দ্বিতীয়_সূচনা #পর্ব_২১

0
1379

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২১
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

গত এক সপ্তাহ ধরেই ফারহান অন্যমনস্ক হয়ে আছে। অফিস থেকে বেশ রাত করেই ফেরে। এই এক সপ্তাহে তিন দিন বাড়িতে আসেনি। অয়নন্দিতা জিজ্ঞেস করলে ঠিকঠাক মতো জবাব দেয় না ফারহান। বাড়ি না আসার কারণ কী হতে পারে সেটাও অয়নন্দিতার মাথায় আসছে না। প্রথমদিন যেদিন বাড়ি আসেনি সেদিন অয়নন্দিতা ফোন দিলেও ফারহান ফোন রিসিভ করেনি। পরদিন যখন বাড়ি আসে তখন জিজ্ঞেস করেও লাভ হয়নি। দু’দিন পর যখন আবারও বাড়ি আসল না তখন অয়নন্দিতা এই ব্যাপারটা নিয়ে সাজির সঙ্গে আলাপ করলে জানতে পায় উত্তরায় ফারহানের আলাদা একটা ফ্ল্যাট আছে। বন্দনার সঙ্গে ফারহান সেই ফ্ল্যাটেই থাকত এক সময়। এখনও ফারহান মাঝে মাঝেই সেখানে যায়। অয়নন্দিতা বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথম ফারহান বাড়ির বাইরে থেকেছে। ব্যাপারটা তার চোখে ভালো লাগছে না। কিন্তু ফারহানও কিছু বলছে না।
অফিস শেষে রাত বারোটায় ফারহান বাড়ি ফেরে। অয়নন্দিতা ব্যালকনি থেকেই দেখেছে ফারহানকে। ইজি চেয়ারে বসে বসে বই পড়ছে অয়নন্দিতা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ ফারহানকে জিজ্ঞেস করবে। উত্তর না দিলে জোর করে জিজ্ঞেস করবে। যতক্ষণ না ফারহান উত্তর না দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করবে। এই সংকল্প নিয়েই অয়নন্দিতা ফারহানের ঘরে ঢোকার অপেক্ষায় আছে।
ফারহান শাওয়ার নিয়ে ওয়াসরুম থেকে বের হলেই অয়নন্দিতা সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অয়নন্দিতাকে এইভাবে সামনে দাঁড়াতে দেখে ফারহান কিঞ্চিৎ অবাক হয়। ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকে তাকায় অয়নন্দিতার দিকে। অয়নন্দিতার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকার মানেই হয় না। কারণ ফারহান জানে অয়নন্দিতার মনে এই মুহুর্তে কী চলছে।
ফারহান সহজভাবেই প্রশ্ন করে,
‘কী ব্যাপার! হঠাৎ এইভাবে সামনে এসে দাঁড়ালে যে?’
‘কথা আছে।’
‘ওকে। তবে কথা তো বসেও বলা যেতে পারে। তাই না? এইভাবে সামনে দাঁড়ানোর মানে কী?’
‘সামনে দাঁড়ালাম বলে কী অসুবিধা হলো?’
‘নাহ। তেমন অসুবিধা হয়নি। আচ্ছা বলো, কী কথা বলবে?’
‘আমি এই তিন দিন ধরে খেয়াল করলাম। আপনি আপনার উত্তরার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকছেন। এর কারণ কী?’
অয়নন্দিতার মুখে উত্তরার ফ্ল্যাটের কথা শুনে ফারহান অবাক হয়নি। সে বুঝতে পারে সাজি অথবা ফারাশ নয়তো মা-ই উত্তরার ফ্ল্যাটের কথা অয়নন্দিতাকে বলেছে। না হয় অয়নন্দিতার জানার কথা না। প্রশ্ন যখন অয়নন্দিতা করেছে তখন এর উত্তরে কিছু তো বলতেই হবে।
‘এর কোনো কারণ নেই। আমি মাঝে মাঝেই যাই ওইখানে।’
‘আগে একা ছিলেন। গিয়েছেন। এখন তো আমি আছি। এখনও সেখানে যাওয়া লাগে?’
‘ফ্ল্যাটে গিয়ে এক রাত থাকতে গেলে আমায় একা কিংবা দোকা হওয়া লাগবে?’
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্নটা বেশ কঠিন। অয়নন্দিতাকে উত্তর দিতে হবে বুদ্ধি খাটিয়ে। লজিক বানাতে হবে। লজিক দিয়ে কথা বললে ফারহানকে চুপ করানো যাবে। ফারহানও শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতার দিকে। মনে মনে ভাবছে, অয়নন্দিতা এখন লজিক খুঁজছে। ফারহান বাঁকা হাসি দেয়। নির্দ্বিধায় অয়নন্দিতার একটা হাতে নিজের হাত রাখে। এরপর বলে,
‘লজিক বানাচ্ছো বুঝি?’
অত্যন্ত অবাক হয়ে অয়নন্দিতা ফারহানের দিকে তাকায়। ফারহান আরও একবার হাসে। অয়নন্দিতার সরল দেহটায় ফারহান নিজেকে ছেড়ে দেয়। আলতো স্পর্শে জড়িয়ে ধরে অয়নন্দিতাকে। অয়নন্দিতার কাঁধে নিজের থুতনি লাগিয়ে ফারহান ধীর কন্ঠে বলে,
‘লজিক বানাতে হবে না। তুমি যেই লজিকই খাটাও না কেন তার সব গুলোর জবাবই আমি দিতে পারব। কেমন? ঘুমিয়ে পড়ো। আমিও ঘুমাবো।’
অয়নন্দিতা ফারহানের বুকেত সঙ্গে মিশে আছে। ভালো লাগছে তার। এই স্পর্শে একটা আলাদা অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। অয়নন্দিতা সেই অবস্থাতেই একটা ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছাড়ে। চোখ জোড়া বন্ধ করে বলে,
‘কী আছে ওই ফ্ল্যাটে? যে সেখানে যেতে হয়।’
‘অনেক কিছু আছে। একদিন তোমাকেও নিয়ে যাব। কথা দিলাম।’
‘সেখানে আপনি আমায় কখনও নিয়ে যেতেন না। যদি আমায় নিয়ে যাওয়ার মতো মন থাকত তবে আমার কাছে বলতেন যে আপনার আলাদা একটা ফ্ল্যাট আছে। আমি সাজির কাছ থেকে জানতে পারায় এখন বলছেন একদিন আমায় নিয়ে যাবেন।’
‘বাচ্চাদের মতো রাগও করতে জানো দেখছি।’
‘রাগ থাকলে রাগ হবেই। এতে বাচ্চা হওয়া লাগে না।’
‘চলো, তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দেই।’
‘আমায় ঘুম পাড়াতে হবে না। আপনি খেতে আসুন।’
ফারহানের খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে মিথ্যা বলে,
‘আমি তো খেয়ে এসেছি।’
‘আপনি খেয়ে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওহ। তাহলে আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি নিচে যাব একটু। সব গুছিয়ে রাখতে বলব বুয়াকে।’
‘কেন, গোছাবে কেন?’
‘ভেবেছিলাম আপনি এলেই এক সঙ্গে খাব। আপনার আর আমার খাবারটা বুয়া ডাইনিংয়ে সাজিয়ে রেখেছিল। সেইগুলোই গুছিয়ে রাখতে বলব।’
ফারহানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় অয়নন্দিতা। বিষন্ন মনে ঘর থেকে যেই না বের হবে ওমনি তার হাতটা ধরে ফারহান। অয়নন্দিতা ঘুরে দাঁড়াতেই ফারহান বলে,
‘এই নিয়ম কবে থেকে চালু হলো?’
‘কোন নিয়ম?’
‘না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করা।’
‘এটা নিয়ম না। মন চাইল, তাই।’
ফারহান হালকা হাসে।
‘ঠিকাছে, তুমি গিয়ে প্লেট সাজাও। আমি আসছি। দু’জন এক সঙ্গেই খাব।’
‘আপনি না খেয়ে এসেছেন?’
‘আবারও খাব। প্রয়োজনে দুইবার খাব৷ বন্ধুর জন্য এতটুকু তো করতেই পারি। তাই না?’
‘বন্ধু?’
‘হ্যাঁ। আমরা কি বন্ধু নই?’
ফারহানের প্রশ্নটা খুব সহজ। কিন্তু প্রশ্নের আড়ালে লুকিয়ে আছে অয়নন্দিতার হাহাকার। ভেবেছিল বন্ধুত্বের হাত ধরেই ভালোবাসায় নামবে তারা দু’জন। কিন্তু এখন দেখছে হিসাবটা উল্টো। ফারহান তো এখনও সেই বন্ধুত্বেই আটকে আছে। অয়নন্দিতা ভাবে, ভালোবাসাটা তবে হলো না৷ না হোক, ক্ষতি কীসে। বন্ধু হয়ে পাশে তো আছিই। বরং বন্ধু হয়েই সম্পর্কটা ভালো থাকুক৷ মুহুর্তেই খারাপ হয়ে যাওয়া মনটাকে ভালো করে অয়নন্দিতাও বলে ওঠে,
‘অবশ্যই আমরা বন্ধু। শুধু বন্ধু-ই না। আমরা দু’জন বেস্ট ফ্রেন্ড। কেমন?’
ফারহানও হাসিমুখে সমর্থন জানায়। অয়নন্দিতাও বন্ধুত্বের হাতটা শক্ত করে ধরে। আরও কিছুটা সময় অতিবাহিত হোক না এই বন্ধুত্বের পথে চলে। ভালোবাসাটা একটা সময় ঠিক হয়ে যাবে। দীর্ঘশ্বাসটা ভেতরেই রাখে অয়নন্দিতা। বের না হোক। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাসও অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায় জীবনে। তাদের জীবনে অভিশাপ না আসুক।

চলবে……………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here