দিন কেটে যায় আশায় আশায়
তৃতীয় পর্ব
গত তিনদিন ধরে চায়ের দোকানের সামনে বসে অপেক্ষা করি সুমাইয়ার জন্য I দেখা হলে আইডি কার্ড টা ফিরিয়ে দেয়া যেত I কিন্তু সুমাইয়ার দেখা পেলাম না I অবশ্য না পাবারই কথা I এখানে এসে ওর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে মনে হয়না আর এরকম জায়গায় আসবে I চতুর্থ দিনের মাথায় আমি নিজেই ওর ডিপার্টমেন্টে গেলাম I অফিস রুমে আইডি কার্ড টা ফেরত দিয়ে সঙ্গে একটা ছোট্ট চিরকুট দিয়ে এলাম I কাজটা করতে পেরে বেশ ভালো লাগলো I সেদিন থেকেই মনটা খচখচ করছিলো I
এরমধ্যে চার মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে I সুমাইয়ার ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম I এই চার মাসে অনেক কিছু বদলে গেছে I আমার বেশ ভালো একটা চাকরি হয়েছে I এত ভালো চাকরি হবে আমি নিজেও আশা করিনি I একটা বেসরকারি কলেজের লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি I মধ্যে একবার বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম I
আমার দেশের বাড়ি টাংগাইল এর পাহাড়পুর I আমাদের বসতবাড়ি ওখানেই I বাবা মারা গেছেন অনেক ছোটবেলায় I আমাদের যা জমি জমা ছিল, সেগুলো বিভিন্নজনকে চাষ করতে দিয়ে যা টাকা পাওয়া যেত ,তাই দিয়ে আমাদের চলে যেত I আমি আর আমার বড় বোন দুজনকে নিয়ে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি মাকে I বাবার আর কোনো ভাইবোন না থাকায় জমিজমা নিয়ে কোনরকম ঝামেলা হয়নি I তবে ঝামেলা হতো বুবুকে নিয়ে I ছোটবেলা থেকেই তার পড়াশোনায় মন নেই I ভীষণরকম প্রেমে পড়া স্বভাব I কখনো স্কুলের টিচার তো কখনো পাশের বাসার ছেলের প্রেমে পড়ছে I ওই রকম করেই কোনমতে মেট্রিক পাশ করার পর মা ঠিক করলেন ওকে আর রাখবেন না I এবার বিয়ে না দিলেই নয় I বুবু দেখতে যে খুব একটা আহামরি সুন্দরী তা নয় I তবে ওর মধ্যেএকটা আলগা চটক আছে I সহজ বাংলায় আমরা যাকে বলি ঢং I ভীষণ রকমের ঢঙ্গি একটা মেয়ে I চোখমুখ কুঁচকে এমন ভাবে কথা বলবে যে আশেপাশের মানুষ তাকাতে বাধ্য I যাই হোক কোনভাবে মেট্রিক পরীক্ষা হয়ে গেল I মা ঠিক করলেন রেজাল্টের আগেই যে করে হোক বিয়ে দিতে হবে I একবার ফেল করলে বিয়ে হওয়া মুশকিল I চারিদিকে পাত্রের সন্ধান চলতে লাগল I আমি তখন সবে ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠেছি I আমার স্বভাব বুবুর সম্পূর্ণ বিপরীত I পড়াশোনায় আমার অতিরিক্ত রকমের আগ্রহ I ঠিক করে রেখেছি কোনভাবেই এখানকার কলেজে ভর্তি হব না I যে করেই হোক ঢাকা চলে যাব I সেই কারণে দিনরাত্রি এক করে পড়াশোনা করছি I
যত সহজে বুবুর বিয়েটা হবে ভেবেছিলাম ব্যাপারটা তত সহজ হল না I এর অবশ্য দুটো কারণ I প্রথমত কোন ছেলেই তার পছন্দ হয় না I প্রত্যেকের মধ্যেই একটা করে ঝামেলা বের করে I আবার তাই বলে যে ছেলেগুলোর সাথে কথাবার্তা বলে না, তা না I দেখাদেখির পরপরই দেখা যায় ফোন নিয়ে গুজুরগুজুর করেই যাচ্ছে I তারপর কিছুদিন পর জানায় ছেলে তার পছন্দ হয়নি I আর দ্বিতীয় কারণটা হলো আপা মেট্রিকে থার্ড ডিভিশন পেয়ে বসল I যাই হোক কেউ রেজাল্ট জিজ্ঞেস করলে আমরা এড়িয়ে গিয়ে বলি, পাস করেছে I অন্তত মেট্রিক-ফেল তো বলতে হচ্ছে না I
এর মধ্যে আরও এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল I সামনে আমার টেস্ট পরীক্ষা I আমি গেটলক পড়াশোনা শুরু করে দিলাম I ঘরের মধ্যে থেকে বের হই না বললেই চলে Iশুধু নামাজ পড়তে মসজিদে যাই I খাওয়া-দাওয়া ঘরেই পাঠিয়ে দেয়া হয় I এরমধ্যে বুবু একদিন আমার ঘরে এসে তুলকালাম করল I হইচই চিৎকার-চেঁচামেচি I আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলাম I বিষয় কিছুই বুঝতে পারলাম না I অনেকক্ষণ পর তার কথার সারমর্ম বোঝা গেল I পাশের গ্রামের কোন এক ছেলেকে তার পছন্দ হয়েছে I আমরা যেন সেখানে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই I ছেলের বৃত্তান্ত শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল I অতি বাজে ছেলে I চ্যাংড়া ধরনের I পাড়ার মধ্যে মাস্তানি করে বেড়ায় I এরকম একটা ছেলেকে বুবুর কি করণে পছন্দ হলো বুঝা গেলোনা I আমি পড়াশোনা ফেলে মায়ের কাছে ছুটে গেলাম I বুঝিয়ে বললাম যে বেশি দিন বাড়িতে রাখা যাবে না I কখন আবার সেই চ্যাংড়া ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় I শুনে মা ও চিন্তায় পড়ে গেলেন I জরুরী ভিত্তিতে ঘটককে খবর দেওয়া হল এবং তিনদিনের মাথায় বুবুর বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল I ছেলে পাশের গ্রামেই থাকে I তার চালের আড়ত I পড়াশোনা বেশিদূর করেনি I কোন মতে বিএ পাস করেছে I বাবার আড়ত সেই সামলায় I আর কোন ভাই বোন নেই I একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার I আমি ভেবেছিলাম বিয়ের পর আপা হয়তো নানা রকমের ঝামেলা করবে I কিন্তু বিয়ের পর তাকে দেখে মনে হল যেন এই ছেলের সঙ্গে বহু দিনের পরিচয় I স্বামীর প্রেমে হাবুডুবু না একেবারে ডুবুডুবু অবস্থা I মা এবং আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম I
বিয়ের পর আপা পাশের গ্রাম নাগরপুরে চলে গেল I এসএসসির রেজাল্ট ভালো হওয়ায় আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম I আমার মা বেচারী একা পড়ে গেল I কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না I এক সময় মনে হল হলো কি হবে এত ভালো কলেজে পড়ে যদি মাই না থাকলো I সেই সময় বুবু শক্ত হাতে হাল ধরল I দুলাভাইসহ বাড়িতে এসে হুলুস্থুল কান্নাকাটি বাঁধিয়ে মাকে নিয়ে গেল I মা একেবারেই যেতে রাজি হচ্ছিল না I কিন্তু বুবুর জেদের সঙ্গে পারল না I তাছাড়া ওর অনেক গুণের মধ্যে একটা হল মানুষকে ম্যানেজ করা I কি করে যেন ও দুলাভাই কে একেবারেই বশ করে ফেলেছে I দুলাভাই রিমি বলতে অজ্ঞান I বুবুর ভয়াবহ রান্না খেয়েও সারাক্ষণ বাহবা দিতে থাকে I এবার বাড়ি গিয়ে আমি মাকে বললাম যেন সব রান্নাবান্না মাই করে I এই কথা শুনে বুবুর গাল ফুলে গেল I মা কোনমতে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করলেন যে, এতদিন পরে এসেছে; ওখানে কি নাকি খেয়ে থাকে মায়ের হাতের রান্না খেতে চায় I যাইহোক খেতে বসে দেখলাম সব রান্না মা করেছে শুধু ইলিশ মাছটা বুবুর করা I ঐরকম ভয়াবহ মাছের পদ আমি আমার জীবনে খাইনি I মাছের মধ্যে মন খানেক লবণ I তার ওপর মনে হয় হলুদ দেয়া হয়েছে কয়েক কেজি I বেচারা ইলিশ মাছটার জন্য মায়াই হচ্ছিল I কোনমতে ডাল, চিংড়ি ভর্তা আর মুরগির ঝোল দিয়ে খেয়ে উঠলাম I ততক্ষনে দুলাভাই আড়ত থেকে চলে এসেছে I আমার সঙ্গে খাবে বলে আগ্রহ করে বসলো I বেচারা দুলাভাইয়ের করুন পরিণতি দেখে দুঃখ হচ্ছিল I বুবু আহলাদে বিগলিত হয়ে এসে বলল
রাসু মাছটা খেতেই পারল না I তোমাকে বড় টুকরা টা দেই কেমন ?
দুলাভাই গদগদ হয়ে মাছ পাতে তুলে নিলেন I বেচারা মুখটা পর্যন্ত বিকৃত করতে পারলেন না বউয়ের ভয়ে I
যে কদিন বাড়ি ছিলাম খুব আনন্দে কাটলো I দুলাভাই সঙ্গে করে বাজারে নিয়ে গেলেন I অনেক গল্প করলেন I এত ভালো মনের মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি I আসার আগে আমার হাতে এক হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন
তোমার জন্য তো কিছুই করতে পারলাম না I তুমি কিছু একটা কিনে খেও I ভালো থাইকো রাসু I
আমার চোখ ভিজে উঠলো I আমার নিজের কোন বড় ভাই নেই I থাকলে ও এতটা ভালোবাসত কিনা কে জানে I মনে প্রাণে দোয়া করলাম যেন ওরা এভাবেই ভালো থাকে I
ঢাকায় ফেরার পর দেখলাম মাসুদের বেশ মন খারাপ I ওর ধারণা আমার চাকরি হয়ে গেছে বলে আমি হয়তো এখন এই বাড়ি ছেড়ে দেবো I এর মধ্যে যে দুজন ছাত্র ছিল তারাও চলে গেছে, খরচে পোষাতে পারছে না বলে I আমি মাসুদ কে আশ্বস্ত করে বললাম যে আমি আপাতত বাড়ি ছাড়ছি না I
নতুন কলেজে জয়েন করতে হবে আগামী মাস থেকে I সকালবেলা কাগজপত্র জমা দিয়ে সব ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে এলাম I ভয়াবহ গরম পড়েছে I গরমে আলু-ভর্তা অবস্থা I মানে বলতে চাইছি যে আলু রোদের মধ্যে ফেলে রাখলে নিজে নিজেই সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতন I সেই সঙ্গে পানির মধ্যে চাল ভিজিয়ে রোদে রেখে দিলে সিদ্ধ হয়ে ভাত হয়ে যাওয়া উচিত I সত্যিই যদি এমন হতো তাহলে দেশের গ্যাসের খরচ অনেকটাই কমে যেত I যাইহোক ভাত, আলু সেদ্ধ হোক বা নাই হোক মানুষ সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে I আমি কলিম ভাইয়ের দোকানের সামনে রিকশা থেকে নামলাম I গলির ভেতর রিক্সা ঢোকে না I এখানে নামাটাই সমীচীন I কলিম ভাই দোকানে নতুন ফ্রিজ বসিয়েছেI ভাবলাম একটা ঠান্ডা সেভেনআপ খেয়ে যাই I রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিচ্ছি তখন খেয়াল করলাম সামনের বাস স্ট্যান্ড থেকে একটা মেয়ে অনেকক্ষণ ধরে আমাকে লক্ষ্য করছে I আমারও মেয়েটাকে কেমন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে I হঠাৎ করেই বিদ্যুৎচমকের মতন মনে পড়ল যে মেয়েটা সুমাইয়া নয়তো I আমি একটু এগিয়ে গেলাম I ততক্ষনে বাস চলে এসেছে I প্রচন্ড ভিড় I সুমাইয়া কোনভাবেই সুবিধা করতে পারছে না I বাসের মধ্যে তিল ধারণের জায়গা নেই I ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিল I মেয়েটা অসহায়ের মতো দাড়িয়ে রইল I হঠাৎ আমার খুব খারাপ লাগলো দেখে I আমি এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ও অচেতন হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পরল I
চলবে ……….