দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব-১৮

0
647

#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ১৮
_নীলাভ্র জহির

গর্ভের শিশুর দুশ্চিন্তায় চিত্রার অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সে নিজের মনের অবস্থা কাউকে বোঝাতে পারছে না। সবাইকে বোঝার মানুষ থাকে না। যেমন চিত্রার নেই। বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল চিত্রা। কিছুক্ষণ পর জোসনা বেগম এসে তাকে একটা কাজের কথা বললেন। কিন্তু চিত্রা বিছানা ছাড়িনি। সে ঠিক করেছে আগামী দুইদিন শুয়ে থাকবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর জোসনা বেগমের গলা শোনা গেল,তোমার একটা কাম করতে কইছিলাম বউ।
চিত্রা উত্তর দিল, এখন পারুম না আম্মা। ডাক্তার আপায় কইছে আমার একটু বিশ্রাম নিতে।
কতক্ষণ বিশ্রাম নিতে হয়? সে দুপুর থাইকা শুইয়া রইছো। এখনো ওইটা একটু হাঁটাহাঁটি করো। দুনিয়াটার আলো-বাতাস দেখো। কাম কাজ না করলে শরীরে নুনা ধরবো।
আম্মা দেখ ডাক্তার আপা কইছে আগামী কয়েকদিন আমারে বিছানায় রেস্ট নিতে। জরুরী দরকার ছাড়া উড়তে মানা করছে।
এটা আবার কেমন কথা? এমন কথা তো জীবনেও শুনি নাই বাবু। পোলাপাইন তো আমারও হইছে। সবারই হয়। সারাদিন কে বিছানায় শুইয়া থাকে?
আম্মা আমার একটু সমস্যা আছে। রুবিনা আমার সঙ্গে গেছিল। ওরে জিজ্ঞেস করেন, ও কইবো।
হইছে । আজকালকার মাইয়াগো কত যে সমস্যা।

বিড়বিড় করতে করতে জোসনা বেগম সেখান থেকে চলে গেলেন। এরপর তিনি হয়তো রুবিনা সঙ্গে নিয়ে কথা বলেছিলেন। চিত্রা আশা করেছিল জোসনা বেগম তাকে বুঝবে। নিজের মেয়ের মত পরম আদর-স্নেহে ভরিয়ে রাখবে তাকে। কিন্তু সবকিছু জানার পর হিতের বিপরীত হলো। তিনি আরো ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন। ঘরের কাজ করতে করতে সমস্ত রাগ করতে লাগলেন জিনিসপত্রের উপর। সবকিছু জোরে জোরে ফেলতে লাগলেন আর মুখে বললেন, গোবর পোড়া কপাল রে। মাজায় ব্যথা হওয়ার আর টাইম পাইলো না। সারা জীবন সংসার কইরা আইলাম। এই দুই দিনের জন্য কেন আমার এই মরার অসুখ হইলো। জমিদারের বেটি রে কাম করতে কইছিলাম। কেন যে করতে কইছিলাম? বহুৎ বড় ভুল কইরা ফেলছি। কাম কাজ করলে কি হয়? শরীর ভালো থাকে। তার কামের কথা কইয়া নাকি আমি তার সর্বনাশ কইরা দিছি। আরে কিছুই হইব না। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মানুষজন একটু বেশি কথা কয়?
পাশের বাড়ির একজন মহিলা জানতে চাইলেন কি হইছে ভাবি।
আরে আর কইও না। রূপকের বউর একটু কাম করতে কইছিলাম। এই কাম করনের লাইগা নাকি তার শরীর খারাপ হইয়া গেছে। ডাক্তার নাকি তারে কইছে সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে। কোন কাম কাজ না করতে।
মহিলা বললেন ডাক্তার এই কথা জীবনেও কইবো না। কাম কাজ করলেতো শরীরের আরো উপকার হয়। তোমার বউ এগুলা কইতাছে কারণ সে খালি সুযোগ খুজতাছে। তারে দেখলেই বোঝা যায় দুনিয়ার আইলশা। ঘরের কাজ কামে মন নাই।

চিত্রার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল। নিজের পরিস্থিতিতে সে কখনো কাউকে বোঝাতে পারবে না। তাকে বোঝার মতো কেউ নেই। একমাত্র রূপক তাকে বুঝতে পারে।

রূপক বাড়ি ফিরলে চিত্রা সব কথা তাকে খুলে বলল। রূপক বললো আচ্ছা ঠিক আছে আমি আম্মারে বুঝাই কমু।
চিত্রার খুব বলতে ইচ্ছা করছিল তাতে আমার অশান্তি আরো বাড়ব। কিন্তু স্বামীর সামনে শাশুড়ির বদনাম করতে ইচ্ছে করলো না। তাই বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল চিত্রা।

পাখি ডাকা এক নতুন ভোরের সূচনা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে ঘরের বাইরে বের হয়েছে চিত্রা। সবেমাত্র অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এই আলোয় হাঁটতে খুব ভালো লাগে। বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তায় কয়েক মিনিট চিত্র হাঁটাহাঁটি করে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। জোসনা বেগম আড়চোখে তাকে দেখছে। গরু গুলোকে গোয়াল ঘর থেকে বের করেছিলেন উনি। চিত্রা নিজেও গোয়াল ঘরে গিয়ে দুটো গরুর রশি ধরে বাইরে বের করার চেষ্টা করলো। এমন সময় একটা গরুর গুতা খেয়ে রীতিমতো পড়ে যাওয়ার জোগাড় হল তার। জোসনা বেগম এর তাতে কোনো সহানুভূতি হলো না। বরং তিনি আরো ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, তোমারে এইখানে আইতে কে কইছে? মরতে আইছিলা? পেটের মধ্যে একটা গুতা লাগলে তখন কইতা আম্মা লাগাই দিছে। এইখান থাইকা যাও।
চিত্রার মন খারাপ হয়ে গেল। রান্নাঘরে এসে ভাতের পাতিল ধুয়ে পানিসহ চুলায় তুলে দিলো চিত্রা। ভাতের চাল ধুতে গেছে এমন সময় আবারো শোনা গেল জোসনা বেগমের গলা, আবার ওইখানে গিয়ে কি করতাছো ? রাইখা দাও। কাম আমি করমু। তোমার কিছু করা লাগবো না। ঘরে গিয়া শুইয়া থাকো।

চিত্রা জোসনা বেগমের কথায় ভ্রুক্ষেপ করলো না। সে স্পষ্ট বুঝা গেছে শ্বাশুড়ীর কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে হবে। কানের ভেতর রাখতে গেলে কষ্ট হবে তার। উনার প্রত্যেকটা কথা হৃদয়টাকে পুড়িয়ে বের হয়। এই বাড়ির বউ হয়ে থাকতে চাইলে আরো অনেক বেশি সহ্য ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে তাকে।

চিত্রা চুলার পাড়ে বসে ভাত জাল দিতে লাগলো। জোসনা বেগম এসে বললেন যাও ঘরে যাও। কাম কাজ কিছু করতে হইবো না। তোমার ডাক্তার কইছে সারাদিন শুয়ে থাকতে। তুমি শুইয়া থাকো। পারলে আমার পোলারে ও সারাদিন ধইরা রাখ।

চিত্রা কোন প্রত্যুত্তর’ করল না। জোসনা বেগম তাকে এক প্রকার জোর করে রান্না ঘর থেকে বের করে দিলেন। অগত্যা বাধ্য হয়েই চিত্রা নিজের ঘরে চলে এলো।

আজ চিত্রার সারাটা দিন কাটলো শাশুড়ির খিটিরমিটির কথাবার্তা শুনে। শাশুড়ি তাকে কোনো কিছুতে হাত দিতে দিচ্ছিলেন না। পরে রূপকের কাছে জানতে পারল গতরাতে রূপক তার মায়ের সঙ্গে চিত্রাকে নিয়ে কথা বলেছিল। রূপক নিজেই অনুরোধ করেছিল যাতে মা চিত্রাকে কোন কাজ করতে না দেন। এ কারণেই তার ওপর প্রচণ্ড রেগে আছেন জোসনা বেগম। বিষয়টাকে নিয়ে চিত্রাহার মাথা ধামাল না। সবকিছু যত বেশি এড়িয়ে যেতে পারবে ততোই সুখে থাকতে পারবে সে।

তখন মধ্যরাত। চিত্রাকে একবার বাইরে যেতে হবে। এ বাড়ির পায়খানা (টয়লেট) ঘর থেকে অনেক দূরে। এখন রাত্রিবেলা বেশ কয়েকবার চিত্রাকে বাইরে যেতে হয় চিত্রার রূপককে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। রূপক ঘুমের ঘোরে ডুবে গেছে। বলল, দরজা খোলা রাইখা যাও। আমি জাইগা আছি। ভয় পাইও না।
আপনিও চলেন আমার লগে। একা একা যাইতে ডর লাগে।
আচ্ছা, তুমি যাও আমি দুয়ারে দাঁড়াইয়া আছি।

চিত্রা বাইরে বেরিয়ে এলো। সারাদিন পরিশ্রম করে রূপক বাসায় ফেরার পর রাত্রিবেলা তাঁর ঘুম ভাঙ্গাতে ও চিত্রার ভালো লাগেনা। মনে সাহস করে সে এগিয়ে গেল পুকুর ঘাটের দিকে। বদনায় পানি নেই। হাতের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সামনে এগোচ্ছিল চিত্রা। হঠাৎ কি মনে করে এসে পুকুর ঘাটের চারিদিকে ও বাড়ির আশেপাশে একবার লাইট দিয়ে পরখ করলো। তার মনে হলো পিছনের বাগানে কেউ একজন দৌড়ে পালিয়ে গেল। গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেছে সে। এত রাতে এখানে কারো থাকার কথা নয়। দৌড়ানো মানেই তো বিষয়টা সন্দেহজনক। চিত্রা ঘাট থেকে পানি নিয়ে পায়খানায় গেল। পায়খানা থেকে বের হয়ে ঘরে যেতে যেতে টর্চ বন্ধ করে ফেলল। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কৌতুহল তার সমস্ত ভয় দূর করে দিয়েছে। কেন যেন মনে হলো সে রুবিনার ওড়না রং দেখেছে। এত রাতে বাগানে রুবিনার দৌড়াদৌড়ি করার কথা নয়। একদিকে তার মনে ভয় অন্যদিকে কৌতুহল। চিত্রা লাইট বন্ধ রেখে গুটি গুটি পায়ে। চিত্রা লাইট বন্ধ রেখে গুটিগুটি পায়ে পিছন দিকটা এসে দাঁড়ালো। কোন সাড়াশব্দ নেই। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। অনেকক্ষণ পর শোনা গেল পাতার মর্মর শব্দ। খসখস আওয়াজ তুলে কেউ একজন যেন হেঁটে যাচ্ছে। তবে আওয়াজটা এমন সে খুব সতর্কভাবে হাঁটছে যেন শব্দ না হয়। সেদিকে লাইট জ্বালালো চিত্রা। দেখতে পেল গ্রামের পরিচিত এক ছেলেকে। লাইটের আলো ধরতেই দৌড়ে ছেলেটা দ্রুত আড়াল হয়ে গেল। চিত্রা দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। তার মনে হচ্ছিল গাছের আড়াল থেকে হয়তো রুবিনা বের হয়ে আসবে। কিন্তু রুবিনাকে আসতে দেখতে না পেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে চিত্রা ঘরে ফিরে এলো। এসে দেখলো বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে রূপক। রূপককে কথাটা বলবে কিনা চিত্রা বুঝতে পারল না। তবে বাগানে রুবিনার উড়নার মত কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল সে। এখন তার মনটা উসখুস করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে রুবিনা ঐ ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
ঘরে থাকতে না পেরে চিত্রার ঘর থেকে বেরিয়ে রুবিনার ঘরের দরজায় এসে টোকা দিল। দরজা ভেজানো। খোলা মাত্রই দেখল ভিতরে কেউ নেই। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বিছানার উপরে বসে রইল চিত্রা। রুবিনার এখনো ফেরার কোনো নাম নেই। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর দরজা খোলার আওয়াজ হলো। ঘরের ভেতর চিত্রাকে বসে থাকতে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল রুবিনা। চিৎকার করতে করতে ও নিজেকে সামলে নিল। তারপর দৌড়ে এসে চিত্রার পা দুটো জড়িয়ে ধরল, ভাবি তুমি কাউরে কিছু কইও না। আমি ভাবছিলাম তুমি আম্মারে জাগাইছ। আইসা দেখি সবাই ঘুমে। তুমি কাউরে কিছু কও নাই। দোহাই লাগে তুমি কাউরে কিছু কইওনা। তুমি যা কইবা আমি তাই শুনুন ভাবি। আমার ভুল হইয়া গেছে।

চিত্রার কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। সে রুবিনার হাত ধরে বলল, তোমার সম্মান মানে আমার সম্মান। আমি তোমার সম্মান নষ্ট করতে চাই না বোন। তোমার গা কাঁপতাছে। উইঠা বস। আমার পা ছাইরা দাও।

না, ভাবি। আপনি আগে কোন কাউরে কিছু কইবেন না।
কাউরে কিছু কমু না। তুমি উঠো। শান্ত হইয়া বস। এখন আমার ওই পোলার ব্যাপারে বিস্তারিত কও।

ওরে তো আপনি চেনেন। ওর নাম শিমুল।
হ, তার লগে তোমার কি ব্যাপার সেইটা কও।
ওর লগে আমার সম্পর্ক চলে। অনেকদিনের রিলেশন। আইজ রাইতে আমি ওর লগে দেখা করতে চাই নাই। শিমুল খুব জোর করতে ছিল। কইসিলো আজ দেখা না করলে আমার লগে রাগ করবো। ও রাগ করলে আমি সইতে পারিনা। আমার অনেক কষ্ট হয়। তাই ঘরের বাহির হইছিলাম।
তোমাদের রিলেশন কেমন?
কেমন মানে?
ও তোমারে ভালোবাসে?
হুম ।
রিলেশন কতদূর গড়াইছে? খালি দেখা করছ নাকি দেখা কইরা অন্য কিছু করছ?
রুবিনা চুপ করে রইলো। তার মাথাটা নিচু করা। থুতনি বুকের সঙ্গে লাগানো। দ্রুত ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
চিত্রা বলল আমি কাউকে কিছু কমুনা। তোমার ভাইরেও কমু না। আমারই শুধু কও সম্পর্ক কতদূর?
রবিনা লাজুক শ্বরে আমতা আমতা করে বলল, মেইন জিনিস টা বাদে বাকি সব হইয়া গেছে।
বুকে হাত দিছে?
রবিনা আসতে করে মাথা নাড়ালো, হু ।
ওই জিনিস বাদ দিয়া সব হইয়া গেছে?
হ ভাবি।
প্রতিদিন দেখা করলে মেলামেশা করো?
মাঝে মাঝে দেখা করি। যেদিন দেখা করি সেদিনই কাছে আসে।
ওকি তোমারে বিয়া করব?
ও তো বলে করব।
ওর লগে যদি তোমার বিয়ে না হয়?
না, হইলে আমি তো কিছুই করতে পারুম না। আমি ওরে বিশ্বাস করি। শিমুল ভালো ছেলে। আমি আপনার লগে ওরে কথা বলাইয়া দিমু ভাবি।
তোমার ভাইয়ের এক মাইয়ার লগে প্রেম ছিল। আমি শুনছি। তার লগে তোমার ভাইয়ের বিয়া হয় নাই। তোমার ভাই কিন্তু ভালো ছেলে । তোমারও তো এমন হইতে পারে। বিয়া না হইলে কি এই স্মৃতিগুলো ভুলতে পারবা।
কি আর করবো ভাবি? ভালোবাসি ওরে । প্রেম যখন করি কাছে পাইতে তো মন চাইবো। আপনি তো সবই বুঝেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন ঘুমাইয়া পড়ো। কালকে তোমার লগে কথা কমু। তোমার ভাই আবার জাইগা গেলে আমারে খুজবো।
ভাবী আপনি কিন্তু কাউরে কিছু কইবেন না।
আরে পাগলি আমি তো কইছি কমু না। আমারে বিশ্বাস করো। টেনশন কইরো না। এখন মেলা রাইত। ঘুমাইয়া পড়ো।

চিত্রা তার নিজের ঘরে চলে এলো। বেরিয়ে আসার সময় শুনতে পেল রুবিনার দরজা আটকে দেয়ার শব্দ। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে অনেক রাত পার হয়ে গেল। আর কিছুতেই ঘুম এলো না তার নীরব দুটি চোখে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here