দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব_৩৮

0
1338

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৩৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

সারাদিন অফিস করলেও মন পড়ে থাকে অয়নন্দিতার কাছে। প্রতি এক ঘন্টায় দুইবার করে ফোন করে ফারহান। কখনও অয়নন্দিতাকে, কখনও সাজিকে, কখনও রওশন বেগমকে। বিকেলের পর পরই মন পাগলের মতো ছুটে বেড়ায় বাড়ির দিকে। হাতের বকি কাজগুলো ফেলে রেখেই চলে আসে অয়নন্দিতার কাছে। ফারহানের এমন পাগলামি দেখে অয়নন্দিতারও মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়।
অন্যান্য দিনের মতো আজও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। ফারহান ঘরে ঢুকেই অয়নন্দিতার পাশে বসে। অয়নন্দিতা তখন বইয়ের পাতায় মুখ গুজে বসে আছে। ফারহান যে তার সামনে বসে আছে সেই খেয়াল নেই। ফারহান পলকহীন চোখে তার এই অসুস্থ বউটাকে দেখে যাচ্ছে। হেঁটে চলে বেড়ানো এত সুন্দর মানুষটা আজ দু’দিন হলো বিছানায় পড়ে আছে। তার গন্ডি এই ঘর পর্যন্তই। অনেক কষ্টে ওয়াসরুমে যাওয়া এরপর আবার বিছানা। ফারহান যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ নিজেই অয়নন্দিতার সব কাজ করে। অয়নন্দিতাকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে তার জামাকাপড় চেঞ্জ করা পর্যন্ত সব ফারহান নিজে করে। এতে তার কোনো বিরক্তি আসে না। বরং ভালো লাগে। আপন আপন লাগে।
বাম হাতের সাহায্যে অয়নন্দিতার মুখের সামনে থাকা বইটা সরিয়ে দেয় ফারহান। অয়নন্দিতা ফারহানকে দেখে হালকা হেসে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলে। ঘড়িতে নজর দেয়। এখনও মাগরিবের আজান পড়েনি। এখনি ফারহান বাড়ি ফিরে এসেছে। অয়নন্দিতা বুঝতে পারছে তার জন্য ফারহান নিজের সমস্ত কাজ ফেলে চলে আসে।
‘এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?’
অয়নন্দিতার প্রশ্নটি ফারহানের পছন্দ হয়নি।
‘আমি চলে আসাতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘একেবারেই না।’
‘তবে এমন প্রশ্ন করলে যে?’
‘প্রশ্ন করার কারণ আছে। আমার মনে হচ্ছে, তুমি আমায় নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস হয়ে গেছ। সমস্ত কাজকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আমাকেই আগলে রেখেছ। এমন করলে তো কাজের ক্ষতি হয়ে যাবে। তাছাড়া বাবাও নেই। ফারাশ ভাইয়াও অফিসে যায় না যে তার উপর কিছু দায়িত্ব ফেলে দিবে। সব তো একা হাতেই করতে হয় তোমায়। সেইজন্যই বলা।’
ফারহান হাসে।
‘হাসছ কেন? হাসির কথা বললাম বুঝি?’
‘জি ম্যাডাম। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমার চাইতে তুমি ভীষণ চিন্তিত আমাদের বিজনেস নিয়ে।’
‘একদমই না। আমার জন্য সব কিছু এক সাইডে ফেলে রেখেছ। এটাই খারাপ লাগে।’
‘খারাপ কেন লাগে? অন্যান্য মেয়ে হলে তো খুব খুশি হতো।’
‘আমিও খুশি। কিন্তু আমি চাই তুমি আমার পাশাপাশি নিজের কাজকেও প্রাধান্য দাও।’
‘বড়ো বড়ো কথা অনেক হয়েছে। মেডিসিন নিয়েছিলে দুপুরে?’
‘হ্যাঁ।’
‘শরীর কেমন লাগছে এখন?’
‘ব্যথাটা আছে। এত দ্রুত সারবে বলে মনে হয় না। পায়ের দিকটায় কষ্ট হয় বেশি।’
‘এক কাজ করো অয়নন্দিতা, তোমার সমস্ত ব্যথা আমায় দিয়ে দাও।’
অয়নন্দিতা একটু শব্দ করে হেসে দেয়।
‘বাংলা সিনেমার হিরোদের মতো কথা বলছ তুমি।’
‘আর তুমি আমার হিরোইন।’
‘তোমার বাংলা সিনেমার হিরো হতে হবে না। তুমি আমার কাছের মানুষ হয়েই থাকো। ফুল অফ এটিটিউট এন্ড এংরি ইয়াংম্যান হয়েই থাকো। আমার এই ফারহানকেই ভালো লাগে। মিছেমিছি হিরো হতে হবে না।’
‘ইয়াংম্যান আমি? আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি। বয়স ৩৭+ হয়ে গেল।’
‘৩৭ বছর বয়সেও তুমি ইয়াং। আর বুড়ো হলেও আপত্তি নেই। আমিই তো পছন্দ করেছি।’
হাসি থামিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে ফারহান। অয়নন্দিতাকে যত দেখে ততই নতুনত্ব কিছু আবিষ্কার করে সে। ফারহান অয়নন্দিতার হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে। হুট করেই অয়নন্দিতার কপালে চুমু দেয়। অয়নন্দিতা ফারহানের চোখে নিজ চোখ রাখে। প্রশ্ন করে,
‘কী হলো, হঠাৎ চুমু খেলে?’
‘মন চাইল।’
‘এমন করে কী দেখছ?’
‘তোমায়। কঠিনকে কত সহজে সরল করে দাও তুমি। অয়নন্দিতা, তুমি সত্যিই অসাধারণ।’
‘আমি সাধারণ একজন মানুষ। আর তুমি আমার অসাধারণ স্বামী প্লাস বন্ধু। অসাধারণের সঙ্গে থেকে থেকে আমিও অসাধারণ হয়ে যাচ্ছি।’

অয়নন্দিতা বসে বসে ফ্রুট খাচ্ছে। ফারহান তার পাশেই। ল্যাপটপে কী যেন করছে। অয়নন্দিতা ফারহানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহানের মুখশ্রীতে একটা চমক আছে। যেই চমক এক প্রকার শান্তি এনে দেয়। অয়নন্দিতার সব থেকে বেশি ভালো লাগে ফারহানের হাসি আর তাকানো স্টাইল। ফারহান যখন তার দিকে শান্ত নজরে তাকায় তখন মনে হয় সে এই দুনিয়াতেই স্বর্গলাভ করে ফেলেছে। ফারহান যখন তার দিকে তাকিয়ে হাসে মনে হয় সে যেন অজস্র ফুলের মাঝে শুয়ে আছে। ফারহান এমন একজন মানুষ যার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলে একবারের জন্যেও মনে হয় না একঘেয়েমি লাগছে। অয়নন্দিতা ভাবছে, শুনেছি মানুষ বলে, নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলে অশান্ত মনটা শান্ত হয়ে যায় কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় ফারহানের দিকে তাকালে আমার মনটা এমনিতেই শান্ত হয়ে যায়। তবে কি নদী মানেই ফারহান। তার তাকানোটা হবে জোয়ার-ভাটা আর হাসিটা হবে স্রোত।
হঠাৎই ফারহানের ডাকে ধ্যান ভাঙে অয়নন্দিতার। অয়নন্দিতা তাকাতেই ফারহান ইশারা করে। অয়নন্দিতাও ইশারায় জানান দেয়– কিছুই হয়নি।

রাতে বেশির ভাগ সময় ফারহান জেগে থাকে। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা অয়নন্দিতার কখন কী প্রয়োজন হয় সেই চিন্তাতেই ঘুম আসে না ফারহানের। এইতো গতকাল রাতের কথা। ফারহান অনেকটা সময় ধরে সজাগ থাকার পর কখন যে ঘুমিয়ে গেছে তার আর হুশ ছিল না। অয়নন্দিতার প্রচুর ওয়াসরুম পায়। সে চেয়েছিল ফারহান সজাগ না হোক। ভেবেছিল নিজেই একা একাই যেতে। কিন্তু তা আর হলো কই। উঠতে গিয়েই ব্যথার চোটে শব্দ করে ফেলে। ফারহান শব্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ওঠে। উঠে দেখে অয়নন্দিতা খানিকটা উঁচু হয়ে বসে আছে তাও পুরোপুরি না। ফারহান অয়নন্দিতাকে জড়িয়ে ধরে। তার জন্য ফারহানের এখন ঘুমোতেও ভয় লাগে। তার শুধু একটাই ভাবনা, কবে অয়নন্দিতা ঠিক হবে। আবার আগের মতো হাঁটাচলা করতে পারবে।
অয়নন্দিতার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ফারহান মনে মনে বলে, তুমি মেয়ে আমার জীবনে আসার পর ধীরে ধীরে জীবনটাই বদলে যাচ্ছে অয়নন্দিতা। মাঝে মাঝে আমি ভাবি তুমি আমার জীবনে রুপকথার পরী হয়ে এসেছ। পরীরা যেমন সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয় তুমিও ঠিক তেমন। সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছ। তুমি আমার বাস্তব জীবনের মিষ্টি পরী। তুমি আমার মায়াপরী। আচ্ছা, আমাদের অনুভূতিগুলো এমন অদ্ভুত কেন অয়নন্দিতা। এই অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করতে করতে তোমায় যখন ভালোবেসে আমার মায়াজালে জড়িয়ে নিলাম ঠিক তখনই তুমি অসুস্থ হয়ে বিছানায়। মেয়ে তোমায় বোঝাব কেমন করে কতটা জ্বলছি আমি তোমার যন্ত্রণায়। সুস্থ হয়ে ওঠো মায়াপরী। তোমায় নিয়ে অনেক দূরে পাড়ি জমাব। তোমায় নিয়ে স্বপ্নের শহর গড়ব। সেই শহরে আদুরে রাজপ্রাসাদ বানাব। আর সেই রাজপ্রাসাদের রাজরানী হবে তুমি। আমার ভালোবাসার রাজরানী।

চলবে……………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here