দিন কেটে যায় আশায় আশায় পর্ব-২

0
391

দিন কেটে যায় আশায় আশায়

দ্বিতীয় পর্ব

হাত কাটল কি করে ?
আমি অবাক হয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি হাতের উপরের অংশ কেটে গেছে i জামার হাতা ছিড়ে তার পাশে রক্ত লেগে আছে I তখনই মনে পড়ল রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা রিক্সা ধাক্কা দিয়েছিল I আরো খারাপ অবস্থা হতো যদিনা ঐ লোকটা আমাকে ফুটপাতের উপর টেনে তুলতো I লোকটাকে একটা ধন্যবাদ ও দেওয়া হল না I আমি কাটা অংশটায় একবার হাত বুলিয়ে নিলাম I বিশেষ একটা পাত্তা দিলাম না I স্কার্ফ দিয়ে ছেঁড়া অংশটা ঢেকে ফেললাম I জুই অবশ্য ছাড়লো নাI জোর করে অফিস রুমে নিয়ে গেল I সেখান থেকে অ্যান্টিসেপটিক লিকুইড নিয়ে হাতে লাগিয়ে দিল সাবধানে I একটু জ্বলুনি হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু যে পরিমাণ মাথা গরম হয়ে আছে তাতে ঠিক হাতের জ্বলুনি টের পেলাম না I জুই আবারো জিজ্ঞেস করল
কি হল বললি না , কেমন করে কাটলো ?
আমি বলতে চাচ্ছিলাম তার আগেই শুনলাম পাশে দুজন গল্প পরছে I গল্পের বিষয়বস্তু শুনে মাথায় আবার আগুন ধরে গেল I দুজনের কথোপকথন অনেকটা নিম্নরূপ
এই জানিস , একটু আগে কি হয়েছে ?
না তো , কি ?
নীচে চায়ের দোকানের সামনে নাকি কয়েকজন ছেলে মিলে একটা মেয়েকে রেপ করার চেষ্টা করছিল
কি বলিস !
হ্যাঁ I তা সে মেয়ে ও নাকি মেরে ধরে ছেলে গুলোর হাত পা ভেঙে দিয়েছে
আল্লাহ সত্যি ! কি ভয়ঙ্কর !
এটুকু শুনেই আমার আর শোনার ধৈর্য থাকলো না I একটা ঘটনা কিছুক্ষণের মধ্যেই এরকম বিকৃত হয়ে যায় কি করে , ভেবে পেলাম নাI আমি কিছু না বলেই নিচে নেমে গেলাম I

আজকের দিনটাই খারাপ I আমি লক্ষ্য করে দেখেছি , যেদিন সকালটা খারাপ ভাবে শুরু হয়, পুরোটা দিনই খারাপ যায় I এই যেমন আজকে সকালে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম I ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছে I তাই ভাবলাম তাড়াহুড়া করে একটু খেয়ে বেরিয়ে পড়বো I ডাইনিং টেবিল এসে দেখি দুলাভাই নাস্তা খাচ্ছে Iসামনে গরম পরোটা, আলু ভাজি I পাশে ধূমায়িত চায়ের কাপ Iমেজাজটা একটু খারাপ হলো I কাল রাত থেকেই আপার শরীরটা খারাপ I

আপার চার মাস চলছে I প্রথম তিন মাস আরো খারাপ অবস্থা ছিল I ঘুম থেকে উঠেই বমি করত I এ সময়ে আমি সকালবেলা উঠে সব কাজ করে দিতাম Iদুলাভাইকে বলেছিলাম এই কদিন আমরা পাউরুটির মাখন জ্যাম এগুলো দিয়েই নাস্তা করি I আমার কথা শুনে প্রথমে হ্যাঁ হ্যাঁ করলেও দিন শেষে যখন বাড়ি ফেরে তখন ঠিকই হাত করে শুধু কলা আর ডিম নিয়ে আসে I তারপর সকালবেলা উঠেই নাস্তা চাইতে থাকে I তখন বাধ্য হয়েই আপাকে রুটি তরকারি করতে হয় I

যাই হোক তিন মাসের পর থেকে আপার শরীর একটু একটু করে ভালো হতে শুরু করল I তারপর ও খুব ক্লান্ত থাকে I তেমন একটা খেতে পারে না I আমি আর টেবিলে না বসে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম আপা গলদঘর্ম হয়ে পরোটা ভাজছে I আমাকে দেখেই বলল
তুই তাড়াতাড়ি একটা পরোটা খেয়ে নে Iতোর তো বের হতে হবে এখনই

দুলাভাই বোধহয় আঁড়িপেতেই ছিল I তাড়াতাড়ি করে ডাইনিং থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো
আমার আরেকটা পরোটা লাগবে
আপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I কিছু বলল না I আমি বললাম
আমার সময় নেই রে I আমি একটা কলা খেয়ে চলে যাচ্ছি
টেবিলের কাছে এসে দেখলাম I তিনটা কলা পড়ে আছে I দুলাভাই প্রতিদিন আসার সময় এক হালি ডিম আর এক হালি কলা নিয়ে আসে I একটা করে আমরা সকালে খাই I আর তার নিজের জন্য বিকালে একটা থাকে I তিনটা দেখে আমি ভাবলাম দুলাভাই হয়তো তার টা খেয়ে নিয়েছে I আমাকে আসতে দেখেই একটা কলার খোসা ছাড়িয়ে গপাগপ খাওয়া শুরু করল I আর আরেকটা ছিড়ে পাশে রেখে দিল I ভাবখানা এমন যে আরেকটা আছে তোমরা যে ইচ্ছা খাও I আমি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছি দেখে বলল

কলার দাম হালিতে দুই টাকা বেড়ে গেছে , বুঝলে সুমু I এখন থেকে আর প্রতিদিন চারটা করে কলা আনতে পারবো না I তোমার ভার্সিটির সামনে তো দোকানে কলা পাওয়া I তুমি ওখান থেকে কিনে একটা খেয়ে নিও I

প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলেও আমি কিছু বললাম না I রান্নাঘরে গিয়ে আপাকে বললাম
সর ,আমি পরোটা বেলছি I তুই খেতে বস
আপাকে রুটি আলু ভাজি দিয়ে টেবিলে বসিয়ে আমি চট করে একটা পরোটার ভেতর ভাজি দিয়ে মুড়ে পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিলাম I বেরোতে বেরোতে শুনলাম দুলাভাই আপা কে বলছে
আটা কিন্তু কালকেই এনেছি I এ সপ্তাহে আর আনতে পারব না I বুঝে শুনে রুটি করো I

আমি কিছু বললাম না I তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেলাম I একটু দেরি হলেই বাস মিস করবো I তখন আবার রিকশা নিতে হবে I ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম 8:30 বাজে I আমার ক্লাস 10 টা থেকে I দুইটা ক্লাস সাড়ে বারোটা পর্যন্ত তারপর আবার দুইটা থেকে ল্যাব I শেষ করতে করতে সাড়ে চারটা I

ক্লাস শেষ করে জুইয়ের সঙ্গে ক্যান্টিনে বসলাম I ক্ষুধায় মাথা খারাপ হবার অবস্থা I জুই কফির অর্ডার দিতে গেল I আমি ব্যাগ খুলে রুটিটা বের করতে গিয়ে দেখলাম ব্যাগ খালি I বোধহয় তাড়াহুড়ায় ব্যাগে নিতে ভুলে গেছি I আমি দূর থেকে হাত ইশারা করলাম যেন আমার জন্য চা কফি বা কোন খাবার না বলে I নিচে নেমে গেলাম I উল্টোদিকে একটা চায়ের দোকান আছে I ভাবলাম সেখান থেকে কম দামি কিছু কিনে নেব I কিন্তু যাওয়াটাই কাল হলো I জলহস্তী সাইজের এক লোক কি করে যেন গায়ে হাত দিয়ে বসলো I শালাকে অবশ্য এমন শিক্ষা দিয়েছি, এ জন্মে আর কোন মেয়ের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস করবেনা I হারামজাদাকে আরো দুটো লাথি দিতে পারলে মনে শান্তি আসত I

অফিস রুম থেকে নিচে চলে আসায় জুই ও আমার পেছনে পেছনে এল I আমি ইচ্ছা করেই ওকে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম I এই মেয়েটা আমাকে অতিরিক্ত রকমের ভালোবাসে I ওর সঙ্গে আমার পরিচয় ভার্সিটি কোচিং করতে এসে I তখন আমি সবে এইচএসসি পাশ করেছি I ঢাকায় এসে আপার বাসায় উঠেছি I আপার তখন বিয়ের এক বছর হয়েছে I এর আগে এখানে একবারই এসেছি I তখন অবশ্য দুলাভাই বেশ আদর যত্ন করেছিলেন I এবার কিছুদিন থাকব শুনে তার মুখ বেজার হয়ে গেল I আমি মনে মনে খুব আশা করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যাব I তারপর হলো উঠে যাব I স্বাধীন ভাবে নিজের মত থাকতে পারবো I কারো উপর বোঝা হতে হবে না I কিন্তু কপাল খারাপ I ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেলাম না I বাধ্য হয়ে একটা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম I হোস্টেল এর ব্যবস্থা ও ছিল I একদিন কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ জুই এর সঙ্গে দেখা I ও একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে I আমাকে খুব করে ধরল ,আমিও যেন ভর্তি হয়ে যাই I খরচের হিসাব শুনে আমি আর সাহস করলাম না I মনে খুব শখ ছিল ফার্মেসি কিংবা মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়বো I এর কদিন পর জুই ফোন করে বলল এক্ষুনি কেন সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে ভার্সিটিতে চলে আসি I আমার ভর্তির একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে I আমার রেজাল্ট ভাল থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল I সেমিস্টার ফি অর্ধেক করে আমাকে ভর্তি নিয়ে নেওয়া হলো I এতে একটাই সমস্যা হল আমাকে আপার বাসায় থাকতে হবে I আমি ভাবলাম থাকি কদিন Iএরপর একটা ব্যবস্থা করে নেব I কিন্তু সেই ব্যবস্থা আর হলো না I ওইভাবেই আড়াই বছর পার হয়ে গেল Iএরমধ্যে জুই এর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আরো গভীর হয়েছে I আমি শুরু থেকেই চেষ্টা করেছি কোনরকম মায়ায় না জড়াতে I চেষ্টা করেছি , যেন ওর কাছ থেকে কোন উপকার নিতে না হয় I তারপরেও আমার আর্থিক অবস্থা দেখে কি করে যেন ও আমার জন্য একটা টিউশনি যোগাড় করে ফেলল I ওর মামাতো বোনের মেয়ে I পাঁচ বছর বয়স I পড়ানোর কোন দরকার নেই I তবুও ওর মা চায় কিছুটা সময় যেন ওকে পড়ানো হয় I ওদের বাসায় যাওয়ার পর বুঝলাম ভদ্রমহিলা আসলে নিজের মত একটু সময় কাটাতে চান I মেয়েকে নিয়ে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন I আমি বিকেল বেলা যাইI কিছুক্ষণ তনুকে নিয়ে খেলি I খেলার ছলেই পড়াই I একসঙ্গে নাস্তা করি I তারপর চলে আসি I মা মেয়ে দুজনেই খুশি I যেদিন ওদের বাসায় যাই মনটাই ভালো হয়ে যায় I সপ্তাহে 5 দিন পড়াই I যা টাকা দেয় আমার চলে যায় I বাড়ি থেকে মা কিছু টাকা পাঠায় পড়াশোনা বাবদ I এর মধ্যে থেকে আবার দুলাভাইকে 2000 টাকা দিতে হয় I

এখনো প্রতিদিন মনে হয় হোস্টেলে উঠে যাই I যেতে পারিনা শুধু আপার মায়ায় I আমি চলে গেলে বড় অসহায় হয়ে যাবে ও I আমি থাকলে মনে অনেক জোর পায় I ছোটবেলা থেকেই ওর মনটা বড় নরম I

ভেবেছিলাম নিচে নেমে রিকশা নিয়ে বাসায় চলে যাব I আজকে আর বাস নিতে ইচ্ছা করছে না I কিন্তু জুই ছাড়লো না I জোর করে ওদের বাসায় নিয়ে গেল Iআমি প্রথমে রাজি হচ্ছিলাম না কিন্তু পরে মনে হল আমাকে এভাবে দেখলে আপা হয়তো ভয় পেয়ে যাবে I

জুই আমার হাতে ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল I পেইন কিলার এনে দিল I আমার কাপড় ছিড়ে গেছে বলে নিজের এক সেট জামা বের করে দিয়ে বলল, হাতমুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে নিতে I আমি পোশাক পাল্টে এসে যখন দেখলাম ও আমার জন্য ভাত বেড়ে দিয়েছে তখন নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে গেল I এত যত্ন পেতে আমি অভ্যস্ত নই I বিশেষত জুই কিংবা তার বাসার কারো কাছ থেকে I ওদের বাসায় আসাটা আমি সযত্নে এড়িয়ে চলি I এর অবশ্য একটা বিশেষ কারণ আছে I সেই কারণটা না হয় অন্যদিন বলবো I আপাতত খাবারে মনোযোগ দেই I

চলবে ……
লেখনীতে
অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here