১২

কলিং বেল চাপতেই সিয়ামের মা দরজাটা খুলে এত রাতে ধরীতাকে দেখে থমকে গেল। মুখটা হা করে ধরীতাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল। তারপর চোখগুলো বড়ো বড়ো করে সিয়ামের বাবাকে ডাকতে ডাকতে বলল

“সিয়ামের বাবা দেখে যাও তোমার ছেলের কান্ড। এ তো দেখি পুরো রাজরাণী নিয়ে হাজির। ”

কথাটা বলেই সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল

“এর নামেই কী ধরীতা?”

ধরীতা সিয়ামের মায়ের মুখে নিজের নাম শুনে কিছুটা বিস্মিত হলো। সিয়াম মায়ের প্রশ্নের উত্তরে বলল

“এর কথায় তোমাকে বলেছিলাম মা। তোমাদের সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে আসলাম।”

এর মধ্যেই সিয়ামের বাবা উপস্থিত হলেন। সিয়ামের দিকে তাকালেন অতঃপর ধরীতার দিকে তাকালেন। ধরীতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন

“মাশআল্লাহ আমার ছেলের পছন্দ ভালো। আসো আসো ঘরে আসো মা। বাইরে কত দাঁড়িয়ে থাকবে?”

ধরীতার চোখগুলো ছলছল করছে। জীবনের প্রথম কেউ তাকে মা বলে সম্বোধন করেছে। বাবার বয়সী একজন তাকে মা বলে ডাকছে বিষয়টা তাকে আবেগী করে তুলল। চোখের কোণে স্থিত জল আর আটকে রাখতে পারল না। দ্রূত জলটা বৃষ্টি করে নামিয়ে দিল। ধরীতাকে এভাবে কাঁদতে দেখে সিয়ামের বাবা প্রশ্ন করলেন

“তুমি কাঁদতেছো কেন মা? তোমার কী খারাপ লাগছে?”

ধরীতা নিজের চোখের জল মুছে বলল

“বাবার বয়সী কেউ একজন মা বলে ডাকল। বাবার মুখে মা ডাক শোনার সৌভাগ্য কখনও হয়নি। মামা সবসময় হতচ্ছারী বলেই ডেকেছেন। আপনার মুখে মা ডাকটা শুনে আবেগটা আর সামলাতে পারলাম না। ভীষণ ভালো লাগছে। এক প্রকার বলা চলে আনন্দ থেকেই এ চোখের জল।”

সিয়ামের বাবাও ধরীতার কথা শুনে আবেগী হয়ে গেলেন। গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন

” এখন থেকে তুমিই আমার মেয়ে। এসো ঘরে এসে আগে বসো। এভাবে আর কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে?”

ধরীতা চোখের কোণের জলটা মুছে নিজেকে সামলে নিল। সিয়াম শুধু নীরব দর্শকের মতো সব পরিদর্শন করছে। তার পরিবার এত সহজে ধরীতাকে আপন করে নিবে বুঝতে পারেনি। এতে তার মোটেও খারাপ লাগছে না। বরং বেশ ভালোই লাগছে। ধরীতা রুমে প্রবেশ করলো। সিয়ামের মা ততক্ষণে রাতের খাবার টেবিলে দিয়ে ধরীতা আর সিয়ামকে বলল ফ্রেশ হয়ে আসতে।

অতঃপর সবাই খাবার টেবিলে বসলো। খাবার খেতে খেতে সবাই বেশ আড্ডা দিল। খাওয়া শেষে ধরীতা সিয়ামকে বলে উঠল

“বাসায় যেতে হবে। রাতে বাইরে থাকা ঠিক হবে না। মা চিন্তা করতে পারে।”

সিয়াম আর কথা বাড়াল না। ধরীতা সিয়ামের বাবা, মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বের হলো। রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছে। সে সাথে চাঁদের মূর্ছনায় সবকিছু আলোকিত। ধরীতা সিয়ামের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল। সিয়াম এক হাত দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে অন্যহাত দিয়ে ধরীতার হাতটা ধরে রেখেছে। সবমিলিয়ে জার্নিটা বেশ ভালোই লাগছে দুজনের। শরীরের জ্বরটা পুরোপুরি না কমলেও ধরীতার এত খারাপ লাগছে না। গাড়িটা গন্তব্যে পৌঁছাল। রাত তখন বেশ গভীর। সিয়াম গাড়ি থামাতেই ধরীতা গাড়ি থেকে নেমে গেইটে ঢুকতেই ধরীতার মামী ধরীতার দিকে বাসনপত্র ছুড়ে দিতে লাগল। আর বলতে লাগল

“যে নাগরের সাথে রাত কাটিয়েছিস সে নাগরের কাছে যা না। এত রাতে বাড়িতে এসেছিস কেন? মা*গি মেয়ে একটা। লাজ লজ্জা নেই। বাড়ি থেকে বের হ।”

সিয়ামের কানে কথা গুলো যেন দ্রূত বেগে ধেয়ে আসলো। সে দ্রূত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো। ধরীতার হাত ধরে জোরে টেনে এনে গাড়িতে বসালো। তারপর গাড়িটা দ্রূত গতিতে চালাতে লাগল। ধরীতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাহিনি বুঝার চেষ্টা করছিল হতভম্ব হয়ে। তারপর সিয়ামকে বলল

“তুমি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”

সিয়াম উত্তরে বলল

“তোমার বাসায়।”

ধরীতা বিস্ময় নিয়ে বলল

“আমার বাসা থেকেই তো তুমি টেনে আনলে। আমার আবার আর কোন বাসা?”

সিয়ামের সাবলীল উত্তর

“বিয়ের পর স্বামীর বাসায় মেয়েদের বাসা। আজকে রাতে তো কাজী অফিস খোলা পাব না। নাহয় বিয়ে করেই বাসায় নিয়ে যেতাম। এখন আপাতত বাসায় রাতটা থেকে সকালে বিয়ের ব্যবস্থা করব। তোমাকে আর কথা শুনে ঐখানে থাকতে হবে না। তোমার মাকেও নিয়ে আসব আমাদের সাথে। ”

সিয়ামরে কথা শুনে ধরীতা হুহু করে কেঁদে উঠল। ধরীতার কান্না শুনে সিয়াম গাড়িটা থামিয়ে বলল

” কাঁদতেছো কেন? আমার সিদ্ধান্তে তুমি হ্যাপি না?”

ধরীতা সিয়ামকে আচমকা জড়িয়ে ধরল। তারপর বলে উঠল

“আমি বুঝতেই পারিনি তুমি আমাকে এত ভালোবাসো। সত্যি বলতে অধরা ঠিকেই বলেছিল হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন এক না তেমনি সব পুরুষমানুষ এক না। আমি তোমার সিদ্ধান্তে অনেক খুশি। এতদিনের সকল কষ্টের গ্লানি মুছে যাবে।”

ধরীতা আর সিয়াম গাড়ি নিয়ে এগুচ্ছে। চাঁদটাও তাদের সাথে এগুচ্ছে। ছোটোবেলায় ধরীতা চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবত চাঁদ ও কী তার সাথে হাঁটে নাকি। সে যেখানে যায় চাঁদও সেখানে। আজকে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তার একই কথা মনে হচ্ছে। সিয়ামকে হালকা হেসে বলল

“ছোটো বেলায় চাঁদকে নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন কাজ করত। এই যেমন চাঁদটা আমার সাথে হাঁটছে কি’না বড়ো হয়েও আমার এমন মনে হচ্ছে এখন।”

সিয়াম উত্তর দিল

“তুমি এখনও মনের দিক থেকে বড়ো হওনি। ছোটই আছো। বড়ো হলে যাকে তাকে ধরে পিটাতে না।”

“হুহ পিটিয়েছিলাম বলেই তো আমাকে পেয়েছো। ”

সিয়াম ধরীতার কথা শুনে জোরে হেসে বলল

“যাক তোমার পিটানোর একটা ভালো কাজ তো হলো। বিয়ের পর গুন্ডামির স্বভাব দূর করতে হবে। একটু সংসারী আর পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে। ”

“আমার বয়েই গেছে তোমার সব কথা শুনতে।”

“কথা না শুনলে ক্লাসে সবার সামনে পানিশমেন্ট দিব।”

“হুহ বললেই হলো।”

“মিলিয়ে নিও।”

“আচ্ছা তুমি না বলেছিলে তোমার বোন আছে। তোমার বোনকে তো বাসায় দেখলাম না।”

“আমার আপন বোন না যদিও। আমার খালাত বোন। তবে আমাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করে। ও থাকলে তোমার সময় আরও ভালো কাটত। বেশ শান্তশিষ্ট মিশুক। এবার ইন্টার পরীক্ষা দিবে। এখন খালার বাসায় গেছে। কালকে তো আসবেই। আমাদের বিয়েতে তো কাছের মানুষগুলো থাকবে। তোমার মাকেও তো আনতে হবে। সাথে তোমার মামা, মামীকে। সবাইকে উপস্থিত রেখেই বিয়ে করব ইনশাআল্লাহ। ”

“আল্লাহ আমার সময় এত সুন্দর করে পাল্টে দিবেন কে জানত। তোমার মতো জীবনসঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি তোমার মতো কাউকে জীবনে পেতে চলেছি এটাই অনেক বড়ো পাওয়া।”

“কী ব্যাপার গুন্ডা মেয়েটা এত ভালো কথা জানে জানতাম না তো। ”

“হুহ আমাকে শুধু শুধু গুন্ডা বললে খুন করে দিব। ”

“থাক ভয় পেয়েছি আর বলব না।”

গাড়িটা এসে সিয়ামের বাড়ির সামনে থামল। সিয়াম ধরীতাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর পুনরায় প্রবেশ করে বাবা, মাকে সব বুঝিয়ে বলল। সিয়ামের বাবা মায়ের কোনো আপত্তি নেই কারণ তাদের ছেলে বিয়ে করছে এটাই তাদের বড়ো পাওয়া। সিয়াম আর ধরীতা সোফায় বসে আছে। সিয়ামের বাবা, মা কাছের আত্মীয় গুলোকে কল দিতে লাগল কাল সকালে আসার জন্য। ধরীতার মামা, মামীকে সিয়াম কল দিয়ে বলল ধরীতার মা আর অধরাকে সাথে নিয়ে আসার জন্য।

কিছুটা হুমধুম করতে করতেই রাত কেটে গেল। সকাল বেলা সিয়ামের মা ধরীতাকে উনার বিয়ের শাড়িটা পরিয়ে গয়না পরিয়ে দিলেন। হালকা সাজিয়ে দিলেন। ধরীতাকে এমন সাজে দেখে সিয়ামের চোখ ভড়কে গেল। মনে হচ্ছিল স্বর্গ থেকে কোনো রমণী পমথিবীতে নেমে এসেছে। সত্যি বলতে প্রতিটা মানুষের চোখে তার ভালোবাসার মানুষ অনেক সুন্দর।

আস্তে আস্তে সকাল বাড়তে লাগল আর সিয়ামের আত্মীয় স্বজন ও চলে আসলো। সিয়ামের খালাত বোন তুষা এসে ধরীতার সাথে কথা বলা শুরু করল।

কাজী আসাও শেষ। শুধু ধরীতার পরিবারের মানুষ আসা বাকি। মিনেট পনেরোর মধ্যে উনারাও চলে আসলেন। ধরীতার মা ধরীতাকে এমন অবস্থায় দেখে থমকে গেলেন। আর অধরার মনে খুশির প্রহর জাগছে। আর ধরীতার মামীর কান্ড যেন কাহিনির নতুন প্রাণ দিল। কারণ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here