দিন কেটে যায় আশায় আশায় পর্ব-৭

0
372

দিন কেটে যায় আশায় আশায়
সপ্তম পর্ব

সুমাইয়া হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে I আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম I আমাকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বোধহয় একটু লজ্জা পেয়ে গেল ও I লাজুক গলায় বলল
কি দেখছেন ?
তুমি বোধহয় সচরাচর হাসো না I
এই কথায় ও আরো লজ্জা পেয়ে গেল I আজ খেতে এসেছে বলেই হয়তো ও মাস্ক খুলে রেখেছে I আমি যখন ভার্সিটিতে যখন ওকে নিতে গেলাম ,বেশ অবাক হয়েছি দেখে I প্রতিদিনের মতোই সাধারণ একটা বোরকা পরা I শুধু স্কার্ফটা বোধহয় নতুন I কিংবা আমি আগে দেখিনি I সবুজ রঙের স্কারফে বেশ লাগছে I একেবারেই প্রসাধনবিহীন মুখ I এমনকি কাজল পর্যন্ত দেয়নি I সাধারণত মেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে সাজগোজ করে আসে I আমিতো আমার কলেজের ছাত্রীদের দেখি কি পরিপাটি হয়ে আসে I সকাল সকাল ছেলেমেয়েগুলোর স্নিগ্ধ মুখ দেখলে মনটাই ভালো হয়ে যায় I তবে সুমাইয়ার ব্যাপারটা ভিন্ন I ওকে মনে হয় এইরকম প্রসাধনবিহীন সাধারণভাবেই ভালো লাগে I ওর মধ্যে একটা অন্য ধরনের সৌন্দর্য আছে I ওর তেজস্বী রূপ , প্রসাধনে ঢাকা না পড়লেই ভালো দেখায় I তবে ওকে আমি যতটা সাহসী ভেবেছিলাম ,আজ মনে হচ্ছে ও তার চাইতেও বেশি সাহসী I আমার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে উঠে যাওয়ার পথেই একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল I বোঝাই যাচ্ছে পূর্ব পরিচিত I ভদ্রলোকের হাবভাব আমার ভালো লাগলো না I কোনরকম ভুমিকা ছাড়াই হুট করে বলে বসল
– তোমাকে তো ভালো মেয়ে বলেই জানতাম
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম I এই কথার অর্থ কি ? খুব ইচ্ছা হচ্ছিল উঠে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে i কিন্তু সেটার আর প্রয়োজন পরলো না I সুমাইয়া নিজেই বলল
– কি দেখে মনে হল যে আমি খারাপ মেয়ে ?
– এইভাবে রেস্টুরেন্টে বসে হাসাহাসি করছ I
– সে তো আপনিও করছিলেন I তাহলে কি আপনিও খারাপ ছেলে ?
– আমার কথা ভিন্ন I
– ভিন্ন কেন ? আপনি ছেলে বলে ? তাহলে তো বলতে হয় আপনি একটা খারাপ মেয়ের সঙ্গে বসে হাসাহাসি করছিলেন I
– ও আমার ফ্রেন্ড
– আর আমি যার সঙ্গে কথা বলছি সে আমার কি বলে আপনার মনে হয় ?
ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন I সুমাইয়া আবারো বললো
– যাইহোক, আপনার কাছে আমি সেই কৈফিয়ৎ দেবার প্রয়োজন বোধ করছিনা I আপনার যদি মনে হয় আমি ভালো মেয়ে নই , তাহলে নই I আপনার কাছে নিজেকে প্রমাণ করার কোন কারণ দেখছিনা I
এরপর ভদ্রলোককে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সুমাইয়া পাশ কাটিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল I ভদ্রলোক কিছুক্ষন বোকার মত দাড়িয়ে থেকে নিজের পথ ধরলেন I আমি শুধু বিস্মিত নই , চমৎকৃত হলাম I সুমাইয়ার সাহস এবং তেজ দেখে I প্রথমবার যতটা মুগ্ধ হয়েছিলাম ,এবার তার থেকেও বেশি হলাম I

খাবার নিয়ে ফিরে এসে সুমাইয়া আমার সামনে প্লেট নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল
– কিছু মনে করবেন না I
– আমার সঙ্গে এখানে এসে কি ,তুমি কোন সমস্যায় পড়লে ?
– একেবারেই না I তবে এরকম ভয়ঙ্কর গান আর কখনো শোনাবেন না I পাবলিক প্লেসে এর আগে কখনই আমি এত জোরে হাসিনি I
আমি হেসে ফেললাম I কিছু বললাম না I সুমাইয়া আবারো বললো
– তবে আমার ধারণা I এই গানটা অন্য কারো লেখা নয় I আপনি এটা নিজে বানিয়েছেন
আমি ফ্রাইড রাইস চিবুতে চিবুতে বললাম
– তুমি অসম্ভব বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে সুমাইয়া I শুধু একটাই সমস্যা I
সুমাইয়া ভুরু কুঁচকে বললো
কি?
তোমার মাথাটা বড্ড গরম I
মাথা গরম !!
সুমাইয়া অবাক হয়ে বলল I আমি খেতে খেতেই জবাব দিলাম
হ্যাঁ গরম তো বটেই I তা নাহলে তোমার দুলাভাইয়ের মতন একজন বোকা লোককে তুমি সহজেই ম্যানেজ করে ফেলতে পারতে I
গরম হলে গরম I কাউকে ম্যানেজ করার জন্য আমি ক্রিমিনালদের মতন মাথা ঠান্ডা করতে পারবোনা I
আমি দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললাম
তুমি কি আমাকে ক্রিমিনাল বলতে চাও ?
আপনার কথা আসছে কেন ?
কারন আমার মাথা অসম্ভব ঠান্ডা
হতে পারে I তার মানে এই নয় যে আপনি ক্রিমিনাল I মাথা গরম ক্রিমিনাল কি নেই ?
না তা নয় I কিছু মাথা গরম ক্রিমিনাল ও আছে I যারা রাস্তাঘাটে মানুষদের লাথি টাথি মারে I
সুমাইয়া কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো I তার পর আবার হাসতে আরম্ভ করল I তারপর বলল
আপনি এমন সিরিয়াস মুখ করে ,এত মজার কথা কিভাবে বলেন ?
আমি জবাব দিলাম না I শুধু মনে মনে একটা কথাই বললাম I আজকের এই সময়টা আল্লাহ আরো একটু দীর্ঘ করে দিক I

আপা দুলাভাই ঢাকায় এসেছেন I মুগদাপাড়ায় দুলাভাইয়ের মামাতো বোনের বাসায় উঠেছেন I আমার ওপর ফরমান জারি করা হয়েছে ,যেন আমিও দিন কতক এর জন্য বাক্স-বস্তা বেঁধে ওখানে চলে যাই I তারা কয়েকটা দিন থাকবেন I যেন সবাই একসঙ্গে থাকতে পারি I তা না হলে ধানমন্ডি থেকে মুগদাপাড়া প্রতিদিন যাতায়াত করা ঝামেলা হবে I আমি অনেক করে বুঝিয়ে বললামI আমার কলেজ অনেক দূরে হয়ে যাবে I থাকতে সমস্যা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি I কিন্তু আপা দুলাভাইকে কিছুতেই বোঝানো গেল না I অগত্যা বাধ্য হয়েই আমাকে বাক্স-পেটরা বেঁধে মুগদাপাড়া রওনা দিতে হলো I

ওখানে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি আমাকে কেন এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে I যদি বুঝতাম তাহলে হয়তো যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতাম I আমার চাকরি হওয়ার পর থেকেই মায়ের মাথায় ভুত উঠেছে আমাকে বিয়ে দেবার I আপা দুলাভাই তার মামাতো বোনের দুরসম্পর্কের ননদের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা চালাচালি শুরু করেছেন I মূলত পাত্রী দেখানোর উদ্দেশ্যে আমাকে নিমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে I আমি যতই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি , আপা দুলাভাই আমাকে ততই ছাই দিয়ে চেপে ধরেন I শেষমেষ আপা প্রশ্ন করল
– তোর কি কোন পছন্দ আছে ?
– হ্যাঁ আছে I
– তো এই কথাটা এতক্ষণ ধরে বলতে পারছিস না ? অহেতুক ঢং করছিস ?
তারপর দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল
দেখেছো আমি বলেছিলাম ছিলাম না ?
দুলাভাই মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন
তোমার কথাই দেখি ঠিক রিমি I এই নাটকটা না করলেই তো জানতেই পারতাম না
আমার মাথায় হাত I তার মানে পাত্রী দেখা-দেখি সব ভুয়া I আপা ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল
মেয়েটা কে ? সেই বোরকাওয়ালী নাকি ?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম I কোনমতে বললাম
কোন বোরকাওয়ালী ?
আপা হুংকার দিয়ে বলল
আবার ঢং ? তুই কি ভাবিস তুই একাই গোয়েন্দাগিরি করতে পারিস ? আর কেউ পারেনা ?
তুই কার কথা বলছিস ?
একদম ঢং করবি না I যার সঙ্গে বাচ্চা কোলে করে ছবি তুলেছিলি সেই তো ? নাকি ?

এবার আমার বেশ লজ্জা করতে লাগলো I সেদিন সত্যিই নার্সকে দিয়ে ছবি তুলিয়েছিলাম I আমার মোবাইলে যেমন ছিল সুমাইয়ার মোবাইলে ও ছিল I পরে সেই ছবি কিকরে হাত ঘুরতে ঘুরতে আপার কাছে চলে গেল I বুঝতেই পারলাম না I ফেসবুক আসলেই একটা চিজ I

যাইহোক ,আপা দুলাভাই ওদের বাসায় যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলেন I একদিন আগেই সুমাইয়ার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে এসেছি Iএখনই ওদের বাসায় যেতে চাওয়াটা অস্বস্তিকর I তাছাড়া আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি I হয়তো ওর কোন পছন্দ আছে I এভাবে হুট করে ওকে অস্বস্তিতে ফেলার কোন মানে হয়না I
মনে মনে ঠিক করলাম একদিন সুমাইয়ার সঙ্গে দেখা করে ওকে সব বলবো I যদি ওর কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আপা দুলাভাইকে ওদের বাসায় নিয়ে যাব I কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তার আর সুযোগ পেলাম না I শুক্রবার দিন সকাল বেলা ফজরের নামাজ শেষ করে ফিরছিলাম তখনই সুমাইয়ার ফোনটা এলো I ওর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম I আজ সন্ধ্যার পরই নাকি ওর বিয়ে I

এখন কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা I

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here