দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব-৩০

0
638

#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ৩০
_নীলাভ্র জহির

রূপক বাড়ি ফেরার সময় বিশাল এক ইলিশ মাছ নিয়ে ফিরলো। বাজারের থলেতে রয়েছে লম্বা লম্বা বেগুন, আলু ও মশলাপাতি। বাড়িতে ঢুকেই জোসনা বেগমকে বলল, মা তুমি তো খুব মজা কইরা বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ রান্ধ। আইজ রান্না করবা। বাজারের সবচাইতে বড় ইলিশ মাছটা আনছি। নির্মলের ক্ষেতের টাটকা বেগুন আনছি। নেও ভালো কইরা রাইন্ধ।
জোসনা বেগম তার ছেলের মুখের দিকে খানিকক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেকে ভীষণ হাসি খুশী দেখাচ্ছে। তিনি আগ্রহ ভরে জানতে চাইলেন, এত বড় মাছ আনছিস আজকে। কি ব্যাপার?
বড় মাছ কি আনতে ব্যাপার লাগে? খাইতে মন চাইলো তাই কিইনা আনলাম।
জোসনা বেগম আর কোন প্রত্যুত্তর’ করলেন না। বটি নিয়ে এসে তিনি মাছ কাটতে বসে গেলেন। চিত্রা কে ডাকতে ডাকতে বললেন, ও বৌমা দেইখা যাও।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। উঠানে কুপি নিয়ে বসেছেন জোসনা বেগম। তার সোনালী আলোয় ইলিশ মাছের গা চকচক করছে। চিত্রা মাছ দেখে চোখ বড় বড় করে রূপকের দিকে তাকালো। হাসি হাসি মুখ রূপকের। মনে হচ্ছে ভালো কোন খবর আছে। কিন্তু সেটা জানতে সাহস পেল না সে।
ঝিঝির ডাক কান ভারি করে তুলছে। রুপক পিড়ি নিয়ে বসে মায়ের মাছ কাটা দেখতে লাগলো। পাশেই দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল চিত্রা। তার খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে বাবা রাত করে মাছ নিয়ে বাড়ী ফিরতেন। মা যখন বসে মাটিতে মাছ কাটতেন তখন বাবা চিত্রা কে ডেকে পাশে বসিয়ে মাছ কাটা দেখাতেন। আর বলতেন, দেখো কত বড় মাছ লইয়া আইছি। আমার মাইয়া খাইবো। আমার পরি আম্মা খাইবো। সেই দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠতেই হুহু করে কান্না এসে গেল চিত্রার। খুব ছোটবেলায় সে মাকে হারিয়েছে। আর সেই সঙ্গে হারিয়েছে বাবার আদর স্নেহ। মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবাটা ধীরে ধীরে কেমন যেন অসহায়ের মত হয়ে গেল। তার হৃষ্টপুষ্ট বাবা শুকিয়ে হয়ে গেল কাঠ। তার মা মরেছে ডায়রিয়ায়। মায়ের মৃত্যু তার বাবা সোহরাব উদ্দিন মেনে নিতে পারেননি। মানুষ শুধু শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়না। মানসিকভাবেও পঙ্গু হওয়া যায়। সোহরাব উদ্দিন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। স্ত্রীকে হারানোর শোকে তিনি ধীরে ধীরে মানসিকভাবে এতটাই ভেঙ্গে পড়লেন যে কোন কাজেই আর মন দিতে পারলেন না। ছোট্ট মেয়েটাকে মানুষ করার জন্য সবাই তাকে আরেকটা বিয়ে করতে পরামর্শ দিতে লাগলেন। কিন্তু তিনি নিজের স্ত্রীর স্মৃতি ভুলে অন্য কাউকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। শোকে দুখে ধীরে ধীরে কেমন যেন মানুষটা পাথর হয়ে উঠলো। সেই থেকে শুরু তার কর্মহীন জীবন। অনেক কষ্টে মাঝে মাঝে দু’একদিন কামলা দিয়ে যা ভাত তরকারি জুটত, তাই দিয়ে এই মেয়েটাকে তিনি মানুষ করেছেন। বাবার প্রতি তাই অনেক কৃতজ্ঞ চিত্রা। তবে আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের মত তার ছোটবেলা কিংবা কৈশোর সুখকর হয়নি। স্কুলে পড়াশোনা করেছে অনেক কষ্ট করে। সেই পড়াশোনাও বেশি দূর করতে পারেনি। পড়াশুনায় বেশ মেধাবী ছিল চিত্রা। তবে সুপ্রসন্ন হয়নি তার ভাগ্য। সেসব কথা ভেবে এখন কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আনমনে গালে হাত দিয়ে বসে চিত্রা এসকল কথাই ভাবছিল। রূপকের ডাকে তার সম্বিৎ ফিরলো।

রূপক বলল, আমারে এক খিলি পান দেও তো।
চিত্রা বারান্দা থেকে আরেকটা কুপি জ্বালিয়ে নিয়ে শাশুড়ি মায়ের ঘরে ঢুকলো। গ্রামের মহিলারা বিয়ে হতে না হতেই পান খাওয়া শুরু করে। তার এখনও সেই অভ্যাস হয়নি। তাই তার ঘরে পানের বাটা থাকেনা। জ্যোৎস্না বেগমের পানের বাটা থেকে সে রূপকের জন্য এক খিলি পান তৈরি করল। আজকে তার মনটা বড় ভালো। কারণ গত দুদিনে ভালো ভালো খাওয়া আর দুশ্চিন্তা কমে যাওয়ায় শরীরটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। রুপকের আচরণও আগের থেকে স্বাভাবিক। গত কয়েকদিন আগে হওয়া ঝড়টা ধীরে ধীরে তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে ছিল সেটা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। যদিও এখনও তার সঙ্গে খুব একটা ঘনিষ্ঠ হয়নি রূপক। তথাপি রূপকের স্বাভাবিকতাকে ভালোভাবেই গ্রহণ করছে চিত্রা। সে পানের খিলি নিয়ে এসে রূপকের হাতে দিল।
জোসনা বেগম বললেন, পোয়াতি মাইয়ার তো একবার বাপের বাড়ি ঘুইরা আসা দরকার। সবাইতো যায়। ছয় মাসে গিয়া একবার নাইওর দিয়ে আসা উচিত। তোর শ্বশুর কি ওরে নিয়া যাইবো?
– সেইডা আমি কেমনে কমু? তার মাইয়া তার তো কোনো হুস নাই।
– তোর ফুপু শ্বাশুড়ীও তো একবার খোঁজ নিলোনা। মেলাদিন হইয়া গেল। তুই দেখছস। আমরা সাইকেলের আশায় বইসা থাকলে কচুডা পাইতাম। এরা সাইকেল দেওয়ার ভয়ে একবার মাইয়ার লগে যোগাযোগ করল না।
– যোগাযোগ করছি আমি। কয়েকদিন আগে যোগাযোগ করছি। ওর ভাইয়ের লগে। সব ডিসমিস কইরা দিছি।
– কি ডিসমিস করছোস?
– সম্পর্ক। ও আমার লগে যা করছে তার পরে ওর লগে সম্পর্ক রাখার কোন মানে হয়না।
– ও তোর লগে আবার কি করছে?
জোসনা বেগম মাছ কাটা বন্ধ করে তার ছেলের মুখের দিকে তাকালেন।
রূপক পান চিবোতে চিবোতে পানের পিক ফেলল মাটিতে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ঐগুলা তোমার শুনতে হইবো না। বাদ দাও।
– ওর লগে তোর ঝামেলা হইছে। এই ঝামেলার জের ধইরা তুই তোর বউয়ের লগে এই কয়দিন ঝগরা করছিলি?
রূপক এক সেকেন্ডের জন্য চিত্রার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আসলে ঝামেলাটা তো চিত্রার সঙ্গেই হয়েছে। সেই ঝামেলার জের ধরেই চিত্রার ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষ হয়েছে। এই কথাটা সে মাকে বলতে পারবেনা। সে চায় না তার ব্যক্তিগত কষ্টের কথা শুনে তার মা ও কষ্ট পাক। কারণ তার স্ত্রী গর্ভবতী। মা জানতে পারলে তার স্ত্রীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে যাবেন। যেটা তার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আবারো একবার পানের পিক ফেলল রূপক।
জোসনা বেগম বললেন, তাদের মাইয়া পোয়াতি। খোঁজ খবর তো নেওয়া উচিৎ। তোর ফুপু শ্বাশুড়ী ও কোনদিন দেখতে আইলো না। কেমন মানুষ তারা? মাইয়াডার শইল্যের কি অবস্থা দেইখা তো যাওয়া দরকার।
– আর মাইয়া। তারা মাইয়ারে আমার কান্ধে চাপাইয়া দিয়া জন্মের মত বাইচা গেছে। তাদের ঘাড় থাইকা আজাব নামছে। কিসের লাইগা দেখতে আইবো তারা।

অনেকক্ষণ ধরে রূপকের এই কথাগুলো চিত্রা মুখ বুজে হজম করছে। কষ্ট হচ্ছে তার। সবসময় জোসনা বেগমের এ ধরনের কটুক্তি শুনে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু রূপকের মুখ থেকে কোনদিনও এমন কথা শুনতে হবে কখনো আশা করেনি।
চিত্রা নিঃশব্দে তার ঘরে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে মাছ কাটা বন্ধ করলেন জোসনা বেগম। এসব হচ্ছেটা কি? এতদিনেও তার ছেলে ও ছেলের বউয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব কমছে না। সবকিছু স্বাভাবিক হয়েও ভেতরে ভেতরে যেন কিছু একটা ধীরে ধীরে কয়লার আগুনের মত বেড়ে উঠছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে কি হয়েছে? কি এমন বিষয় নিয়ে এমন মনোমালিন্য হচ্ছে রুপক- চিত্রার? এসব ভাবতে ভাবতে জোসনা বেগম আবারো মাছ কাটতে মনোযোগ দিলেন।
রূপক এবার নিজের ঘরে এলো। বিছানায় শুয়ে আছে চিত্রা। ঘর অন্ধকার। খোলা জানালা দিয়ে মৃদু আলো আসছে। তাতে আন্দাজ করা যায় চিত্রা ঠিক কোন জায়গাটায় শুয়ে আছে। তার পাশে এসে দাঁড়াল রূপক। বলল, আমার মায়ে মাছ কাটতেছে আর তুমি আইসা এইখানে শুইয়া পড়লা। মাছ না কাটলেও অন্তত মাছ ধুইতে আমার মায়েরে একটু সাহায্য করতে পারতা। অনেকদিন ধইরা দেখি কোন কাম কাজই করো না। সারাক্ষণ শুইয়া বইসা কাটাও। পোয়াতি হইলে কি একবারেই কাম কাজ বন্ধ কইরা শুইয়া থাকতে হইবো নাকি?

চিত্রা বেশ অবাক হল। একই সাথে তার বুকের কোথায় যেনো কেটে কেটে ছিদ্র হয়ে যেতে চাচ্ছে। যেই রূপক নিজেই তার মায়ের কাছে অনুরোধ করেছিল যেন চিত্রাকে সে বিশ্রামে থাকতে দেয়। অথচ আজ সেই রূপক তাকে এত বিশ্রী ভাবে কথা শোনাচ্ছে। একটা ছোট্ট ঘটনা কীভাবে যেন তাদের দুজন মানুষের সম্পর্কটাকে ভয়াবহভাবে বদলে দিল। একই সঙ্গে বদলে দিল তার ভালোবাসার মানুষের মন মানসিকতাকে। ভালোবাসাটা কি এখনো আছে নাকি সেটাও ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে?

ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসল চিত্রা। অন্ধকারে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে ধপ করে পড়ে যাচ্ছিল। শব্দ শুনে সেটা রূপক আন্দাজ করতে পেরেছে। সঙ্গে সঙ্গে রাগত স্বরে রূপক বলল দেইখা শুইনা চলতে পারো না। বেয়াক্কেলের মতো আচরণ করো কেন? এমন চলাফেরা দেখলে মেজাজ খারাপ হইয়া যায়।

চিত্রা কোন উত্তর দিল না। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে শাশুড়ি মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে বললো, আম্মা আমি কল থাইকা পানি আইনা দেই।
আরে না। এই সময় পানির ভারি বালতি তোলার কোন দরকার নাই।
জগে কইরা আনি।
দরকার নাই। আমার মাছ কাটা শ্যাষ। তুমি এইখানে খাড়াও। আমি পানি লইয়া আসি।
জোসনা বেগম হারিকেন ও একহাতে বালতি নিয়ে গেলেন পানি আনতে। চিত্রা বসে রইল স্তব্ধ মুখে। মন খারাপ হয়ে গেছে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়েও কেন যেন হচ্ছে না। রূপকের ভিতরে ধীরে ধীরে ভেঙে ভেঙে পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ টা কি আর আগের মতো কোনদিনও হবে না? যার পরম ভালোবাসায় চিত্রার সব সময় নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হতো, তার আকস্মিক পরিবর্তন তো মেনে নেয়ার মত না। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই এই ভয়টা পেয়েছিল চিত্রা। সব সময় তার মনে শঙ্কা ভর করতো এই বুঝি তার কপাল থেকে সুখ চলে যায়। চরম সুখের মুহূর্তে তার মনে হতো এত সুখ তার কপালে সইবে তো? আজ সত্যিই মনে হচ্ছে তার কপালে এত সুখ সইবে না। আর তাই তো দুজন মানুষ পাশাপাশি থেকেও বাড়ছে দূরত্ব। ভালোবাসা পাওয়ার পর তা হারিয়ে ফেললে মানুষ কি নিয়ে বাঁচে? সুখের স্মৃতি নিয়ে দুঃখের সাগরে ভেসে থাকে। এ কেমন জীবন এর লীলাখেলা?

এমন সময় জোসনা বেগমের ক্রুদ্ধ গলা শোনা গেল। তিনি চেঁচাতে চেঁচাতে বললেন, আরে আরে বিলাইটা মাছ নিয়া যাইতাছে।
চিত্রা সম্বিৎ ফিরে সামনে তাকিয়ে দেখল একটা বিড়াল এসে প্রায় মাছে মুখ দিচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে স্বতন্ত্র হয়ে বিড়ালকে তাড়িয়ে দিল। জোসনা বেগম বালতি রেখে রেখে দৌড়ে এসে বললেন, তোমারে আমি বসাইয়া রাইখা গেলাম। আর তুমি ধ্যান করতে বইছো। কোন দিকে চাইয়া ছিলা? বিলাই আইসা মাছে মুখ দিয়া ফেলছে। আমি না দেখলে নিয়া দৌড় দিত। তুমি কি কানা নাকি। কাণ্ড কারবার কিছুই বুঝতাছি না।

চিত্রা অপরাধীর মত মুখ করে মাথা নিচু করে রইল। জোসনা বেগমের কথা থামল না, আমার পোলা এত টাকা দিয়া বাজারের বড় মাছটা নিয়ে আইছে। এই মাছ তুমি বিলাইরে খাওয়াইতা। আমি না থাকলে তোমাগো সংসারের যে কি হইব? আজকালকার মাইয়াগো মন মতিগতি কিছু বুঝিনা। দুইদিনের সংসারে কি অশান্তি শুরু করছে। পোলার মনে আমার শান্তি নাই। এদিকে তুমি আছো উদাসীন হইয়া। মন মতি গতি কোন দিকে থাকে বুঝিনা। সংসারে কোন মন নাই।

এমন সময়ে রূপক বেরিয়ে এসে জানতে চাইল কি হইছে? চিল্লাইতাছো ক্যান?
– চিল্লামু না কি করমু? বিলাই আইসা মাছে মুখ দিছে। কামড় দিয়া নিয়া যাইতো। এত সাধ কইরা বাজারের সবচাইতে বড় মাছটা নিয়া আইছস। তোর বউরে বসাইয়া রাইখা আমি গেছিলাম কলে পানি আনতে। তার চোখের সামনে দিয়া বিলাইডা আইছে। তার মন কোন দিকে ছিল আল্লাই জানে।

মাথা নিচু চিত্রার। পানিতে চোখ ভিজে যাচ্ছে। ছলছল চোখে ঝাপসা দেখছে সবকিছু। রূপক বলল, থাউক এত রাতে আর চিল্লাচিল্লি কইরো না। বিলাই মাছ নিয়া গেলে কি আর করতাম। খাওয়া হইতো না। না হইলে না হইত।
হ, কইলেই হইলো। কত টাকা দিয়া ইলিশ মাছ নিয়া আইছোস।
আর টাকা। জীবনটাই শেষ হইয়া যাইতাছে। টাকা দিয়া কি করমু।
জোসনা বেগম আর কিছু বললেন না। তবে এটুকু বুঝতে পারলেন যে চিত্রার কারণেই তার ছেলের জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। চিত্রা যেমন সংসারে অমনোযোগী নিশ্চয়ই তেমনি তার ছেলের প্রতি উদাসীন। হয়তো কোনো আচার-আচরণে তারা সে তার ছেলেকে কষ্ট দিচ্ছে। তাই কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার ছেলেটা।
জোসনা বেগম মাছ নিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের সামনে রাখা শানের ওপর ধুতে লাগলেন। মাছ ধুতে ধুতে তিনি বললেন, যন্ত্রণার মধ্যে পড়ছি আমি। কোন দিকে যামু বুঝতাছি না।
– তোমার কোথাও যাইতে হইবো না মা। যেদিন মন চাইবো আমিই চইলা যামু কোন একদিন।

কথাটা বলে রূপক আবারও গিয়ে ঘরে ঢুকলো। মাটির দিকে তাকিয়ে রইল চিত্রা। তার অশ্রুসজল চোখ থেকে টপ করে এক ফোটা জল মাটিতে পড়ল। এক ফোঁটা জলে হয়তো মাটি ভিজে না। তবে তার বুক ভিজে যাচ্ছে। বুকের ভীতর তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। এত কষ্ট নিয়ে কি করে বেঁচে থাকা যায়। নিজেকে তার মনে হচ্ছে নর্দমার কীট। সে সংসারের উপযোগী নয়। একটা কাজ ভালোমতো করতে পারেনা। কিভাবে শাশুড়িকে খুশি করতে হয় তাও জানে না। সংসারী মনোভাব কেমন হওয়া উচিত তাও বুঝতে পারেনা চিত্রা। তার জীবনটা কষ্টে কষ্টে কেটে যাচ্ছে। মা-মরা মেয়েদের জীবন হয়তো এমনই হয়। সংসারের ভালো-মন্দ তারা বুঝতে শেখে না। বাউন্ডুলে বাবার সংসারে নিজের মত সে সময় কাটিয়েছে। কোনদিনও হয়তো রান্না হয়েছে, কখনো হয়নি। সংসারের কোনো কিছুই বুঝতে শেখেনি চিত্রা। তার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তার। আর ফুফুর সংসারে সে ছিল একজন মেহমান মাত্র। কিংবা বলা যায় কাজের মেয়ে। ভাবিদের আদেশ মেনে কাজ করতো। তবে কাউকে খুশি করতে হয় কিভাবে সেটা চিত্রার জানা নেই। আর তাই আজ নিজের সংসারে এসে সে একেবারেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পর্যায়ে পরিণত হয়েছে। প্রথম থেকেই জোসনা বেগম তাকে পছন্দ করছে না, এখন স্বামীও তার প্রতি অসন্তুষ্ট। এই সংসারে তার আর কিছু রইল না। কেবল মুখ বুজে সহ্য করে পড়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই তার।

খুঁটির মত দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। জোসনা বেগম বিড়বিড় করে দুঃখ কষ্টের কথা বলছেন। কোন কথাই তার কানে ঢুকছে না। যেন সে শুনতে পারছে না কিছুই। জোসনা মাছ ধুয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। আর কোন শব্দ শোনা গেল না। বারান্দায় বিছানো পার্টির ওপর এসে বসল চিত্রা। খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে জ্বলজ্বল করছে লক্ষ কোটি নক্ষত্র। তার ইচ্ছে করছে একটা তারা হয়ে যেতে। যদি পারত সে নিজেও নক্ষত্র হয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করত। একদম একা। সে কাউকে কষ্ট দিতে পারত না। তাকেও কেউ কষ্ট দিত না। কি এমন হতো সে যদি মানুষ না হয় নক্ষত্র হয়ে জন্মাত?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here