তোর অপেক্ষায় পর্ব-১১

0
3316

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১১

গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে তপ্ত বাতাস।বাইরে কড়কড়ে রোদের উপস্থিতি।কপালে ঘাম জমেছে বিন্দু বিন্দু। বাতাসের সাথে আমার কাটা চুলগুলো দুলছে।আবহাওয়ায় কেমন যেন ভাপসা গরমের অনুভূতি।তবুও জার্নিটা ভীষণ আরামদায়ক লাগছে।
আমার পাশে সিটে মাথা হেলিয়ে ঘুমে অচেতন সুহানা আপু।তাঁর অপর পাশে জেরিন আপু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে আপনমনে।আমরা তিনজন বসেছি মাইক্রোর মাঝের সারিতে।সামনের সারিতে ড্রাইভার এবং খালু।খালুর কোলে ফারাজ।আর পেছনের সিটে অবস্থান করছে মা,খালামণি এবং অহনা আপু।সকাল সতাটায় নানুর বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়েছি এখন বাজছে নটা।আরো একঘন্টার মত পথ বাকি।

আমার মন মেজাজ দুটোই এখন ফুরফুরে। গাড়িতে অনবরত বাজতে থাকা রোমান্টিক গানের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছি।আজকের এই জার্নিতে আমার খুশির একমাত্র কারণ দুর্জয় ভাইয়ার অনুপস্থিতি।
গাড়িতে উঠার সময় যখন খালামণি বলেছিল দুর্জয় ভাইয়া আমাদের সাথে নানু বাড়ি যাচ্ছে না তখন ইচ্ছে করছিল গাড়ির ছাদে উঠে নাগিন ডান্স দিই।এমন একটা সুখবর আমার জন্য রাখা ছিল এটা যদি গতকাল রাতেও জানতে পারতাম তাহলে রাতের ঘুমটা আরো গাঢ় হত।
দুর্জয় ভাইয়া আমার আশেপাশে নেই ভাবতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠতে চাইছে।নানুর বাড়িতে তাহলে ভালোই সময় কাটবে।ইচ্ছেমত ঘুরব ফিরব গাইব।কোনো বাধা নেই।কারোর তীক্ষ্ণ চোখের চাউনির সম্মুখীন হতে হবে না।কারোর ত্যাড়া ত্যাড়া কথা শুনতে হবে না।

বাইরের প্রকৃতি দেখতে দেখতে একসময় গাড়ি গ্রামের রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করল।তাহলে নানুর বাড়ি এসে গেছি প্রায়।জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সতেজ হাওয়া মেখে নিলাম।এতক্ষণের সব ক্লান্তি যেন মুছে গেল।
পনেরো মিনিট পর গাড়ি এসে থামলো নানু বাড়ির সামনে।সুহানা আপুকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে জাগিয়ে বললাম,

‘ এসে গেছি।উঠবে না!যাত্রার শুরুতেই ঘুমানো শুরু করলে তুমি তো দেখি এখানে আমাদের সব প্ল্যান বাতিল করে দেবে।’

সুহানা আপু হেলতে দুলতে বেরিয়ে আসলো।বাড়ির উঠোনে ঢুকতে দেখি নানু এবং মামা মামী দাঁড়িয়ে আছে।মামতো ভাই বোন দুটো দৌড়ে এসে স্বাগতম জানালো আমাদের। সাগর এবং ঝিনুক দুজন যমজ। ওরা সামনের বছর ভর্তি হবে স্কুলে।দেখতে ভীষণ কিউট।দেখলেই বুঝা যায় ওরা দুটোই আভিজাত্যে মোড়া।
সবার সাথে কুশল বিনিময় করে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করলাম।আমার নানাভাইয়ের শখের এই দোতলা বাড়িটি।দেখতে পুরানো হলেও ভেতরটা অসুন্দর নয়।সমস্যা হচ্ছে মাসের পর মাস এই বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে।নানুসহ মামা মামী ঢাকা থাকেন স্থায়ীভাবে।যখনই সবাই বেড়াতে আসি তখন বাড়ি ঝাড়পোঁছ করা হয়।নানাভাই মারা গেছে প্রায় সাত-আট বছর হবে।এরপর থেকেই এই বাড়ি তাঁর নতুনত্ব হারিয়েছে।মায়ের থেকে মাঝেমাঝে নানাভাই এবং তাঁর এই শখের বাড়ি নিয়ে অনেক গল্প শুনি।

এদিন আর বাড়ি থেকে বের হতে পারলাম না।মামা মামীরা গতকাল এসেছিলেন তাই সমস্ত বাড়ি ভালোকরে পরিষ্কার করা হয় নি।তাই মা ধমকে ধমকে আমাদের মেয়েদের গ্রুপটাকে দিয়ে অর্ধেক কাজ করিয়ে নিলেন।
কাজ শেষে শ্রান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে আর বাইরে বেরোতে মন চাইলো না।তবে হাসি-ঠাট্টার মাঝে দিনটা বেশ ভালোই কেটেছে।আসার সময় গাড়িতে জেরিন আপুর মধ্যে যে উদাসীন ভাব দেখেছিলাম সেটা আর ছিল না।সবার সাথে মিষ্টি করেই কথা বলেছে।

_____________________________

সকাল সকাল কাকের বিদঘুটে কা কা শব্দে ঘুম ভাঙলো।আজ বুঝতে পারলাম মোরগের ডাকের চেয়ে কাকের ডাক আরো বিচ্ছিরি। মুখ দিয়ে বিরক্তিমাখা আওয়াজ তুলে উঠে বসলাম বিছানায়।
জানালার শিক গলিয়ে একফালি রোদ এসে ঢুকেছে ঘরে।পাশেই জারুল গাছটায় একটা কাক সমস্বরে ডেকে চলেছে।দুহাতে কান চেপে বলে উঠলাম,
‘ অসহ্য। ‘

আমার সাথেই আপুরা ঘুমিয়ে আছে।কা কা শব্দে ওদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।গায়ে উড়না জড়িয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলাম করিডোরে।বাইরে উঠোনে এবং গাছপালার সর্বাঙ্গে রোদ মাখামাখি। নিশ্চয়ই অনেক বেলা হয়ে গেছে।কেউ তো আমাদের ডাকেও নি।উঠোনে একজন লোক হাতভর্তি বাজার নিয়ে হেঁটে আসছে।দেখে মনে হচ্ছে আজ খাওয়াদাওয়ার বিশাল আয়োজন হবে।
হঠাৎই নিচতলা থেকে ইমন ভাইয়ার কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।ভ্রু কুঁচকে উঠল আমার।সাতসকালে ভাইয়া কোত্থেকে আসবে?ভুল শুনলাম নাকি।কান খাড়া করতেই স্পষ্ট ইমন ভাইয়ার হাসির শব্দ শুনতে পেলাম।তারমানে আমাদের টানে টানে ভাইয়া ঠিক এখানে চলে এসেছে।ইয়াহু!ইমন ভাইয়া সাথে থাকা মানেই প্রতিটা সেকেন্ড মজায় কাটবে।
টপাটপ সিড়ি দিয়ে নামতেই দেখলাম ইমন ভাইয়া বসে আছে সোফায়।নানুর সাথে কথা বলছে।আমাকে দেখতে পেয়ে বলে উঠল,

‘ শুভসকাল! কেমন চমকে দিয়েছি বল্!বাকি কাজের লোকগুলো কোথায়?এখনো ঘুমাচ্ছে?’

ভাইয়ার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল।কি সুন্দর হাসি হাসি মুখ করে আমাদের ইনসাল্ট করে চলেছে!

‘ ভাইয়া আমাদের কাজের লোক বলছো কিন্তু তুমি তো এই কাজের লোকদের ছাড়া থাকতে পারোনি বলেই সকাল হতে না হতে ছুটে এসেছো।’

‘ তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।কিন্তু আমাদের অন্য একটা প্ল্যান ছিল।দেখ তোদের সাথে আসলে বাড়ি ক্লীন করার বেশিরভাগ কাজ আমাদের করতে হত যেমনটা অন্যবার করে থাকি।আর আজ আসাতে কিছুই করা লাগছে না।বাড়ি একেবারে ঝকঝকে তকতকে।সব তো তোরাই করে ফেলেছিস।’

আমাদের শব্দটা শুনতেই আমার কেমন যেন সন্দেহ লাগল।ভাইয়ার সাথে নিশ্চয়ই আরো একজন এসেছে।চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ভালো করে দেখে নিলাম।মাথা উঁচু করে বাইরের উঠোন যতটুকু এখান থেকে দেখা যায় সবটা নজর বুলিয়ে নিলাম।কই কেউ তো নেই।মনটা কেনো জানি কু ডাকছে।যদি দুর্জয় ভাইয়া এসে থাকে? না না।আল্লাহ্ ওই লোক যেন না আসে।যদি এসেও থাকে আমার সামনে আসার আগেই তুমি কিছু একটা করে উনাকে আবার শহরে পাঠিয়ে দাও।
মনের সন্দেহ চেপে রাখতে না পেরে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ তোমার সাথে আর কে এসেছে ভাইয়া?’

‘ আর কে আসবে।দুর্জয়।ওই তো ওখানে।’

ভাইয়ার ইশারা অনুসারে তাকালাম।দুর্জয় ভাইয়া তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে ড্রয়িংরুমে ঢুকছেন।উনার শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত এবং প্যান্ট হাঁটুর কিছুটা নিচে পর্যন্ত গুটানো।কপালের চুলগুলো হালকা ভেজা।চোখে সেই সূক্ষ্ণ চাউনি খেলা করছে।

আমি ইমন ভাইয়ার পেছনে সোফার নরম অংশ খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছি।শরীরে সেই অস্বস্তি ভাবটা আবারো হানা দিচ্ছে। উনি সোফায় এসে বসতেই চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।
ইমন ভাইয়া বললেন,
‘ তুই একটু বোস দুর্জয়। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি এরপর বাইরে যাবো।গিভ মি ফাইভ মিনিটস্।’

নানুকে নিয়ে ইমন ভাইয়া ভেতরের রুমে চলে গেলেন।ড্রয়িংরুমে শুধু আমি এবং দুর্জয় ভাইয়া। এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছি আমি।আজ একটু বেশিই ছটফট লাগছে উনার সামনে।হয়তোবা অনেকদিন পর দেখা হয়েছে এজন্য। সেই যে রাস্তায় উনার গাড়ি করে বাড়ি ফিরেছিলাম আর দেখা হয়নি।এমনকি কথাও না।

ভেতরের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ডেকে উঠলেন উনি।লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে ফিরলাম।মন বলছিল আমি যেতে নিলেই উনি ডাকবেন আর হলোও তাই।
উনি দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন।

‘ আমার সামনে আসলেই তুই ভিন্ন গ্রহের প্রাণী হয়ে যাস।কারণটা কি বলতো?নাকি তুই আমাকেই ভিন্ন গ্রহের প্রাণী ভাবিস?যখনি তুই আমার মুখোমুখি হোস তখনই পালিয়ে বেড়াতে চাস্ যেন আমি তোকে অ্যাটাক করতে আসছি।আমি জানতে চাই সমস্যাটা কার মধ্যে? আমার নাকি তোর?’

দুর্জয় ভাইয়ার কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে রাখলাম।উনি আবারো এই প্রশ্নগুলো করছে।উনাকে কি করে বুঝাই এগুলোর কারণ তো আমি নিজেও জানি না।অনেক ভেবেছি কিন্তু উত্তর মেলেনি।
ডানেবামে তাকাতে তাকাতে বললাম,
‘ দ..দেখুন এসব আপনার ভুল ধারণা।আমি মোটেই পালিয়ে বেড়াই না।’

‘ তাই?কিন্তু আমি তো এখানে বসে থেকেও বুঝতে পারছি তোর হার্ট স্বাভাবিকের চেয়েও দ্বিগুন গতিতে চলছে।তোর চোখমুখই তা জানান দিচ্ছে। ‘

আমি আস্তে করে ঢোক গিললাম।কিন্তু মনে হচ্ছে গলায় কোনো শক্ত কাটা বিঁধে রয়েছে।এই লোক আসতে না আসতেই আমাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে দিচ্ছে। কেউ তো বাঁচাও আমায়।
এমন সময় ইমন ভাইয়া গান গাইতে গাইতে চলে আসলেন।বেসুরে গলার গানে চারপাশের দেয়ালগুলো যেন কেঁপে উঠছে।
দুর্জয় ভাইয়া সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বিরক্তির সাথে বলে উঠলেন,
‘ স্টপ ইয়ার।মেরে ফেলতে চাইছিস নাকি?’

‘ আরে শালা তোকে মারলে তোর বিয়ে খাব কেমনে?’

উনারা দুজন গলাগলি করে বেরিয়ে গেলেন।হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।গলায় বিঁধে থাকা কাঁটাটা আর নেই।ইমন ভাইয়াকে মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম।সঠিক সময়ে এসে ওই গোয়েন্দা থেকে বাঁচিয়ে দিল আমায়।

.

সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হয়ে গেল।ইমন ভাইয়া এবং দুর্জয় ভাইয়া সেই যে গেলেন গ্রাম ঘুরতে আর আসার নামই নেই।ফোন দিলে বলে যে আর পাঁচমিনিট।কিন্তু সেই পাঁচ মিনিট বোধ হয় আজ শেষ হবে না।নানু বারংবার উঠোনের দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে উনাদের বকে চলেছে।আজ নাকি বাড়িতে ঢুকতেই দেবেন না তাঁদের।আমি ঠাট্টার সুরে বললাম,

‘ আসলে কি বলো তো নানু ওরা হলো শহরে বাস করা বাঁধা গরু।সারাদিন অফিস,বাসা,ল্যাপটপ,ফোন এসব করেই দিন কাটে।এখন গ্রামে আসতেই এই গরু দুটো হয়ে গেছে বাঁধন ছাড়া তাই খোয়ারে ফিরতে ওদের মন চায় না।’

আমার কথায় বাড়ির উঠোন জুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল।মা আমাকে আস্ত একটা ধমক দিয়ে চুপ করাতে চাইল।তাতে যেন আমার হাসির বেগ আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল।
তবে একটা ব্যাপার বার বার চোখে আটকাচ্ছিল।জেরিন আপুর ব্যবহার কেমন যেন লাগছে।মনে হচ্ছে কোনো একটা বিষয় নিয়ে খুব আনন্দিত।সব কথাতেই বেশি বেশি হাসছেন।যেখানে হাসার দরকার নেই সেখানেও শব্দ করে হাসছেন।আপুর হাবভাব কিছুই ঠাওর করতে পারছি না।কখনো দেখি মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়ায় আবার কখনো হাসিখুশি।এগুলো অন্য কারো চোখে না পড়লেও আমার পড়ছে।কি জানি আমার মনের ভুলও হতে পারে এটা।

দুপুরের খাবার শেষে লম্বা একটা ঘুম দিলাম আপুদের সাথে।যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি তপ্ত রোদ পশ্চিম দিক বরাবর।রোদের তেজ এখন কম।দোতলা থেকে সবাই মিলে উঠোনে নেমে দেখলাম মা,খালামণি,মামা-মামী এবং নানু মিলে আড্ডা দিচ্ছে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে।ফারাজ বারান্দায় খেলছে আপনমনে।তাঁদের থেকেই জানতে পারলাম আমরা রুমে যাওয়ার পর ভাইয়ারা এসে ঝটপট নাওয়াখাওয়া শেষ করে আবার বেরিয়ে গেছেন।আমার জন্য ভালোই হয়েছে।অন্তত দুর্জয় ভাইয়ার সামনে তো যাওয়া লাগছে না।ওই লোক যতক্ষণ আমার থেকে দূরে থাকে ততক্ষণই আমি খোশ মেজাজে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতে পারব।

চলবে…

[ পর্বটা ভালো হয়নি বোধ হয়।একটু তাড়াহুড়ায় লিখেছি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here